সম্প্রতি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে ঢাকা সফরে এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার আগমনকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে হরতালের নামে অগ্নিসংযোগ, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, উগ্রতা ও ঘৃণা ছড়ানো, এমনকি মাদ্রাসার ছোট শিশুদের বলির পাঁঠা হিসেবে রাজপথে নামায় হেফাজত ও উগ্রবাদীরা। ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে দেশজুড়ে নাশকতায় মগ্ন হয়েছিল এই উগ্রবাদী গোষ্ঠী। চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মসজিদ থেকে আক্রমণ চালানো শুরু করে তারা। ভাঙচুর করে থানায়। পুড়িয়ে দেয় সরকারি অফিস ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ। উলঙ্গ করে মুসলমানিত্ব চেক করেছে মাঠে থাকা সাংবাদিকদের। পুড়িয়ে দিয়েছে মানুষের ঘর-বাড়ি, গ্যাসফিল্ড। মেরে রক্তাক্ত করেছে আবালবৃদ্ধবণিতাকে। দৃশ্যত, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা যে স্টাইলে নাশকতা চালিয়েছে, তার সঙ্গে এদের হামলার কোনো পার্থক্য নেই।
এই দুর্বত্তায়নে প্রকাশ্যে সমর্থন দেওয়া হয়েছে বিএনপি ও জামায়াতের পক্ষ থেকে। ফেসবুক-ইউটিউব ও বিভিন্ন বৈঠকে নিয়মিত উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে তারা। ইসলামকে বিকৃত করে, সরলপ্রাণ মুসলমানদের হুট করে ক্ষেপিয়ে তুলে, একটা কিছু ঘটানোর জন্য মরিয়া হয়ে গেছে এই কুচক্রীরা। বেশ কিছুদিন ধরেই স্বাধীনতাবিরোধী এই চক্রের বহুমুখী অপতৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। তারই একটি অংশ হলো সাম্প্রতিক নাশকতা। নরন্দ্রে মোদী এখানে একটা উছিলা (ইস্যু) মাত্র।
এইসব দুর্বৃত্ত, ভণ্ড ও ধর্মব্যবসায়ীরা বলেছে, মোদী গুজরাটে মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করেছে, তাই তাকে বাংলাদেশে আসতে দেওয়ার প্রতিবাদে তারা এসব করছে। কিন্তু মোদী যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন এরাই আবার নিজেরা যেচে গিয়ে মোদীর সঙ্গে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল এবং ২০১৫ সালে মোদীর বাংলাদেশ সফরের সময় লাইনে দাঁড়িয়ে অনুগত ভৃত্যের মতো মাথা নত করে মোদীর সাথে সাক্ষাৎ করেছিল। তাহলে এবার কোনো তাদের এতো সমস্যা। ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।
তারমানে, এখানে ইসলাম-মুসলিম কোনো ইস্যু নয়। ইসলামে নাশকতা সমর্থন করে না। শিশুদের জোর করে সহিংসতায় নামানো ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলামের কোথাও মানুষের ওপর হামলা, সম্পদ জ্বালানোর কথা বলা হয়নি। ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলামে এসব কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
এমনকি এই দুর্বৃত্তরা যে তারা দাবি করছে, ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কয়েক দশক আগে মোদীর বিভিন্ন বিতর্কিত ভূমিকার জন্য তাকে অভ্যর্থনা জানানোর বিরুদ্ধে তারা; আসলে এসব কোনো ইস্যু নয়। কারণ, মোদী এর আগেও কয়েকবছর আগে বাংলাদেশে এসেছে। তখন এই দুর্বত্তরাও মোদীর সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। এবারের এই নাশকতার মূল ইস্যু হলো, বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকে ব্যর্থ করে দেওয়া, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির আনন্দকে ম্লান করে দেওয়া। এরকম একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক উদযাপনের সময় দেশে নাশকতা ঘটিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা।
কিন্তু স্বাধীনতা দিবসের মতো একটা জাতীয় দিবসে নাশকতায় নামলো কেনো বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতের লোকরা? কারণ, তারা পূর্বপুরুষরা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হয়েছে। তারা সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চায়। তারা সাধারণ মানুষের জীবন-সম্পদ পুড়িয়ে দেয় তাই। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বাংলাদেশ এখন এগিয়ে যাচ্ছে, স্বাবলম্বী দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মানুষ এখন ক্রমেই সচেতন হয়ে উঠছে। তাই এই বদলে যাওয়্ নতুন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ এবং বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর ওপর ওপর তীব্র ক্ষোভ এদের। এরা মূলত বাংলাদেশবিরোধী ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। এরা বাংলাদেশকে আফগানিস্তানের মতো ধ্বংসস্তুপে পরিণত করতে চায়। বিএনপি সরকারের সময় তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রাণান্ত চেষ্টা করে দেশকে আবার মানবিক পথে ফিরিয়ে এনেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের এই ঘুরে দাঁড়ানো তাই জঙ্গিবাদীরা সহ্য করতে পারছে না। এদের সমস্যা আসলে মোদী নয়, এদের মূল সমস্যা গদি। এরা চায়- ঘটনার আকস্মিকতায় সরকারের ওপর হামলে পড়তে। এরা চায়- অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা দখল করে সাধারণ মানুষদের জিম্মি করে নিজেরা বিলাসী জীবনযাপন করতে। এরা চায়- বাংলাদেশেক জঙ্গিরাষ্ট্রে পরিণত করে, সাধারণ মানুষদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে।
বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আগমন আসলে কোনো সমস্যা না। তাই যদি হতো, তাহলে ২০১৪ সালে বিজেপি যখন ভারতে প্রথম ক্ষমতায় এলো, তখনো তাদের এই অবস্থান থাকতো। কিন্তু তখন তারা উল্টো ভূমিকা পালন করেছে। তখন বিএনপি মিষ্টি বিতরণ করেছে বাংলাদেশে। জামায়াত তখন মোদীর সঙ্গে সুম্পর্ক গড়ার জন্য চিঠি লিখেছে, আন্তর্জাতিক লবির মাধ্যমে চেষ্টা চালিয়েছে সুসম্পর্ক গড়ার। কিন্তু তাদের নাশকতাময় ও কলঙ্কজনক অতীত কর্মকাণ্ডের কারণে মোদীর কাছে পাত্তা পায়নি তারা। এসব ঘটনা ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তবুও এরকম কিছু ঘটনার কথা আবারো উল্লেখ না করলেই নয়। ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত যে নিজেদের আখের গোছানোর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে, সেটি আগেও অনেকবার প্রমাণিত হয়েছে।
মোদীর প্রথম বাংলাদেশ সফরে লাইনে দাঁড়িয়ে দেখা করেন খালেদা
নরেন্দ্র মোদী এবারই প্রথম বাংলাদেশে আসেননি। এর আগে, ২০১৫ সালের জুন মাসেও তিনি ঢাকা এসেছিলেন। সেবার তার সঙ্গে লম্বা লাইন দিয়ে দেখা করেছেন বিএনপি নেতারা। স্বয়ং খালেদা জিয়া একান্ত বৈঠক করেছেন মোদীর সঙ্গে। তারপর গণমাধ্যমে হাসি-মুখে দাবি করেছেন, বৈঠক সুন্দর হয়েছে। যদিও কয়কেদিন পরেই ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশ করে যে, সেদিন ঢাকার সোনারগাঁ হোটেলে মূলত বাংলাদেশের সরকারের নামে মোদীর কাছে বিচার দিতে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর, বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে ভ্রমণ করতে গিয়ে, বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার মুখে তার নিজের দেশের বিরুদ্ধে নালিশ শুনে খুবই বিব্রত হয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। এরপর জঙ্গিবাদে পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়ে খালেদা জিয়াকে তিনটি প্রশ্ন করেন তিনি, যেসব প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি খালেদা জিয়া, বরং নীরবে চুপ করে বসেছিলেন। কিন্তু বৈঠক শেষে মিথ্যাচার করেছে বিএনপি।
২০১৫ সালের ৭ জুন বিকালে বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেছিলেন, ‘অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদরি সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।’
এছাড়াও বিএনপি নেতা আ স ম হান্নান শাহ মোদীর সঙ্গে বৈঠকের ব্যাপারে বলেছিলেন, ‘যখন মোদী সাহেবের সঙ্গে আলোচনা শেষে বেগম জিয়া বেরিয়ে আসলেন, উনার মুখে হাসি ছিল। বাকি কথা বললাম না। ১৫ মিনিট একান্ত আলোচনা হয়েছে, সেসব কথা বলার অধিকার আমার নেই। ভারতের জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাকে এই সরকার বাংলাদেশের জনগণের কাছ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছিল, সত্যিকার জনপ্রতিনিধিদের থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। অবশ্য তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। মোদী আমাদের সঙ্গে দখো করেছেন এবং সফল আলোচনা হয়েছে।’
ভারতে জিতলেন মোদী, ঢাকায় মিষ্টি বিতরণ করলো বিএনপি!
শুধু তাই নয়, এর আগে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেসকে হারিয়ে ভারতের ক্ষমতায় বসে বিজেপি। কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। তাই তাদের পরাজয় এবং বিজেপির বিজয় উদযাপন করার জন্য নয়াপল্টনের পার্টি অফিসে পর্যন্ত মিষ্টি বিতরণ করেছিল বিএনপি নেতা-নেত্রীরা। পরবর্তীতে ডয়েচে ভেলের এক অনুষ্ঠানে সঞ্চালক খালেদ মহিউদ্দিন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেত্রী ব্যারিস্টার রুমিনা ফারহানার কাছে এ বিষয়ে জানতে চান, বিজেপি ক্ষমতায় এলে তারা বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাবে এই ধারণা কনেো হলো বিএনপির। পার্টি অফিসে মিষ্টি বিতরণের কারণ কী! এর কোনো জবাব দিতে পারেনি রুমিন ফারহানা। তিনি বারবার প্রশ্নটি এড়িয়ে যান।
মোদীর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ জামায়াত
এদিকে মোদীকে নিয়ে উৎসাহ দেখানোর বেলায় আরো এককাঠি সরেস বাংলাদেশের অন্যতম উগ্রবাদী দল জামায়াত। গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিজয়ের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করতে ব্যর্থ হয়েও হাল ছাড়েনি তারা। পরে মোদীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার আশাবাদ ব্যক্ত করে পত্র দেওয়া হয়েছিল জামায়াতরে পক্ষ থেকে।
দলের আমীর মকবুল আহমাদ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ভারতের ১৭তম লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট বিজয় লাভ করায় আমি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে এনডিএ জোটের নেতা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমি আশা করি নরেন্দ্র মোদীর সরকার ভারতকে উন্নতি ও সমৃদ্ধি পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক আরো দৃঢ় করবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আগামী দিলগুলোতে আরো জোরদার হবে এবং দুদেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।’
অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা, বিলাসিতার লোভে ইসলামকে নিজেদের প্রয়োজন অনুসারে বিকৃত করে এই বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতের লোকেরা। এরা পবিত্র ধর্ম ইসলামকে যেমন বিকৃত করতে দ্বিধা করে না, তেমনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে ভূলুন্ঠিত করে- প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করে- সাধারণ জনতাকে বিপদে ফেলার অপপ্রয়াস চালাতেও এদের বিবেকে বাধে না। এদের পাষবিকতা বন্য পশুকেও হার মানায়।