১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হবার পর ওইদিন পরিবারের বেঁচে যাওয়া অন্য সদস্যদের জন্য দিনগুলো কতটা কঠিন ছিলো, তা তুলে ধরে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি বলেছেন:
স্কুলে যেতে পারতাম না। খুনিরা সবখানে ফলো করতো। ওই সময় ১৫ আগস্ট-ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স সম্পর্কে সকলকে গিয়ে গিয়ে জানাতে হতো। তবে আশার কথা হলো, এখন সময় বদলেছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি যাদুঘরে ‘সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফর্মেশন (সিআরআই)’ আয়োজিত ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা: যাত্রা, অর্জন ও চ্যালেঞ্জসমূহ’ শীর্ষক সেমিনারের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি।
১৫ আগস্ট মা-খালা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যায়।
আমার মা এবং খালা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিদেশে ছিলেন। এ কারণে আমার লন্ডনে জন্ম ১৯৮০ সালে। এরপর ১৯৮২-৮৩ সালে কিছুদিনের জন্য ঢাকায় আসলাম। তখন বেশ ছোট ছিলাম। বাবার পিএচডি শেষ হওয়ার পর ১৯৮৬ আমরা বাংলাদেশে ফেরত আসলাম। আমি এখানে এসে একটি স্কুলে ভর্তি হলাম। বনানীতে কেজি ওয়ান, কেজি টু। খুব ভাল লাগত স্কুল। অনেক বন্ধুরা ছিলো। আমার বেস্ট ফ্রেন্ডরা ছিলো এই স্কুলে। হঠাৎ করে মা একদিন বললেন, আমার স্কুল বদলাতে হবে। আমি তখন খুব মন খারাপ করলাম। মার সঙ্গে রাগ করলাম। কেনো স্কুল বদলাতে হবে। আমার বেস্ট ফ্রেন্ডরা এখানে পড়তেছে। তখন মা বলল, এখানে খুনিদের বাচ্চারা পড়ালেখা করছে।
আমি তখন ছোট ছিলাম, অতকিছু বুঝতাম না। আসলে সে সময় এই হত্যাকারীদের কিছু শিশুও আমার স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। স্কুল থেকে বেশ কয়েকবার আমাদের অনুসরণ করে বাসা পর্যন্ত মানুষজন আসল। এ ছাড়াও প্রতিদিন স্কুল গেটে তাদের মুখোমুখি হওয়া। আর পূর্বের বক্তারাই বলেছেন, সে সময় ফ্রিডম পার্টির মানুষজন কিভাবে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করত। সে কারণেই মা আর আমাকে ঐ স্কুলে পড়াতে রাজি হয়নি।
খুনিরা স্কুল থেকে আমাদের ফলো করতে শুরু করলো। মা সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে আবারও দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার। স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আর কত দিন। আপনারা তো জানেন আমার মা-খালারা তাদের জীবন নিয়ে কখনও ভীত ছিলেন না। কিন্তু, আমাদের নিয়ে তারা চিন্তিত ছিলেন।
তখন মার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এরা কোন খুনি? আর যদি খুনি হয়, সবাই জানে, তাহলে তারা এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিভাবে? শিশু হিসেবে আসলে তখন ভাল-মন্দের বাহিরে কিছু ভাবতে পারছিলাম না। মা তখন আমাকে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সের কথা বলেন। ঐ ছোট বয়সেই আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এটা আবার আইন হতে পারে নাকি? একজনকে খুন করে তার বিচার না করার জন্য আইন আবার কিভাবে হয়?
আমার খালা বা মার ছোটবেলা থেকেই ১৫ আগস্ট সম্পর্কে আমাদের বলে দিতেন। কোন কিছু লুকিয়ে রাখতেন না। ফলে ছোট বেলা থেকেই বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা জানতাম। তারা আমাদের বলতেন, এটা তোমাদের পরিবারের ইতিহাস। জানতে হবে। আর সে কারণেই এ সময় থেকে আমার মাথায় এই অর্ডিন্যান্সের কথা ছিল।
এরপর এমন অবস্থা সৃষ্টি হল, যে আমার মা-খালারা দেখলেন এখানে থাকাই তাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেল। যারা আমার মা ও খালাকে চেনেন, তারা জানেন। এই দুজন নিজেদের নিয়ে কখনও ভয় পেতেন না। কিন্তু আমরা তখন ছোট ছিলাম। আমাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তারা আবারো দেশের বাহিরে চলে গেলেন। এরপর ১৯৯৩ সালে আমরা বাংলাদেশে ফেরত আসলাম। তখন আমাদের বয়স ১২-১৩। বন্ধুদের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে আলাপ হত। বন্ধুরা তখন অনেকে জেনারেল জিয়ার কথা বলতেন। উনি এই, উনি সেই। যেই ব্যক্তি ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স পাশ করে, সে কিভাবে ভাল হতে পারে। এটা আবার কোন ধরনের ন্যাশনাল হিরো?
এ সময় অনেকেই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স সম্পর্কে জানত না। ‘৭৫ সাল নিয়ে সঠিক তথ্য জানত না। অনেক বিষয়েই তারা জানত না। এ সময় আমি আর আমার কিছু বন্ধু এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতাম। অন্যদের বোঝাতাম। এটা আমাদের জন্য সংগ্রাম ছিল।
আমার এখন ভাল লাগছে, কারণ আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আমার সবাইকে জানাতে হত, এটা জান নাকি, ওটা জান নাকি। কিন্তু বর্তমানে তরুণ প্রজন্ম আমাকে গবেষণা করে আমার নানা সম্পর্কে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য দিচ্ছে। আমি তাদের কাছ থেকে নতুন নতুন বিষয় জানতে পারছি। এটা ভাল লাগছে। আজকে মঞ্চে যারা উপস্থিত ছিল তারা অনেকেই হয়ত বঙ্গবন্ধুর দেখা পেয়েছেন। কিন্তু আমি তার দেখা পাইনি। আর আমরা যারা দেখা পাইনি, তাদের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানা। তার সম্পর্কে জানা এবং অন্যদের জানানো আমাদের দায়িত্ব।