হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আপস করা হয়েছিল উল্লেখ করে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেছেন, এটা তাদের মস্তবড় ভুল ছিল।
নারায়ণগঞ্জের রিসোর্টকাণ্ডে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবিও জানিয়েছেন তিনি।
এই গোষ্ঠীকে ‘ধর্ম ব্যবসায়ী’ আখ্যা দিয়ে বিচারপতি মানিক বলেন, তাদের শক্তি কখনও বেশি নয়। কঠোর ব্যবস্থা নিলে তারা ‘লেজ গুটিয়ে পালাবে।’
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ৫০তম বার্ষিকীতে শনিবার এক ওয়েবিনারে এসব কথা বলেন তিনি।
১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগর থেকে বাংলাদেশের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করেন। এই ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতে ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়।
নির্মূল কমিটি গত ১৭ বছর ধরে এই দিনটি পালন করছে।
কমিটির আইন সহায়ক কমিটির সভাপতি বিচারপতি মানিক বলেন, ‘ধর্ম ব্যবসায়ীরা আজ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আর এজন্য আমরা অনেকখানি দায়ী।
‘তাদের সঙ্গে আপস করা ছিল আমাদের মস্তবড় ভুল। এটার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এর ফলে দেশ জাতি আজ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালের ৫ মে এই অপশক্তিকে আমরা নির্মূল করে দিতে পারতাম। তারা সেদিন শিয়ালের মতো লেজ গুটিয়ে পালিয়েছিল। তাদের শক্তি আমাদের চেয়ে বেশি না।’
মামুনুলকে কেন গ্রেপ্তার করা হবে না- এই প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘তার মতো এত বড় ভণ্ড আর ধর্মব্যবসায়ী মাদ্রাসার শিশুদের কী শেখাবে। এরা কালো টাকা জমিয়েছে। এদের টাকার উৎস খতিয়ে দেখা হোক।’
ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। তিনি বলেন, ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে আজও প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। এই ব্যর্থতা আমাদের স্বীকার করতে হবে। আমরা যদি স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করি, সেটাও আমাদের ভুল হবে। আমরা বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে পারিনি সাংগঠনিকভাবে। এই ব্যর্থতার দায় আমাদের স্বীকার করে নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত, আমাদের কোথায় কোথায় ভুল ছিল। কেন আমরা পারিনি। সেই জায়গাটাতে আমরা অনেক সময় কথা বলি না।’
ওয়েবিনারে প্রধান বক্তা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের রচয়িতা ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘যারা ধর্মের নামে হত্যা, হামলা, আইনশৃঙ্খলাকে ভেঙে ফেলে, এরা ঘৃণার পাত্রে পরিণত হবে। আমাদের রাষ্ট্রের দর্শন ও সামাজিক ন্যায়বিচার এইগুলোকে আমাদের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে দিতে হবে।’
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ্যবইয়ে সংযুক্ত করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর যে আদর্শের জায়গা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্থাপন করা হয়েছে, সেটা আমাদের ঠিক রাখতে হবে। আমাদের মৌলিক অধিকারগুলো নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের অর্থনৈতিক সামাজিক ন্যায়বিচার নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।’
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘আজকে সরকারকে হেফাজতের অনুমতি নিয়ে কাজ করতে হয়। তারা দেখিয়ে দেয় তাদের শক্তি। সরকার তার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারে না। ব্যাপারটা খুব মজার।’
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন না করার সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘বহু বছর ধরে আমরা এটা পালন করে আসছি। কিন্তু রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন তারা কিন্তু এটা পালন করছেন না। নির্মূল কমিটিকে রাষ্ট্রের সব দায়িত্ব নিতে হলেও সমস্যা হয়ে যায়। সব কিছুর দায়িত্ব আমাদের না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে যারা ছিলেন যারা এখন মন্ত্রী হয়েছেন, নীতি নির্ধারক হয়েছেন। তারাও কিন্তু ১৭ বছর আমাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারাও কিন্তু মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন।’
ইতিহাস বিকৃতি শুধু যে বিএনপি করে তা নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরাও কমবেশি সবাই করি। এইসব প্রশ্নে নীরব থাকার অর্থ এটাই বোঝায়।’
আয়োজক সংগঠন নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তানপন্থীরা বোধগম্য কারণেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মানে না। তারা যখনই সুযোগ পায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের বিরুদ্ধাচরণ করে।’
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, ’৭১-এর গণহত্যা তথা মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক সত্য অস্বীকারকারীদের শাস্তির জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ‘হলোকস্ট ডিনায়াল অ্যাক্ট’-এর মতো আইন করার দাবিও জানান তিনি।
শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি আরমা দত্ত, নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা তুরিন আফরোজ, শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে আসিফ মুনীর তন্ময়ও এ সময় বক্তব্য দেন।