1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

অগ্নিকাণ্ড রোধে আমাদের শিক্ষণীয় ও করণীয়

ড. খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ৬ এপ্রিল, ২০২৩

কাঠামোগত ত্রুটির কারণেও অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়। যেসব বহুতলবিশিষ্ট বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে বা হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগেরই নেই কোনো অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা, ওয়াটার হাইড্রেন্ট এবং বড় ধরনের জলাধার

ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বঙ্গবাজারসহ পাশের তিনটি মার্কেট ও পুলিশ সদর দপ্তরের একটি শেড ভস্মীভূত হয়েছে। কয়েক হাজার পরিবার জীবন-জীবিকা হারিয়ে নিঃস্ব ও দুস্থ জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হয়েছে মাত্র ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে। উল্লেখ্য, চার সহস্রাধিক দোকানে ঈদ উপলক্ষে যে বিপুল পরিমাণ পণ্যসম্ভার মজুদ করা হয়েছিল তা মুহূর্তের মধ্যে ভস্মীভূত হয়ে যাওয়ায় সহায়-সম্বলহীন ব্যাবসায়িক জনগোষ্ঠী এবং নির্ভরশীল সদস্যসহ লক্ষাধিক মানুষ তাঁদের সব ধরনের সম্পদ হারিয়েছে, যা নিরূপণ করা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। তবে এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড কোনো নতুন কিছু নয়।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী শুধু ২০২২ সালে বাংলাদেশে ২৪ হাজারের বেশি অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে এবং শতাধিক মানুষ অগ্নিজনিত দুর্ঘটনায় মারা গেছে এবং বেশ কিছু মানুষ আগুনের দ্বারা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে এবং তাদের মধ্যে অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং নানা ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে দুঃসহ জীবন যাপন করছে। তবে ২০২৩-এর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা অনেক মারাত্মক। এরই মধ্যে সংঘটিত বড় অগ্নিকাণ্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম কনটেইনার ডিপোর অগ্নিকাণ্ড, সীতাকুণ্ড অক্সিজেন প্লান্টের অগ্নিকাণ্ড, গাজীপুর কম্পোজিট ফ্যাক্টরি ও গাজীপুর ইয়ার্ন ফ্যাক্টরির অগ্নিকাণ্ড, মহাখালী বস্তি, তেজগাঁও বস্তি ও কুনিপাড়া বস্তির ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। এরই মধ্যে রোহিঙ্গা শিবিরের পাঁচ সহস্রাধিক বাড়িঘর আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে। পাশাপাশি বিস্ফোরণজনিত অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে সায়েন্স ল্যাবের নিকটবর্তী ভবনে, সিদ্দিকবাজার ও সদরঘাটে। প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডেই অবকাঠামোসহ অনেক সম্পদহানি হয়েছে, পাশাপাশি সব কিছু হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়ায় বহু পরিবার দুঃসহ জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে।

বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সুনির্দিষ্ট কারণ অনুসন্ধানের জন্য পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, যার ফলাফল জানতে আমাদের কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। অন্যদিকে স্যায়েন্স ল্যাব ও সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণজনিত অগ্নিকাণ্ডের কারণ উদঘাটন করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণগুলোর মধ্যে ৩৮ শতাংশ সংঘটিত হয় বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, ওভারলোডিং সার্কিট, ত্রুটিপূর্ণ ওয়্যারিং এবং বৈদ্যুতিক লাইন ও ওয়্যারিংয়ের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। এর সঙ্গে রয়েছে বৈদ্যুতিক লাইনের আর্থিং না থাকা, নিম্নমানের সার্কিট ব্রেকারগুলোকে আগুন নিরোধক কেবিনেটের মধ্যে স্থাপনসহ নিরাপদ করার ব্যবস্থা না থাকা। অন্যদিকে শতকরা ১৬ ভাগ অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয় গ্যাসজনিত কারণে, যার মধ্যে রয়েছে গ্যাস লাইনের বিস্ফোরণ, গ্যাসের পাইপ লিকেজজনিত কারণ এবং লিকেজজনিত কারণে জমাকৃত গ্যাসের সঙ্গে স্যুয়ারেজ লাইনের সংযোগে সংঘটিত বিস্ফোরণ, প্রেসার ভেসেল বিস্ফোরণ, নিম্নমানের সিলিন্ডারের মাধ্যমে ব্যবহৃত আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের বিস্ফোরণ, গ্যাস, লিকুইড ও কমপ্রেসড গ্যাসের যত্রতত্র পরিবহনজনিত বিস্ফোরণ ইত্যাদি। এ ছাড়া অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে জমাকৃত আবর্জনা ও মজুদকৃত নানা বিস্ফোরকে নানা কারণে খোলা আগুন বা সিগারেট-বিড়ির অবশিষ্টাংশের আগুন থেকে আকস্মিক অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত, যা মুহূর্তের মধ্যে আবাসিক কিংবা বাণিজ্যিক ভবনে ছড়িয়ে পড়া।স্যায়েন্স ল্যাব

পাশাপাশি আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকায় বিভিন্ন কেমিক্যালের মজুদকৃত ভবনে আকস্মিক ও দুর্ঘটনাজনিত ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড,  রেফ্রিজারেটরের, বিশেষ করে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে লিকেজজনিত অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদি। সর্বোপরি উত্তপ্ত আবহাওয়াজনিত কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। অন্যদিকে কাঠামোগত ত্রুটির কারণেও অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়, বিশেষ করে যেসব বহুতল বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে বা হয়েছে সেগুলোর  বেশির ভাগেরই নেই কোনো অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা, ওয়াটার হাইড্রেন্ট ও বড় ধরনের জলাধার। বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডে আমরা দেখেছি আশপাশে পানির ব্যবস্থা না থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের পুকুর থেকে পানি নিতে হয়, যা যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। উল্লেখ্য, বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে মাত্র ২০০ মিটার দূরে অবস্থিত ফায়ার সার্ভিসের হেডকোয়ার্টার হওয়ায় তাত্ক্ষণিকভাবে ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিটের ৬০০ থেকে ৭০০ কর্মী, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, র‌্যাব, বিজিবি, সিটি করপোরেশন, মেডিক্যাল বিশেষজ্ঞ টিম, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের নানা ধরনের বিশেষায়িত দল এবং নানা ধরনের ইকুইপমেন্টস যুক্ত করা হয়েছে। এই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ছয় ঘণ্টার মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে, যা অবশ্যই প্রশংসনীয় কার্যক্রম। তবে ক্রমাগত ও আকস্মিকভাবে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ড নিরোধ করতে হলে নিম্নলিখিত করণীয়গুলো জরুরি ভিত্তিতে করতে হবে।

অগ্নিকাণ্ডজনিত ঝুঁকি নিরূপণ করার জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা পরিচালনার মাধ্যমে ঝুঁকিগুলো উদঘাটন করা; অতঃপর উদঘাটিত ঝুঁকিগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে সব ধরনের ঝুঁকি নিরসনের লক্ষ্যে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ, সেগুলোকে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার নীতিমালায় অন্তর্ভুক্তিসহ নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ ও কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে অগ্নিনির্বাপণের বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় রোল মডেল হলেও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ এবং দুর্ঘটনাজনিত দুর্যোগ ও আপত্গুলো মোকাবেলার জন্য বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। পাশাপাশি অগ্নিঝুঁকিসংক্রান্ত বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রণীত ফায়ার সেফটি প্ল্যানের যে করণীয়গুলো রয়েছে, যথা অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ, অগ্নিকাণ্ড থেকে জনগণ ও সম্পদ নিরাপদ করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, অগ্নিনির্বাপণ সংশ্লিষ্ট ইকুইপমেন্টসের সংখ্যা বৃদ্ধি ও সেগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও নির্বাহ করা, নগর স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ প্রদান, অধিকসংখ্যক পেশাজীবী ও প্রশিক্ষক তৈরি করা, অগ্নিকাণ্ডের সময়ে জনসমাগম কঠোরভাবে দমনপূর্বক উদ্ধারকর্মীদের সহজে যাতায়াতের সুযোগ দেওয়া, বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনের মধ্যে সুপরিসর স্পেস নির্বাহ করার লক্ষ্যে কঠোরভাবে বিল্ডিং কোড মেনে চলা, রাজউক অনুমোদিত ভবন নকশার ক্ষেত্রে প্রতিটি বিল্ডিংয়ে নিজস্ব স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থার বাধ্যবাধকতাসহ ওয়াটার হাইড্রেন্ট এবং আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকায় জোনভিত্তিক পানির রিজার্ভার রাখার বাধ্যবাধকতা, প্রতিটি আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে এক্সিট ও ইভাকুয়েশন রুটের ব্যবস্থার বাধ্যবাধকতা আইনগতভাবে নিশ্চিত করা, অগ্নিকাণ্ডের আগাম সতর্কতার জন্য অটো ফায়ার ডিটেকশন ও ফায়ার অ্যালার্মের বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা, দাহ্য পদার্থগুলো কোনোভাবেই বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনে রাখার অনুমতি না দেওয়া এবং কোনো ব্যতিক্রম ঘটলে আর্থিক জরিমানাসহ কঠোর শাস্তির ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা, বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে আন্ত সংযোগ ও জরুরি অবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর সহযোগিতাসহ সব পর্যায়ে পিরিয়ডিক মনিটরিং নিশ্চিত করা, গ্যাস সঞ্চালন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ সংযোগকারী ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান, ওয়াসাসহ সব সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আন্ত সহযোগিতাসহ মাঠ পর্যায়ে কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, অগ্নিকাণ্ডসংক্রান্ত সম্যক বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য, প্রশিক্ষণ ও কার্যকর করণীয় বিষয়ের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা, বাণিজ্যিক, ব্যাবসায়িক ও আবাসিক ভবনের অগ্নিকাণ্ডজনিত বীমা বাধ্যতামূলক করা নিশ্চিতকরণ, নিয়মিত ফায়ার ড্রিল ও অনুশীলনের মাধ্যমে সব পর্যায়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা ও কর্তব্যবোধ সৃষ্টি করা, সিটি করপোরেশনকে অবশ্যই নগর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পর্যাপ্ত খোলা জায়গা, জলাধার ও সুপরিসর যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, নগরজীবনে টেকসই ও অগ্নিসহনীয় নির্মাণ কার্যক্রম নিশ্চিত করা, টিনশেড ও কাঁচা দোকানপাট মাস্টার প্ল্যানের মাধ্যমে পরিকল্পিত বহুতল ভবনে রূপান্তরিত করা, সর্বোপরি সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি নিরসনকে নিশ্চিত করার মাধ্যমে জনগোষ্ঠী, সম্পদ ও ভবনগুলো নিরাপদ করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

 

লেখক: ড. খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন – অধ্যাপক ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপ-উপাচার্য বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস।

 


সর্বশেষ - রাজনীতি