1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ধর্ম নিরপেক্ষতা 

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
সোমবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২২

করোনা ভাইরাস সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পরে মহামারিতত্ত্ববিদ, পরিবেশবিদ, ও বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে, ‘করোনা ভাইরাস হচ্ছে প্রকৃতির অভিশাপ। মানুষ যেভাবে প্রকৃতি দূষণ, পাহাড়-পর্বত, বনাঞ্চল, ও নদীনালা ধ্বংস করেছে, তারই অনিবার্য ফলাফল হচ্ছে ভয়ংকর এই মহামারি।’

সারা বিশ্বের সচেতন মানুষ, বিশেষ করে সরকারগুলো যদি ক্লাইমেট চেঞ্জ বা আবহাওয়া পরিবর্তনের বিষয়ে দ্রুততার সঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করেন, তাহলে এখন থেকে প্রতি ৫ বা ১০ বছর পর পর মহামারির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিষেশজ্ঞরা। করোনা মহামারিতে সারা বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই শিক্ষা-স্বাস্থ্য, ও অর্থনীতির প্রভূত ক্ষতি হয়েছে। অনেক দেশে করোনা উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পালা বদল হয়েছে, অনেক দেশেই এখন মুখোমুখি হচ্ছে নতুন সংকটের।

কভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার সময়ে অনেকেই ভেবেছিলেন, এবার লোভী, লুণ্ঠনকারী, অত্যাচারী, জালেম ও অন্যায়কারীরা হয় ধ্বংস হবে, নইলে সংযত বা পরিশুদ্ধ হবে। কিন্তু পরিসংখ্যান, ও তথ্য-উপাত্ত বলছে, করোনার মধ্যেও কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে, দরিদ্র হত দরিদ্র হয়েছে, ক্ষমতাশালীদের ক্ষমতার দেমাগ, ও দৌরাত্ম্য আরও বেড়েছে, এবং টেক-জায়ান্টরা হয়েছে মিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মালিক।

বৈশ্বিক চিত্রটি হতাশাব্যঞ্জকই নয়, রীতিমতো নৈরাজ্যকর। করোনা ভাইরাসের প্রকোপ শেষ না হতেই দক্ষিণ চীন সাগরে প্রভাব বিস্তার করা নিয়ে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বড় ধরনের মহড়া ও পাল্টা মহড়া দেখা গেল। তাইওয়ান ও চীন, ভারত-চীনের মধ্যেও সীমান্ত নিয়ে উত্তাপ ছড়াল। সর্বশেষ রাশিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ল ইউক্রেনের ওপর। রক্ত-লাশ, ধ্বংসস্তূপ ও প্রাণভয়ে পালানো লাখ লাখ মানুষের কাফেলা! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপ এত বড় সংকটের মুখে পড়েনি।

করোনা মহামারির কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতি-শিক্ষা, স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থানসহ প্রান্তিক মানুষের অবস্থানের যে ক্ষতি হয়েছে, তাতে করে প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের সরকারের কাছে দায়িত্বশীল ও সংযত আচরণ কাম্য ছিল। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়াসহ বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর কাছে প্রত্যাশা ছিল, তারা প্রভাববলয় বিস্তারের রাজনীতি, সমরাস্ত্র উৎপাদন ইত্যাদি থেকে সাময়িকভাবে হলেও বিরত থাকবেন এবং ভবিষ্যৎ মহামারি প্রতিরোধ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে- ভালো মানুষের ‘আইডিয়ালিস্টিক’ চিন্তাভাবনা, ও মঙ্গলকামনা দিয়ে পৃথিবী চলে না। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে স্প্যানিশ ফ্লুতে ৫ কোটি মানুষ মারা যাওয়ার পরে শুরু হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ওই যুদ্ধেও মৃত্যু হয়েছিল ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষের।

একটি মহামারি শেষ হতে না হতেই, সারা বিশ্বে যে হিংস্রতা ও যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে শুভবুদ্ধির মানুষের হতাশা বাড়ছে। যুদ্ধের প্রভাবে তেল ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন দেশে সাধারণ মানুষের কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তাতে লোভী ব্যবসায়ী, বহুজাতিক কোম্পানি, কালোবাজারি ও জবাবদিহিহীন সরকারকারগুলোর কী আসে যায়? দশক ধরেই বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র সংকুচিত হচ্ছে। বর্ণবাদ, জঙ্গিবাদ, অভিভাসনবিরোধী মনোভাব জনপ্রিয় হচ্ছে।

এশিয়া, আফ্রিকা, ও ল্যাটিন আমেরিকার কলোনি থেকে সম্পদ লুট করে যে ইউরোপ ধনী ও সম্পদশালী হয়েছে, তাদের ‘এনলাইটেনমেন্ট’ ও ‘রেনেসাঁ’র হাত ধরে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে উন্নতি হয়েছে, মানবাধিকার নতুন উচ্চতায় উঠেছে, উদার দৃষ্টিভঙ্গী নতুন মাত্রা পেয়েছে, তাদেরও গত কয়েক দশক ধরে রক্ষণশীল হতে দেখা যাচ্ছে। সারা বিশ্বেই কি তাহলে আলো নিভে অন্ধকার নামছে?

মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের কথা। অন্তর্মুখী, ক্ষতবিক্ষত এই কবি লিখেছিলেন –

“অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,/ যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;/ যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই–প্রীতি নেই– করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।/ যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি…/ শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।”

এ কবিতায় জীবনানন্দ যে অন্ধকারের কথা বলেছেন, সেই অন্ধকার তো কালে কালে নতুন চেহারা, নতুন মাত্রা, নতুন ভয়াবহতা নিয়ে হাজির হয়েছে, হচ্ছে, এবং হবে। বিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশকেই কি তিনি বাংলাদেশের একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের অন্ধকারকে দেখতে পেয়েছিলেন?

নইলে একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পঞ্চাশতম বার্ষিকীতে এসে বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে বিজ্ঞান পড়ানোর জন্য জেলে যেতে হবে কেন? এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে! হৃদয় মণ্ডল তো যথার্থই বলেছেন যে, ধর্মের ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস এবং বিজ্ঞানের ভিত্তি হচ্ছে যুক্তি এবং ক্লিনিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট। ধর্ম এবং বিজ্ঞানকে যে সমাজ মুখোমুখি দাঁড় করাতে চায়, সে সমাজ কী করে এগিয়ে যাবে? ধর্ম এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যারা বলে সাংঘর্ষিক, তারা কী করে বাংলাদেশি বাঙালি বলে দাবি করেন?

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী নতুন কৌশলে তাদের অপতৎপরতা শুরু করেছে। তারা টিএসসির অসাম্প্রদায়িক, উদার ও প্রগতিশীল ঐতিহ্য ভেঙে দিতে চায়। ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের টিএসসি হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বাংলাদেশের সব ধর্ম-বর্ণ ও গোত্রের মানুষের মিলনকেন্দ্র এবং সংস্কৃতিচর্চা, মুক্ত আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের মূল কেন্দ্র। এখানে সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর চেষ্টায় আমাকে শঙ্কিত ও উৎকণ্ঠিত করেছে। সারা বাংলাদেশ ধর্ম-বর্ণ ও রাজনৈতিক হানাহানির বিভেদ ও অন্ধকারে ডুবে গেলেও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখনও তার উদার, অসাম্প্রদায়িক ও জ্ঞান-বিজ্ঞানবান্ধব পরিবেশটির ন্যূনতম মানটি ধরে রেখেছে।

আমি বলছি না যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সমস্যা নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী-শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের আবাসন সংকট আছে। শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। আছে রাজনীতি ও মতবাদকেন্দ্রীক বাহাস, পরচর্চা ও চরিত্র হনন। ব্যক্তিপর্যায়ে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা আগে ছিল, এখনও আছে। তবে রাজনৈতিক ও আদর্শিক নানা বিরোধ ও হানাহানি সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশটি ছিল উদার, অসাম্প্রদায়িক ও তর্ক-বিতর্ক বান্ধব; যেটি যে কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠার পূর্বশর্ত। কিন্তু নানা ধর্ম-বর্ণ, ও মতবাদের অন্ধরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল চেতনাটিকেই ধসিয়ে দিতে চাইছে।

ধর্মান্ধরা বুঝতে চাইছে না যে, বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ধর্ম-বর্ণ বা মতাদর্শ অন্ধভাবে অনুসরণ বা চর্চার জায়গা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে মতাদর্শ, দর্শন, ও ধর্ম নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা ও ক্লিনিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা, সর্বজনীন মূল্যবোধ ও মুক্তচিন্তার সারবস্তু না বুঝে মতাদর্শ-অন্ধ এবং বিজ্ঞান ও দর্শনবিমুখ ধর্মান্ধরা যদি বিশ্বদ্যিালয়ে চলে আসে, তাহলে এখনও পাবলিক বা জন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যতটা বিশ্ববিদ্যালয় পদবাচ্য আছে, সেটি আর থাকবে না।

ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার ব্রিটিশ আমলে হয়েছে, পাকিস্তান আমলেও হয়েছে। সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্র ও তার শাসকদের বিরুদ্ধে ৪/৫ বছরের মধ্যেই রুখে দাঁড়ালেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (তখন তিনি তরুণ নেতা), মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ প্রমুখ। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরে যেমন বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন যে পাকিস্তান রাষ্ট্র টিকবে না, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরে তিনি সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করলেন এবং গন্তব্য ঠিক করে ফেললেন যে, পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

বঙ্গবন্ধু তার অতুলনীয় সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং সন্মোহনী ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্ব দিয়ে সব ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গের মানুষকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করলেন। বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় চার নীতির মধ্যে স্থান পেল ধর্মনিরপেক্ষতা। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নীতি হিসেবেই নয়, ধর্মনিরপেক্ষ নীতির প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই মদিনা নগর রাষ্ট্রে মহানবী হজরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.) কর্তৃকও। রাসুসুল্লাহ (সা.) রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে তার নীতি নির্ধারণ করতেন। নানা ঘটনায় আমরা তাঁর বিচক্ষণতা, অন্তর্দৃষ্টি ও বাস্তবতা বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরিপক্বতার নজির পাই। কিন্তু ধর্মান্ধরা কি রাসুলের (সা.) ‘সেক্যুলার প্রাকটিসে’র নজিরগুলো আমলে নেবেন এবং অনুসরণ করবেন?

লেখক : শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন – অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ - রাজনীতি