1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

সরকারের পুনঃখনন প্রকল্প বৃহত্তর রংপুরে পরিবেশের উন্নয়ন ঘটিয়েছে

রংপুর জেলা প্রতিনিধি : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ৭ এপ্রিল, ২০২২

বিলুপ্ত নদী, খাল, বিল এবং পুকুর পুনঃখনন বৃহত্তর রংপুর জেলায় হারিয়ে যাওয়া বাস্তুতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত করার ফলে পরিবেশের ব্যাপক উন্নতি এবং আকর্ষণীয় ও নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়েছে।পুনঃখননকৃত জলাধারগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে সঞ্চিত বৃষ্টির পানি ভূগর্ভস্থ পানিস্তরের উত্থানে এবং ভূ-পৃষ্ঠের পানি সংরক্ষণ এবং কৃষি ও গৃহস্থালীর কাজে এর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করায় অবদান রাখছে।সরকারের পাঁচ বছর (২০১৯-২০২৪) মেয়াদি ”ভূ-উপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে বৃহত্তর রংপুর জেলায় সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্প (ইআইআরপি)’ বাস্তবায়নের ফলে এসব পরিবর্তন অর্জন সম্ভব হয়েছে।

প্রকল্পটির বাস্তবায়নের ফলে প্রকল্প এলাকার হাজার হাজার গ্রামীণ মানুষ কৃষি, মৎস্য চাষ, বৃক্ষরোপণ, শাক-সব্জি, কলা ও গবাদি পশুর জন্য ঘাস চাষ এবং হাঁস পালনের মাধ্যমে জীবিকার উন্নতির বহুমাত্রিক সুবিধা ভোগ করছেন।পুনঃখনন করা বিল ও পুকুরের পুরো জলাভূমি এখন বিভিন্ন স্থানীয় ও অতিথি পাখির শ্রুতিমধুর কিচিরমিচির কলতান এবং তীরে রোপনকৃত হারিয়ে যাওয়া বিরল প্রজাতির বাড়ন্ত গাছপালা দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে।কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) ২৫০ দশমিক ৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বৃহত্তর রংপুরের রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও গাইবান্ধা জেলার ৩৫টি উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।

বাসস’র সাথে আলাপকালে ইআইআরপির প্রকল্প পরিচালক এবং বিএমডিএ-র রংপুর সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান খান বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে হাজার হাজার মানুষ বহুমাত্রিক সুবিধা ভোগ করতে শুরু করেছেন।ভূ-পৃষ্ঠে সংরক্ষিত বৃষ্টির পানির সর্বোত্তম ব্যবহার, বনায়ন এবং পরিবেশ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের উন্নতি এবং স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখিদের অভয়ারণ্য পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।প্রকৌশলী খান বলেন, ‘প্রকল্পের আওতায় বিলুপ্ত নদী, খাল, বিল ও পুকুর পুনঃখনন, লো-লিফট পাম্প (এলএলপি) স্থাপন, সৌরবিদ্যুৎচালিত পাতকুয়া খনন এবং ফুট ওভার ব্রিজ ও ক্রস ড্যাম নির্মাণ এবং বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে।’জলাশয়গুলি পুনঃখননের ফলে সেখানে পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপশি বৃষ্টি ও বন্যার পানি দ্রুত নিষ্কাশনের কারণে জলাবদ্ধ জমিগুলি কৃষির উপযোগী এবং সঞ্চিত বৃষ্টির পানি শস্যক্ষেতে সম্পুরক সেচ প্রদান, হাঁস পালন, মাছ চাষ এবং গৃহস্থালী কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে।

কৃষকরা ভূগর্ভস্থ পানির উপর তাদের নির্ভরতা কমিয়ে পুনঃখনন করা জলাশয়ে সংরক্ষিত ভূ-পৃষ্ঠের পানি ব্যবহার করে ফসলি জমিতে সম্পূরক সেচ প্রদান করছেন। এতে কম খরচে অধিক ফসল ফলিয়ে তারা বেশি লাভবান হচ্ছেন।প্রকল্পটির আওতায় ২৩০ কিলোমিটার খাল, ১১টি বিল এবং ১১৮টি পুকুর পুনঃখনন, ৩০টি সৌরবিদ্যুৎচালিত এলএলপি, ১০০টি বিদ্যুৎ চালিত এলএলপি, ৫০টি সৌরবিদ্যুৎচালিত পাতকুয়া খনন এবং ২ লাখ ৩০ হাজার বনজ, ফলদ এবং ঔষধি গাছের গাছের চারা রোপণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সঞ্চিত ভূ-পৃষ্ঠের পানি ব্যবহার করে ১০ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে সেচ নিশ্চিতকরণ এবং ৩৫০ হেক্টর জমি জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হবে এবং কৃষকরা প্রতিবছর ১৬৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা মূল্যের ৮৩ হাজার ৪শ’ টন অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন করতে সক্ষম হবেন।

এছাড়াও, প্রকল্পটি ফসলের জমিতে সেচের জন্য নবায়নযোগ্য সৌরশক্তি ব্যবহার করার সুবিধা সৃষ্টির পাশাপাশি খননকৃত-কূপের পানি ব্যবহার করে সেচের পানি কম প্রয়োজন হয় এমন ফসলের চাষ বৃদ্ধি এবং বন সম্পদ বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে।প্রকল্প এলাকার পাঁচটি উপজেলায় এ পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার খাল, দু’টি বিল ও ১৫টি পুকুর পুনঃখনন, ১৪টি সৌরবিদ্যুৎচালিত এলএলপি, ১৮টি বিদ্যুৎচালিত এলএলপি, ১৪টি সৌরবিদ্যুৎচালিত পাতকুয়া খনন এবং ৮০ হাজার চারা রোপণ সম্পন্ন হয়েছে। বাসস’র সাথে আলাপকালে স্থানীয় গ্রামবাসী ও জনপ্রতিনিধিরা গভীর সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, তারা তিন থেকে চার দশক পর আবার বিলুপ্ত জলাশয়ে হারিয়ে যাওয়া বাস্তুতন্ত্র এবং নতুন পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের পুনরুজ্জীবনের সাক্ষী হচ্ছেন। বিলুপ্ত জলাশয়গুলির পুনঃখনন স্থানীয় মানুষের জন্য সেচ, হাঁস পালন, মাছ চাষ এবং গৃহস্থালীর কাজকর্মের জন্য ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহার করার পাশাপাশি তীরে বনায়ন এবং শাক-সজ্বি, কলা ও নেপিয়ার ঘাস চাষের যথেষ্ট সুযোগ তৈরি করেছে।

রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার শংকরপুর গ্রামের কৃষক মশিউর রহমান জানান, বিলুপ্তপ্রায় মরা তিস্তা নদীর ১২ কিলোমিটার অংশ পুনঃখননের ফলে নদীটিতে পানির প্রবাহ পুনরুজ্জীবিত হওয়ায় বৃষ্টি ও বন্যার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতির ফলে বিস্তীর্ণ এলাকা জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়েছে।তিনি বলেন, ‘পুনঃখনন করা নদীটি গত বছর বৃষ্টির পানি দ্রুত যমুনেশ্বরী নদীতে বয়ে নিয়ে যায় এবং আমার ২ দশমিক ৬২ হেক্টর জমি জলাবদ্ধতামুক্ত হলে আমি গত তিন দশকের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো উক্ত জমিতে আমন ধান চাষ করতে সক্ষম হই।’কালুপাড়া ইউনিয়নের কামারপাড়া গ্রামের গৃহবধূ মমিনা বেগম ও ঝাড়পাড়া গ্রামের হোসনা বেগম জানান, বিলুপ্ত মরা তিস্তা নদী পুনঃখননের ফলে তারা পাড়গুলোতে শাকসব্জি চাষ ও হাঁস পালন করে জীবন-জীবিকার উন্নয়ন করতে পারছেন।

একই উপজেলার কাজীপাড়া গ্রামের কৃষক গোলাম মর্তুজা জানান, বর্ষাকালেও তার দেড় হেক্টর জমি জলাবদ্ধতামুক্ত হয়ে আবার চাষাবাদের উপযোগী হবে তা তিনি কখনোই ভাবেননি।তিনি বলেন, ‘বিলুপ্তপ্রায় ঘিরনই নদীর ১০ কিলোমিটার অংশ পুনঃখননের ফলে আমার জমি জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়েছে। তিন দশক পর অন্যান্য কৃষকদের মতো এখন আমিও প্রতি বছর উক্ত জমিতে আমন ধানসহ তিনটি ফসল চাষ করছি।’পার্শ্ববর্তী কুঠিপাড়া গ্রামের মো. হামিম ও মো. তুহিন জানান, তারা এখন মাছ ধরছেন পুনঃখনন করা ঘিরনই নদীতে যার পাড়ে গাছের চারা রোপণের ফলে প্রকৃতি সবুজ হয়ে উঠেছে।

এদিকে, রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলায় ১১.৫৯ একর ভারারদহ বিল পুনঃখননের পর ১০০ ফুট প্রশস্ত তীরে ১০৩ প্রকার বিরল প্রজাতির বনজ, ফলদ, ঔষধি ও ফুল গাছের চারা রোপণের ফলে এক নৈসর্গিক নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়েছে।পাশের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের হাফিজুর রহমান বলেন, ‘পুরো ভারারদহ বিল এলাকা হাজার হাজার অতিথি পাখির কিচিরমিচির কলতান এবং ডানা মেলে আকাশে-বাতাসে তাদের অবাধ বিচরণ সবার মনকে আকৃষ্ট করছে।’প্রচুর পরিমাণে ক্রমবর্ধমান জলজ উদ্ভিদ এবং প্রাণীর সমাহারে বিলটি পুনরুজ্জীবিত বাস্তুতন্ত্রে পাখিদের জন্য একটি অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে এবং অনেক মানুষ সবুজ প্রকৃতির অপরূপ রূপ এবং প্রস্ফুটিত ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে সেখানে ছুটে আসছেন।

কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার বেরুবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মোতালেব বলেন, বিএমডিএ এ পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ বোয়ালেরদারা খালের আট কিলোমিটার অংশ পুনঃখনন করার ফলে এলাকার ২৫টি গ্রামের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ উপকৃত হয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘খালটি পুনঃখননের পাশাপাশি পাড়ে গাছের চারা রোপণের ফলে পরিবেশের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। স্থানীয় জনগণ ফসলের ক্ষেতে সম্পূরক সেচ, হাঁস পালন, মাছ চাষ এবং গৃহস্থালীর কাজে সেখানে সংরক্ষিত পানি ব্যবহার করছেন।’পার্শ্ববর্তী চর বেরুবাড়ি গ্রামের কৃষক আব্দুল হালিম জানান, খালটি পুনঃখননের ফলে তার ছয় বিঘা জমি জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেয়েছে এবং চার দশক পর সেখানে বছরে তিনটি ফসল চাষের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার চতরা ইউনিয়নের বড় বদনাপাড়া গ্রামের কৃষক কায়কোবাদ মন্ডল জানান, ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ চতরা খালের আট কিলোমিটার অংশ পুনঃখননের ফলে ওই এলাকার ৯০০ হেক্টর জমি জলাবদ্ধতা মুক্ত হয়ে পুনরায় আবাদযোগ্য হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বিগত ৩০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো জলাবদ্ধতা মুক্ত হওয়ায় আমি আমার পাঁচ বিঘা জমিতে গত বছর প্রথমবারের মত আমন ধান চাষ করতে পেরেছিলাম। খালটি পুনঃখননের ফলে ১২টি গ্রামের প্রায় ১৯ হাজার মানুষ উপকৃত হয়েছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ভগবানপুর গ্রামের কৃষক বাদশা মিয়া জানান, ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ শালমারা খালের আট কিলোমিটার অংশ পুনঃখননের ফলে তার তিন একর জমি জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়েছে। তিনি উক্ত জমিতে এখন প্রতিবছর আমন ধানসহ তিনটি ফসল চাষ করতে পারছেন।

একই উপজেলার ভাংনী ইউনিয়নের বেতগাড়া গ্রামের গৃহহীন গৃহবধূ নুর সালমা জানান, ১০ দশমিক ৯৪ একর আয়তনের ষষ্ঠীছড়া বিল পুনঃখননের পাশাপাশি এর পাড় জুড়ে গাছের চারা রোপণের ফলে সেখানে বাস্ততন্ত্রের পরিবর্তন ঘটায় স্থানীয় শত শত মানুষ উপকৃত হচ্ছেন।
বিল পুনঃখননের জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে সালমা বলেন, ‘স্থানীয় মানুষেরা বিলের সঞ্চিত পানি সেচ ও গৃহস্থালির কাজে ব্যবহারের পাশষাপাশি গবাদি পশুকে খাওয়ানোর জন্য তীরে নেপিয়ার ঘাস চাষ, হাঁস পালন এবং পানিতে গোসল করছেন।’


সর্বশেষ - রাজনীতি