হেফাজতে ইসলামের মলাটে গাঁটছড়া বেঁধেছে সরকারবিরোধী শক্তি— এমনটাই মনে করছে টানা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ। আর তাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে ঘিরে হেফাজতে ইসলামের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। এমনকি আওয়ামী লীগের নেতাদেরও দাবি, যারা সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় অন্ধত্বকে পুঁজি করে দেশে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র বানাতে চায় তাদের বিরুদ্ধে দলটির প্রতিরোধ চলমান থাকবে। তাই অতীত বিবেচনা করে ভবিষ্যতে হেফাজতে ইসলামকে আর এক চুল ছাড় না দেওয়ার পক্ষে দলের হাইকমান্ড।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মুজিব চিরন্তন শীর্ষক ১০দিনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশ সফরে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গত ২৬ ও ২৭ মার্চ তিনি বাংলাদেশে অবস্থান করেন। অভিযোগ রয়েছে, মোদির আগমনকে ঘিরে বিএনপি-জামায়াতের ইন্ধনে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে হেফাজতের নেতাকর্মীরা। মোদি বিরোধিতার নামে ঢাকা চট্টগ্রাম, হাটহাজারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুর, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপিও হেফাজতের কায়দায় সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানোর চেষ্টা করে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, হেফাজতের তাণ্ডবের পেছনে বিএনপি ও জামায়াতের প্রত্যক্ষ মদদ রয়েছে বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। বিএনপি নেত্রী নিপুন রায়ের ফোনালাপ এবং দলটির সিনিয়র নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্যে এর সত্যতা ফুটে উঠেছে। শুধু তাই নয়, হেফাজতের নামে মৌলবাদী শক্তির তৎপরতা দেশ ও জনগণের জন্য হুমকি বলেও মনে করছেন দলটির হাইকমান্ড। তাই এই অপশক্তির পেছনের ইন্ধনদাতাদেরও খুঁজে বের করার পরামর্শ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
অভিযোগ রয়েছে, হেফাজতের কর্মসূচিতে ঢুকে গাড়ি পোড়াতে নির্দেশ দেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নিপুন রায়। এই ফোনালাপ গোয়েন্দাদের হাতে যাওয়ার পর রায়েরবাজারের বাসা থেকে নিপুন রায়কে গ্রেফতার করে র্যাব। দেশের কয়েকটি এলাকায় হেফাজত কর্মীদের সরকারি ও বেসরকারি অফিস ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় অগ্নিসংযোগের পেছনে স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াত-শিবির কর্মীরা সক্রিয় ছিল বলে সন্দেহ ক্ষমতাসীনদের। রাজনীতির মাঠে নিজেদের শক্তি হারিয়ে এখন অন্যের ওপর ভর করে ফায়দা নেয়ার অপচেষ্টা করছে বিএনপি-জামায়াত জোট।
আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে দলীয় হাই কমান্ড থেকে সারাদেশে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগের নেতাদের স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার জন্য নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে যেসব এলাকায় ইতোমধ্যে হেফাজত, বিএনপি, জামায়াতের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে, তাদের তালিকা করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সরকারের হার্ডলাইনের কারণে সারাদেশে হেফাজতের ইসলামের নামে তাণ্ডবকারী, মদদদাতাদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার শুরু হয়েছে।
এদিকে দলীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের মধ্যে থাকা বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজত সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করাও হচ্ছে। সময় মতো তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এর আগে হেফাজতের তাণ্ডবের ধারাবাহিকতায় ক্ষতিগ্রস্থ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন শুরু করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল। প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, এরপর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও এবং পরবর্তীতে ফরিদপুরের সালথায় পরিদর্শনে যান। এসব এলাকায় পরিদর্শন শেষে প্রতিনিধি দলের নেতারা সহিংসতায় জড়িত হেফাজত ইসলামের নেতাকর্মীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার কঠোর বার্তা দেন। নেতারা জানান, সরকার ইতোমধ্যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রত্যেক জেলায় ও উপজেলায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে দমন করতে প্রশাসনকে সহয়তা করার জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেন নেতারা। কারণ হেফাজতে ইসলামের মলাটে বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক উগ্র রাজনৈতিক দলের নেতারা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছেন বলেও মনে করছেন নেতারা। তাই এবার হেফাজত ইস্যুতে কৌশলগত কারণে হার্ডলাইনে থাকার পরিকল্পনা নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে সুসংগঠিত করি এবং চেতনায় উদ্বুদ্ধ করি। এমনকি একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ব্যবস্থার জন্য আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান। তাই এই যে সাম্প্রদায়িক কলহ ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে, এটি রাজনৈতিকভাবেই আমরা মোকাবিলা করার পক্ষে। সরকার রয়েছে, তারা অবশ্যই তাদের জায়গা থেকে ব্যবস্থা নেবে।’
তিনি বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম যে কর্মকাণ্ড করছে, শাপলা চত্বর থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত— তা আমাদের পাশাপাশি দেশবাসীও লক্ষ্য করেছে। কাজেই আমরা তাদের আর এক চুল ছাড় দেওয়ার পক্ষে না। যারা এই সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় অন্ধত্বকে পুঁজি করে দেশে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়, তাদের নিয়ন্ত্রণ জানান দিতে চায়, শক্তির জানান দিতে চায়— তাদের বিরুদ্ধে আমাদেরও প্রতিরোধ চলবে।’
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা মনে করি, এই ষড়যন্ত্র একাত্তরের পরাজিত শক্তি এবং ১৫ আগস্টের খুনিদের প্রতিনিধিরাই করছে। কারণ তারা বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে ব্যহত করতে চায়। আজ বিশ্ব নেতৃত্ব যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করছে, তখন এতে তারা ইর্ষান্বিত হয়ে পড়েছেন। এ কারণেই স্বাধীনতার শত্রুরা তথাকথিত মোদি বিরোধিতার কর্মসূচি দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে চেয়েছিল। বাংলাদেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নকে ব্যহত করতে চেয়েছিল।’
আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘যারা হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে আন্দোলন-সংগ্রামের নামে তাণ্ডব করেছেন, তারা সত্যিকার অর্থে ইসলামের হেফাজতকারী না। তারা ষড়যন্ত্রকারী এবং স্বাধীনতাবিরোধী-মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পঁচাত্তরের খুনি বিএনপি-জামায়াতের হেফাজতকারী। তাদের বিরুদ্ধে সরকারের পাশাপাশি দলের কঠোর অবস্থান চলমান থাকবে।’