বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা এরইমধ্যে দেশের সব প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে’ পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিরোধ শুরু করেছে বীর বাঙালি।
১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও সাহায্য দানের জন্য বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক সরকার ও জনগণের প্রতি আবার আবেদন জানায়।
এদিন রাতে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে সদ্য প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বিমান হামলা চালায় পাকিস্তানি বিমান বাহিনী। তাতে ট্রান্সমিশন অ্যান্টেনাসহ ভবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়, তবে কেউ হতাহত হননি।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এদিন চট্টগ্রাম শহরকে বিভিন্ন দিকে থেকে ঘিরে ফেলে এবং বোমাবর্ষণ করে।
রংপুরে এদিন পাকিস্তানি সেনারা সেনানবিাস থেকে বেরিয়ে শহর-গ্রামে নির্বিচারে গুলি চালায়। জ্বালিয়ে দেয় বাড়ি-ঘর।
২৮ মার্চে রংপুর শহর ও সেনানিবাসের পাশের এলাকার বাঙালি ও সাঁওতালদের যে সেনাছাউনি আক্রমণের ঘটনা ঘটেছিল, তার প্রতিশোধ নিতেই এই বর্বরতা।
এদিন রাজশাহীর গোপালপুর রেল ক্রসিংয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর লড়াই ছিল প্রতিরোধ যুদ্ধের অন্যতম ঘটনা। সেই লড়াইয়ে ছয়টি ট্রাক ও একটি জিপসহ বিপুল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর সম্পূর্ণ সেনাদল ধ্বংস হয়। চিনিকলের কর্মীরা এই প্রতিরোধে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন।
নোয়াখালীতে যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা ৪০ জন পাকিস্তানি সেনাকে বন্দি করে এবং প্রচুর গোলাবারুদ ও অস্ত্র দখল করে। সেসব যুদ্ধ সরঞ্জাম পরে শুভপুর যুদ্ধে কাজে লাগে।
মেজর আবু ওসমানের নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধারা চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ করে। হানাদার বাহিনী দামুড়হুদা, আলমডাঙ্গা, ঝিনাইদহের পালাতে থাকে। ২৫৬ জন পাকিস্তানি সেনা সদস্য নিহত হয়।
এদিন বিকেল ৫টার দিকে মতিন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনস দখল করেন।
প্রথমে আত্মরক্ষা, তারপর প্রস্তুতি এবং সবশেষে পাল্টা আক্রমণের পর্যায়ক্রমিক লক্ষ্য স্থির করে তাজউদ্দীন আহমদ ফরিদুপর, কুষ্টিয়া হয়ে সীমান্তে পৌঁছান।
ঢাকায় এদিনের বর্ণনায় শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইয়ে লিখেছেন, “আজ সকালে এক পাতার মর্নিং নিউজ বেরিয়েছে। উল্টো পাতাটা সাদাই রয়ে গেছে। বিদেশের দুয়েকটা খবর ছাড়া পূর্ব বাংলার খবর মাত্র দুটি: ‘মুজিব ওয়ান্টেড সেপারেশন রাইট ফ্রম সিক্সটি সিকস’ (১৯৬৬ সাল থেকেই মুজিব বিচ্ছিন্নতা চেয়ে চেয়ে আসছেন) এবং ‘পাকিস্তান সেইভড, সেইস ভুট্টো’ (ভুট্টো বলেছেন, পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে)।”
‘সীমান্তের চারদিক থেকে’ শিরোনামে আননন্দবাজার পত্রিকা অবরুদ্ধ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার সশস্ত্র সংগ্রামের বিবরণ ছাপে।
পত্রিকাটি এক প্রতিবেদনে জানায়, আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ২৯ মার্চ ওপার থেকে এপারে এসেছেন। সবার একটাই লক্ষ্য- ভারত থেকে অস্ত্র সাহায্য সংগ্রহ করা।
কুষ্টিয়ার তৎকালীন এমএলএ আশহাবুল হক টেলিফোনে অজয় কুমার মুখোপাধ্যায়ের (পশ্চিম বাংলার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী) সঙ্গে কথা বলেন। তারও আবেদন ছিল- আপনারা অবিলম্বে সাহায্য পাঠান। কুষ্টিয়া মিলিটারি ব্যারাক চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে।
এদিকে ফ্রান্সে পাকিস্তানি জাহাজ থেকে পাকিস্তান নৌবাহিনীর আটজন বাঙালি নৌসেনা পক্ষত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন।