বছরের শুরু থেকেই চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু। জানুয়ারি মাস থেকেই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, কয়েক দিন ধরে গড়ে প্রায় ৩০ জন মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। যদিও এ হিসাবটি ঢাকার ৫৩টি হাসপাতাল এবং বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জন অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্য।
এই হাসপাতাল ছাড়াও ছোট-বড় বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়েছে আরো বেশ কিছুসংখ্যক রোগী। যেসব ক্লিনিক বা হাসপাতাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তথ্য পাঠায় না তাদের রোগী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে না। হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টারের তথ্য মতে, চলতি মাসের ১৮ তারিখ পর্যন্ত মোট এক হাজার ৩৫৯ জন লোক হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়েছে এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১২ জন মারা গেছে। এ ছাড়া অনেক রোগী বাসায় থেকেও চিকিৎসা নিয়েছে।
উষ্ণ-আর্দ্র আবহাওয়া থাকার কারণে বাংলাদেশ মশা ও মশাবাহিত রোগ বিস্তারের জন্য উত্তম জায়গা। উপযুক্ত তাপমাত্রা, আর্দ্রতার সঙ্গে যোগ হয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ। বছরের শুরু থেকে ডেঙ্গুর চোখ-রাঙানি আরো আতঙ্কিত করে তুলেছে নগরবাসীকে।
এমন পরিস্থিতিতে বছরের শুরু থেকেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন সতর্ক অবস্থানে থেকে পরিস্থিতি মোকাবেলায় চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এরই মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বাংলাদেশ স্কাউটস, বিএনসিসি এবং স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের এডিস মশা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ স্কাউটস এবং বিএনসিসি সদস্যদের এ কাজে যোগ্য করে তোলার লক্ষ্যে তারা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছে, যেটি অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। বিভিন্ন সেবামূলক সংস্থা এবং স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা এডিস মশা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত হলে অবশ্যই ভালো ফল আসবে। তবে তাদের এই কার্যক্রম নিয়মিতভাবে মনিটরিং করতে হবে।
বাংলাদেশে ১৯৬৪ সালে ডেঙ্গু আসে, তখন এটিকে ঢাকা ফিভার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বেশি হয় ২০০০ সালে। ওই বছর সরকারি হিসাব মতে পাঁচ হাজার ৫০০ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং ৯৩ জন মারা যায়। সরকারি হিসাব মতে, ২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৬২ হাজার ৩২১ ও মৃত্যু হয়েছে ২৮১ জনের। ২০২৩ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু রোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যারা চিকিৎসা নিয়েছে তাদের প্রায় অর্ধেক ঢাকার বাইরের জেলার। একসময় ডেঙ্গু ঢাকার রোগ ছিল, কিন্তু এখন এটি বিস্তৃত হয়ে সারা দেশের প্রতিটি জেলায় ছড়িয়েছে। মে মাসের শুরু থেকেই ডেঙ্গু ঊর্ধ্বমুখী, মাঠ পর্যায়ে এডিস মশার ঘনত্ব আমরা বেশি পাচ্ছি। মাঠ পর্যায়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ বছর চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগে অন্যান্য বছরের তুলনায় ডেঙ্গু বেশি হওয়ার ঝুঁকি আছে। ঢাকায়ও ডেঙ্গুর দাপট থাকবে।
ডেঙ্গু ছড়ায় এডিস মশার মাধ্যমে আর এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অন্যান্য মশার তুলনায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণও সহজ। কারণ এডিস মশা পাত্রে জমা পানিতে বংশবিস্তার করে। জমা পানির পাত্র অপসারণ কঠিন কোনো কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি নগরবাসীকেও সম্পৃক্ত হতে হবে। এডিস মশা কীটনাশক সহনশীল নয়, তাই কীটনাশক দিয়েও এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ।
মে মাসের ডেঙ্গুর পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে বৃষ্টি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরো বৃদ্ধি পাবে। এ বছর ডেঙ্গুর মৌসুমে বিশেষ করে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু ভয়াবহ হতে পারে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় আগাম পদক্ষেপ নিতে হবে। এই আগাম পদক্ষেপের অন্যতম হলো এডিস মশার প্রজননস্থল অপসারণ বা নিয়ন্ত্রণ করা। ঢাকার কিছু কিছু হাসপাতালে, বিশেষ করে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ, আজগর আলী হাসপাতাল, সালাউদ্দিন হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বেশি। এই হাসপাতালগুলো থেকে রোগীর ঠিকানা সংগ্রহ করে সেই রোগীর বাড়ির আশপাশে মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করতে পারলে ওই এলাকায় সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব। ডেঙ্গু রোগীটি যেখান থেকে আক্রান্ত হচ্ছে সেই জায়গায় ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা আছে। ভাইরাসবাহিত এডিস মশাটি যত দিন বেঁচে থাকবে জ্যামিতিক হারে ডেঙ্গু রোগ ছড়াতে থাকবে। তাই ডেঙ্গু রোগীর বাড়িকে কেন্দ্র করে ক্র্যাশ প্রগ্রাম করা প্রয়োজন।
ডেঙ্গু এমন একটি সমস্যা যেটিকে সরকার বা সিটি করপোরেশন একা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। পৃথিবীর কোনো দেশই জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল হয়নি। ডেঙ্গু সংক্রমণ পরিস্থিতিতে কাউকে দোষারোপ না করে যার যার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে মশা নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত হওয়া প্রয়োজন। সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব রাস্তাঘাট, উন্মুক্ত স্থান, সরকারি স্থাপনা, বাস টার্মিনালগুলোতে এডিস মশার প্রজনন বন্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করা আর নগরবাসীর দায়িত্ব তার বাড়ি এবং আঙিনায় এডিস মশার প্রজনন যেন না হয় তা নিশ্চিত করা। সিটি করপোরেশন ও নগরবাসীর সম্মিলিত কার্যক্রমই পারে ডেঙ্গু সমস্যার সমাধান করতে।
লেখক: ড. কবিরুল বাশার – কীটতত্ত্ববিদ, গবেষক, অধ্যাপক প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।