1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

উৎসব ও অর্থনীতি

ড. আতিউর রহমান : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৩

নতুন বাংলা সন আমাদের দ্বারপ্রান্তে। বাংলা নববর্ষ ঘিরে সব উদযাপনের মূলকথা বাঙালির আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান এবং অসাম্প্রদায়িকতার মর্মবাণী তুলে ধরা। আগের বেশ কটি নববর্ষ আমরা করোনা মহামারির কারণে সেভাবে উদযাপন করতে পারিনি। তাই এবারের নববর্ষ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ—এ কথা মানতেই হবে। এ বছর আবার বর্ষবরণ হবে রমনা বটমূলে। শত দুঃখ সত্ত্বেও নিশ্চয় এবারের নববর্ষে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-নির্বিশেষে সবাই যুক্ত হবে এই আনন্দযজ্ঞে। নব আনন্দে জাগবে মানুষ। একই সঙ্গে তারা তৈরি হচ্ছে ঈদ উৎসব উদযাপনের জন্য। যদিও মূল্যস্ফীতির বাড়বাড়ন্ত অবস্থার কারণে কম আয়ের মানুষের আয়-রোজগার কমেছে, তবু কয়েক বছর বাদে হলেও মানুষ প্রাণপণে চেষ্টা করছে প্রিয়জনদের জন্য কিছু কেনাকাটা করতে। অন্যদিকে বেশি আয়ের মানুষজন বরাবরের মতো মেতেছে বেশি বেশি কেনাকাটার জন্য। অনেকেই তৈরি হচ্ছে দেশে-বিদেশে পর্যটনের জন্য। দেশে ব্র্যান্ডেড শপিং সেন্টার ছাড়া অন্যান্য শপিং মলেও ক্রেতার বেশ ভিড় লক্ষণীয়। ভোগ্য পণ্যের বাজারও বেশ সচল। নববর্ষ ও ঈদ মিলিয়ে দুই লাখ কোটি টাকার বেশি কেনাকাটা হবে বলে ব্যবসায়ীরা প্রত্যাশা করছেন। যদিও বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডে বিপুলসংখ্যক ব্যবসায়ী এখন হতভম্ব, তবু পুরো দেশে উৎসবের অর্থনীতি বসে নেই।

মনে রাখা চাই, আমাদের অর্থনীতি মূলত সহনীয় ভোগ ও চাহিদানির্ভর। আর এই চাহিদার বড় উৎস আমাদের রপ্তানি ও রেমিট্যান্স খাত। কৃষি তো আছেই। এই তিন খাতের অর্থের বিরাট অংশ পৌঁছে যায় গ্রামবাংলায় সাধারণ মানুষের হাত ধরে। গার্মেন্টস ও অন্যান্য রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানায় কর্মরত কোটিখানেক শ্রমিক ও সাধারণ কর্মচারী এবং প্রায় একই পরিমাণের প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ গ্রামবাংলার অর্থনীতিকে চাঙ্গা রেখেছে শুধু এ কথা বললে সবটা বলা হয় না। শহর ও শহরতলির ভোগের অর্থনীতিরও তাঁরা বড় অংশীজন। আর ডলার কামাই করা এই জনশক্তিই আমাদের বিদেশি বাণিজ্যের প্রধান শক্তির উৎস। তাঁদের কল্যাণেই রিজার্ভ এখনো সম্মানজনক অবস্থায় আছে। ম্যাক্রো অর্থনীতির যতটা স্থিতিশীলতা বাংলাদেশ ধরে রেখেছে তার কৃতিত্ব এই মেহনতি জনগোষ্ঠীকে অবশ্যই দিতে হবে।

মার্চ মাসে রপ্তানি ও প্রবাস আয়—দুই-ই বেশ বেড়েছে। রেমিট্যান্স ২১৮ কোটি ছিল। এই ধারা এখনো বজায় রয়েছে। আশা করা যায় আগামী তিন মাস তা বজায় থাকবে। এই আয় আমাদের ভোগের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করছে। এবার তাই বাংলা নববর্ষ এবং রোজার ঈদ ঘিরে জনসাধারণের আগ্রহ-উদ্দীপনা বেশি থাকবে তেমনটিই মনে করা হচ্ছে। এই উৎসব উদযাপনের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব তো রয়েছেই। এগুলোর অর্থনৈতিক প্রভাব ও গুরুত্বও আলাদা মনোযোগের দাবি রাখে। বিশেষত একদিকে করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার চলমান থাকা এবং অন্যদিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে নিত্যপণ্যের বাজারে যে চাপ রয়েছে তার প্রেক্ষাপটে এই উৎসবগুলোকে ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বিশ্লেষণ আরো বেশি জরুরি। তবে রপ্তানি ও প্রবাস আয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গতিময়তার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ ভোগ ও চাহিদার যে গভীর সম্পর্ক আছে তা তো মানতেই হবে। সেই বিচারে বাংলাদেশ দুই পায়েই বেশ আস্থার সঙ্গে হাঁটছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমাদের কৃষির সাফল্য। আর অর্থনীতির এই ত্রয়ী শক্তির প্রভাবে দেশের মানুষের অভ্যন্তরীণ ভোগ ও চাহিদা—দুই-ই বাড়ছে। এসবের প্রভাব তো উৎসবের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি অনেকটা নির্ধারণ করবেই।

আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক আলোচনা ও সংলাপে রপ্তানি যতটা মনোযোগ পায়, আমি লক্ষ করেছি অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা পূরণ ততটা গুরুত্ব এখনো পাচ্ছে না। এর একটি কারণ হতে পারে দেশের অর্থনীতির অনানুষ্ঠানিকতা। অনানুষ্ঠানিকতার কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা এবং সেই চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে পরিচালিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে চুলচেরা হিসাব করা জটিল বটে। এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত তথ্যের ঘাটতি যে আছে তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবু একে কম গুরুত্ব দেওয়া সমীচীন নয় মোটেও। রবীন্দ্রনাথ সব সময় সমাজের ‘আত্মশক্তি’র ওপর ভিত্তি করে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। একইভাবে বঙ্গবন্ধুও বিদেশের ওপর নির্ভরশীলতা যতটা সম্ভব কমিয়ে দেশকে আত্মনির্ভরশীল করার পক্ষে ছিলেন। স্বাধীনতার পর পর তাঁর নেওয়া অর্থনৈতিক পদক্ষেপ থেকে শুরু করে তাঁর তৈরি প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও এমন জোরই দেখি। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও দেশের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতাকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে যাচ্ছেন শুরু থেকেই।

এবারের বাংলা নববর্ষ এবং রোজার ঈদ আমাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য আলাদাভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভেবে দেখুন, নববর্ষের এই সর্বজনীন সাংস্কৃতিক উদযাপনকে কেন্দ্র করে করোনাজনিত অর্থনৈতিক অচলাবস্থায় ঝিমিয়ে পড়া খাতগুলোতে গতিসঞ্চার হলে তা পুরো অর্থনীতির জন্য কতটা ইতিবাচক হতে পারে। মধ্য ও উচ্চবিত্তের কথা না হয় না-ই বললাম, শহরের নিম্ন আয়ের মানুষ যাঁরা, ধরা যাক গার্মেন্ট শ্রমিকদের কথা, তাঁরা সবাই যদি পরিবারের জন্য নববর্ষ উপলক্ষে কিছু কেনাকাটা করেন, তাতে কয়েক হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হওয়ার কথা। গ্রামেও তো এখন সেবা খাতের ব্যাপ্তি অনেক। আয়ের ৬০ শতাংশই আসছে অকৃষি খাত থেকে। কাজেই নববর্ষকে কেন্দ্র করে গ্রামের অকৃষি খাতের উদ্যোক্তারাও বাড়তি বেচাকেনার মুখ দেখবেন। দেশব্যাপী টাকার এই লেনদেনের ফলে সংশ্লিষ্ট কর্মীদেরও আয়-রোজগার বাড়বে। তাঁদের জন্য নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চাপ মোকাবেলা কিছুটা হলেও সহজতর তো হবেই। করোনার দুর্দশা কাটিয়ে তিন বছর বাদে পুরো মাত্রায় বাংলা নববর্ষ উদযাপন অর্থনীতির জন্য সুখবরই বটে। আর ‘ব্যাক-টু-ব্যাক’ ঈদুল ফিতরের উৎসব ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্যে যে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব আমাদের অর্থনৈতিক গতিময়তার ওপর পড়তে বাধ্য। এই কথাটি মানলে বিশ্বব্যাংক ও অন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো চলতি অর্থবছরের জন্য ৫ শতাংশের সামান্য বেশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আভাস দিচ্ছে, তা মোটেও বাস্তবানুগ নয়। আমাদের মাটি ও মানুষের অর্থনীতির প্রকৃত শক্তিমত্তার কথা মাথায় রেখে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের প্রভাবে দেশের অভ্যন্তরীণ ভোগ ও চাহিদার গতিময়তার দিকটি হিসাবে নিলে এই অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি কোনোমতেই ৬ শতাংশের কম হতে পারে না।

বিশেষ করে দেশীয় কুটির-ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পের জন্য বাংলা নববর্ষ ও ঈদ উদযাপন বেশি সহায়ক হবে বলে মনে করি। উদাহরণ হিসেবে দেশের ছোট ছোট পোশাক প্রস্তুতকারক ও বাজারজাতকারীদের কথা ধরা যায়। দশ-পনেরো বছর আগেও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে পোশাক কেনা অত বেশি ছিল না। কিন্তু করোনা আসার আগে আগে ২০১৯ সালের পহেলা বৈশাখ ঘিরে ১৫ হাজার কোটি টাকার পোশাক বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছে অভ্যন্তরীণ পোশাক প্রস্তুতকারক মালিক সমিতি। এই পোশাক শুধু বিপণিবিতানে বিক্রি হয়েছে এমন নয়। বরং ফুটপাতের বিক্রেতাসহ অনানুষ্ঠানিক বিক্রয়কেন্দ্র থেকেও এর একটি বড় অংশ বিক্রি হয়েছে। ২০১৯ সালের আগের হিসাব বলছে, এই বিক্রির পরিমাণ বছরে গড়ে ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে। করোনাকালে এই প্রবৃদ্ধি নিশ্চয়ই ধাক্কা খেয়েছে। তবে এবারের নববর্ষে নিশ্চয়ই আমরা পুরোপুরি আগের ধারায় না ফিরলেও গত তিন বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় পোশাক বিক্রি বাড়তে দেখব। শুধু ছোট পোশাক প্রস্তুতকারকরাই নয়, বড় বড় ফ্যাশন হাউসগুলোও জানিয়েছে যে তাদের মোট বিক্রির এক-চতুর্থাংশের বেশি হয় এই বাংলা নববর্ষেই। আর শুধু পোশাক বিক্রি কেন, হালখাতা অনুষ্ঠানের জন্য মিষ্টি দোকানের যে ব্যবসা হয় তা-ও তাদের সারা বছরের বিক্রির চার ভাগের এক ভাগ। সরকারের ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ নীতি আর ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর কারণে গ্রামাঞ্চলে উৎসবকেন্দ্রিক চাহিদা দ্রুত আরো বাড়বে। ফলে ভবিষ্যতে পহেলা বৈশাখ ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রবৃদ্ধির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। আর মধ্যবিত্তের রেস্তোরাঁয় খাওয়ার যে অভ্যাস গড়ে উঠেছে তারও প্রভাব অভ্যন্তরীণ ভোগ বাণিজ্যে নিশ্চয় পড়বে।

এবারের বাংলা নববর্ষের কয়েক দিন পরই ঈদুল ফিতর। কাজেই বলা যায়, চলতি এপ্রিল মাসের দ্বিতীয়ার্ধজুড়েই বাজার সরগরম থাকবে। ঈদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সুফলও পৌঁছে যাবে সব স্তরে। পোশাক, জুতা, ভোগ্য পণ্য, পরিবহন, পর্যটন, আপ্যায়ন, বিনোদনসহ নানা খাতে ঈদ উৎসবের প্রভাব পড়বে। তাই অর্থনীতির গাঝাড়া দিয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় এই দুটি সপ্তাহ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হবে—এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। ব্যবসায়ীরা, বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা এবং নতুন যুক্ত হওয়া অনলাইন উদ্যোক্তারা যেন এই সময়টায় নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারেন সে জন্য সর্বাত্মক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থনীতির অনানুষ্ঠানিক চরিত্রের কারণেই হোক বা অন্য কারণে হোক, এখনো উৎসবকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রভাবের মাত্রা কতটা তার যথাযথ পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই। এদিকটায় এখনই নজর দেওয়া চাই। সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা এবং আগাম ঈদ মোবারক।

লেখক: ড. আতিউর রহমান – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।


সর্বশেষ - রাজনীতি