1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

উন্নয়নের বিপরীতে চেতনাগত অবদমনের ভয়ঙ্কর চিত্রটি কি দেখতে পাচ্ছি?

বিভুরঞ্জন সরকার : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ৭ এপ্রিল, ২০২২

পর পর কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে, যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক তোলপাড় হলেও আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে সেরকম কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

তিনটি ঘটনার মধ্যে টিপ পরার কারণে একজন কলেজশিক্ষককে হেনস্তা করার বিষয়টি নিয়ে অনেকেই সরব হওয়ায় অভিযুক্ত পুলিশ কনস্টেবল নাজমুল তারেককে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়েছে। এটা মানুষের ক্ষোভ প্রশমনের জন্য আইওয়াশ কি না তা সহসাই স্পষ্ট হবে। কি প্রক্রিয়ায় তার পুলিশে চাকরি হয়েছে, নিয়োগের আগে তার সম্পর্কে, রাজনৈতিক কানেকশন সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছিল কি না, চাকরি পাওয়ার পর তার ভূমিকা ইত্যাদি কি জিজ্ঞাসাবাদে জানার চেষ্টা করা হবে?

একজন নারীকে তার পছন্দের একটি সাজ গ্রহণের জন্য যে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হলো– এই বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। এই ঘটনা, রাষ্ট্র, সরকার, পুলিশ বাহিনী সবার ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাই অভিযুক্ত ব্যক্তি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এড়াতে সক্ষম হলে এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা ভবিষ্যতেও ঘটবে। অপরাধ সংঘটনের জন্য শাস্তি পেতে হয়– এই ধারণাটি এখন মানুষের মধ্যে সেভাবে নেই। তাই সমাজে যথেচ্ছাচার বাড়ছে।

টিপ বিড়ম্বনার আগের আরও দুটি ঘটনার কথা প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয়। এর একটি বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় বণিকের ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া আর অন্যটি সড়ক দুর্ঘটনায় নর্থ সাউথের ছাত্রী আয়শা মমতাজ মীমের করুণ মৃত্যু।

বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় বণিক কীভাবে ধর্মের অবমাননা করেছিলেন? এ ব্যাপারে আমার কাছে যে তথ্য আছে তা এই রকম :
মুন্সিগঞ্জ সদরের বিনোদপুর রামকানাই উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় বণিক দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞানের ক্লাস নেওয়ার সময় ছাত্ররা দাবি করলো, “বিজ্ঞান কোরআন থেকে উৎপত্তি হয়েছে আর সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানী হলেন ইসলাম ধর্মানুসারে মহানবি হজরত মুহাম্মদ।” হৃদয় বণিক ধর্ম আর বিজ্ঞানের পার্থক্য উল্লেখ করে বললেন, “ধর্ম হলো বিশ্বাস আর বিজ্ঞান প্রমাণিত বিষয়৷ আর বর্তমান যুগের ৯০ শতাংশ বিজ্ঞানী ইহুদি, খ্রিস্টান। তারা তো কোরআন পড়েন না।”

শিক্ষকের এই কথায় বাচ্চা ছেলেগুলোর ধর্মানুভূতি জাগ্রত হয়ে উঠলো। তারা গোপনে স্যারের বক্তব্য রেকর্ড করে প্রধান শিক্ষককে তার বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম আর মহানবীর অবমাননার অভিযোগ তুলে শাস্তির দাবি করলো। প্রধান শিক্ষক হৃদয় বণিককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে তিনদিনের মধ্যে জবাব চাইবেন বলে ছাত্রদের শান্ত করার উদ্যোগ নিলেন।
কিন্তু ছাত্ররা তা মানলো না। হৃদয় বণিকের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করলো। বাইরের লোকজনও জড়ো হয়ে গেলো আর স্লোগান উঠলো:

“ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই
মালাউনের ফাঁসি চাই।”
“মালাউনের দুই গালে
জুতা মারো তালে তালে।”

খবর নিয়ে জেনেছি, হৃদয় বণিক ভালো গণিত পড়াতেন৷ তার বাড়ি স্কুল থেকে অনেকটা দূরে সিরাজদিখানের কুচিয়ামোড়া এলাকায়৷ অন্য শিক্ষকরাও তার প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিলেন৷ মৌলবাদীরাও জানতেন তিনি প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ৷ তাই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবেই হয়তো ওই শিক্ষককে বিপদে ফেলা হয়েছে৷

ভাবা যায়, কি অবস্থা তৈরি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের? বিজ্ঞান পড়াতে গিয়ে একজন বিজ্ঞান শিক্ষককে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মন জুগিয়ে পাঠদান করতে হবে? কারা ওদের মস্তিষ্কে এই ধারণা গেঁথে দিয়েছে যে কোরআনই বিজ্ঞান? এটা বিশ্বাস না করলে ধর্ম অপমানের অভিযোগে জেলে যেতে হবে? পরিস্থিতি কারা, কখন, কীভাবে সৃষ্টি করলো?

কেবল কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ পালন কিংবা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করে কি আর জাতির পিতা কিংবা স্বাধীনতার চেতনা ফিরে পাবো আমরা? আমাদের ওই লালিত চেতনা চুরি হয়ে গেছে, লুট হয়ে গেছে। যে পাকিস্তানি ভাবাদর্শকে পরাস্ত করেছিলেন জাতির পিতা, এনেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদ, তা আজ হারিয়ে গেছে নব্য পাকিস্তানি ধর্মান্ধ ভাবাদর্শের কাছে।

হাজার হাজার কোটি টাকার চোখ ধাঁধানো অবকাঠামোগত উন্নয়নের তলায় চরম মানবিক অধঃপতন, শিক্ষাগত আর চেতনাগত অবদমনের ভয়ঙ্কর চিত্রটি কি আমরা দেখতে পাচ্ছি?

বিএনপিজামায়াতের কাছে মুক্তচিন্তা কিংবা অসাম্প্রদায়িক উদার রাজনীতির পক্ষে অবস্থান প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ কিংবা প্রগতির ধ্বজাধারী বামপন্থিরা কেউই কি পরিস্থিতি বুঝতে পারছে না? জাতির বিবেকের দায়িত্ব পালনের কথা যাদের সেই বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী, সাহিত্যিকদেরও বুঝি এসব নিয়ে কোনো দায় নেই।

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর উত্থান নিয়ে কথা বললে কেউ কেউ আবার সবক দেন, কেন, ভারতে হিন্দুত্ববাদের বাড়াবাড়ি দেখেন না। ওখানে মোদী শাসনে মুসলমানেরা যে নিগৃহীত হতে হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে? তার মানে ভারতে মুসলিমদের ওপর অত্যাচার হলে তার বদলা নেওয়া হবে বাংলাদেশে হিন্দুদের বা সংখ্যালঘুদের ওপর?

হায়রে মানুষের যুক্তিবোধ! হায়রে রাজনীতি!!

এবার আসা যাক তৃতীয় ঘটনায়। রাজধানীর খিলক্ষেতে উড়ালসড়কে গত ১ এপ্রিল শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাইশা মমতাজ মীম। তিনি ইংরেজি বিভাগের ষষ্ঠ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ছিলেন। ছুটির দিনে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে উত্তরার বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাচ্ছিলেন।

খিলক্ষেত উড়ালসড়ক দিয়ে ৩০০ ফুট যাওয়ার পথের ঢালে তিনি দুর্ঘটনার শিকার হন। যে গাড়ি মীমকে ধাক্কা দিয়েছে সেই গাড়িচালক সাইফুল ইসলাম ও তার সঙ্গে থাকা মশিউরকে আটক করা হয়েছে। সাইফুলের হালকা যান চালানোর লাইসেন্স ছিল। কিন্তু তিনি চালাচ্ছিলেন ভারী গাড়ি। মশিউর হলেন গাড়িতে থাকা মালামালের মালিকপক্ষের প্রতিনিধি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে চালক জানিয়েছেন, স্কুটির পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তিনি হর্ন দেন। এতে স্কুটিচালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তার গাড়ির সামনের চাকার নিচে পড়েন। এরপর তিনি পালিয়ে যান।

পড়াশোনার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচারে পরামর্শদাতা একটি প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন কাজ করতেন মাইশা। প্রায় ৯ মাস ধরে তিনি সেখানে কাজ করছিলেন। লেখাপড়ার ক্ষতি হওয়ায় অতিসম্প্রতি কাজটি তিনি ছেড়ে দেন। মীমের বাবা একজন শিক্ষক। বাবা-মা যখন তাদের আদরের মেয়েকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ, তখন একশ্রেণির বর্বর ফেসবুকে মীমের পোশাক নিয়ে ঠাট্টা, বিদ্রুপ করতে ছাড়েনি। ছেলেদের পোশাক পরে স্কুটি চালিয়ে সে গর্হিত কাজ করেছে। তার মৃত্যু নাকি ঠিক কাজ হয়েছে।

আমরা মুক্তিযুদ্ধর সময় কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? আমরা চেয়েছিলাম স্বাধিকার স্বাধীনতা আর সাংস্কৃতিক মুক্তি। জিন্নাহ বলেছিলেন, উর্দু হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। আমরা প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলন করেছি। পাকিরা দেশে নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিল রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্র সঙ্গীত। প্রতিবাদে আমরা করেছি সাংস্কৃতিক আন্দোলন। পাকিস্তান জিন্দাবাদ হয়েছে জয় বাংলা। ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ বদলে হয়েছে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। রেডিও পাকিস্তান হয়েছে বাংলাদেশ বেতার।

সশস্ত্র সংগ্রাম, জনযুদ্ধ হয়েছিল ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে আর এতে অংশীদার হয় মুসলিম, হিন্দু , বৌদ্ধ, খ্রিস্টান অনেক নারী-পুরুষ , এরা প্রাণ দিয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, হতাহত হয়েছেন । তাই আমরা বলি: দাম দিয়ে কিনেছি এ বাংলা।

এখন ইতিহাসের জীবাশ্ম থেকে মাঝে মাঝে সেই পাকিস্তানি ভূত এসে আমাদের উল্টো পথে ঠেছে, আমাদের অনেকে এতে বিভ্রান্ত হচ্ছে। এই পাকিভূতদের প্রতিরোধ করতে না পারলে আমাদের এত রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার চেতনাকে রক্ষা করা যাবে না।

একাত্তরে আমরা ভৌগোলিক স্বাধীনতা পেলেও আমাদের সবার বুদ্ধির মুক্তি আর চিন্তার মুক্তি হয়নি। কারণ এগুলো অব্যাহত চর্চার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। স্বাধীনতার পর আমরা ধরে নিয়েছিলাম, যেহেতু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর পরাজয় হয়েছে সেহেতু পাকিস্তানি ধ্যানধারণা, প্রতিক্রিয়াশীল, পশ্চাৎপদ চিন্তাধারারও বুঝি পরাজয় ঘটেছে। কিন্তু আমরা তখন এটা উপলব্ধিতে নেইনি যে, দৃশ্যমান শাসকগোষ্ঠীকে যুদ্ধ করে পরাজিত করা সহজ হলেও ভেতরে থাকা, দীর্ঘদিন লালন করা চিন্তাধারা সশস্ত্র লড়াইয়ে পরাভূত হয় না। চিন্তার জড়তা থেকে মুক্তির জন্য শিক্ষা-সংস্কৃতির মশাল হাতে এগিয়ে যেতে হয়।

হৃদয় বণিকের যে ছাত্রগুলো স্লোগান দিয়েছে “মালাউনের দুই গালে জুতা মারো তালে তালে” তারাই বড় হয়ে পুলিশ হবে, প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কেউ হবে। যে মানুষেরা মীমের ছবির নিচে মন্তব্য করেছে, ‘এরকম বেপর্দা মেয়ের মরে যাওয়া ভালো’, তাদের মধ্যেই হয়তো কেউ প্রশাসনে আছে, পুলিশে আছে।
সেজন্যই আমাদের এখন সবার আগে দরকার শিক্ষা আর সংস্কৃতির ক্ষেত্রে জাগরণ, নতুন চিন্তা আর দিকদর্শন। মুক্তিযুদ্ধের ভূলুণ্ঠিত মূল্যবোধ তথা চেতনায় ফিরিয়ে আনতে জোড়াতালির শিক্ষার খোলনলচে বদলে বাঙালির জাতীয় চেতনার সঠিক ইতিহাস আর সাংস্কৃতিক পরিচয় নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার কোনো বিকল্প নেই।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক মুক্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছলেও সাংস্কৃতিক, মানসিক আর বৌদ্ধিক মুক্তি থেকে এখনো দূরেই আছি। এই দূরত্ব ঘোচাতে হবে।

লেখক : বিভুরঞ্জন সরকার – জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।


সর্বশেষ - রাজনীতি