1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

ক্যাপাসিটি চার্জ এর আদ্যোপান্ত 

অধ্যাপক মোহাম্মদ এ. আরাফাত : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বুধবার, ২২ মার্চ, ২০২৩

ক্যাপাসিটি চার্জ শব্দটি সম্পর্কে আমরা সকলে পরিচিত এবং আমাদের গণমাধ্যমগুলো মাঝেমধ্যে হেডলাইন করে, ‘হাজার হাজার কোটি টাকা প্রাইভেট বিদ্যুৎ কোম্পানিকে দিয়ে দিচ্ছে সরকার’! এমনভাবে রিপোর্টগুলো করা হয় যে, হাজার হাজার কোটি টাকা যেন কোনো কারণ ছাড়াই কোম্পানিগুলোর পকেটে দিয়ে দিচ্ছে সরকার। হেডলাইন দেখে মনে হয়ে থাকে, এর ভেতর বড় দুর্নীতি আছে! এতে কী হয়? সাধারণ জনগণ, যাদের এ বিষয়ে ধারণা কম- তারা মনে করে থাকেন, এই ক্যাপাসিটি চার্জের টাকা দেওয়াটা দুর্নীতি বা লুটপাট। আসুন ক্যাপাসিটি চার্জের বিষয়টি কী, তা ব্যাখ্যা করা যাক।

ক্যাপাসিটি চার্জ কী? বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে- সেটা সরকার বা বেসরকারি খাতের মাধ্যমে করুক, ক্যাপাসিটি চার্জ তখন ‘ফিক্সড কস্ট’। এই চার্জ ব্যতীত দুনিয়ার কোথাও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। ভেরিঅ্যাবল চার্জ: ভেরিঅ্যাবল চার্জ হচ্ছে সেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি কোন জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করছে, তার উপর ভিত্তি করেই খরচ নির্ধারিত হয়। কয়লা, গ্যাস, ফার্নেস ওয়েল এবং ডিজেল- এগুলো একেকটি বিদ্যুৎকন্দ্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কোন জ্বালানি ব্যবহার করা হচ্ছে, তার ওপর ভিত্তি করে ভেরিঅ্যাবল খরচ নির্ভর করে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে কোন জ্বালানির দাম কেমন, তা নির্ভর করে থাকে। এই খরচগুলো বাদ দিয়ে কোনোভাবেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব নয়।

সরকারের নিজস্ব যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো আছে, সেখানেও সরকারকে ক্যাপাসিটি চার্জ ব্যয় দিতে হয়। যদিও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সরকারের নিজস্ব। কারণ এটি একপ্রকার খরচ, যা খরচ তা দিয়ে অন্য কারও পকেট ভরা যায় না। এই নিজস্ব সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রেও যে জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হয়, সেই খরচ সরকারকেই বহন করা লাগে। সরকার যখন বেসরকারি কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়ে থাকে ১০, ১৫ বা ২৫ বছরের জন্য, তখন সরকারকে যাবতীয় ক্যাপাসিটি চার্জ বহন করতে হয়। সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি চুক্তি হয়ে থাকে এই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সরকারকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে কোম্পানিটি তার বিনিময় তাদের কিছু সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। সকল বিনিয়োগ সরকার করবে বিনিময় কোম্পানিটি এই চুক্তির সময়সীমার পুরো সময় সরকারকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে প্রস্তুত থাকবে। এই বয়সসীমা ১০ বছর হতে, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের ১৫ বা ২০-২৫ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যদি সরকারের ২৫ বছরের চুক্তি হয়ে থাকে, তাহলে সরকারকে এই ২৫ বছরের ক্যাপাসিটি চার্জ এবং সার্ভিস চার্জ দিতে হবে ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এই পরিমাণ বিদ্যুৎ সরকারকে সরবরাহ করবে। এভাবেই চুক্তিগুলো হয়ে থাকে।

এখানে বেসরকারি খাতগুলো সরকারের থেকে একটি সার্ভিস চার্জ পায়, তারা কিন্তু কোনো প্রফিট করে না। প্রফিটের যে সংজ্ঞা তাহলো, খোলা বাজারে যখন একে অপরের সঙ্গে প্রতিদ¦ন্দ্বিতা করে ঝুঁকি নিয়ে বিক্রি করে যে লভ্যাংশ পায়, তাই প্রফিট বা লাভ। কিন্তু বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এখানে কোনো প্রফিটের ব্যাপার নেই। এখানে একমাত্র ক্রেতা হচ্ছে সরকার এবং সরকারকেই বিদ্যুৎ সাপ্লাই করতে হবে। যার কারণে তারা একটা সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করে থাকে। এ কারণেই এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভেরিঅ্যাবল খরচ বা যাবতীয় ক্যাপাসিটি চার্জ সরকারকেই বহন করতে হয়। যেমন আমরা যদি দুই বছরের জন্য একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি, এই দুই বছরের প্রত্যেক মাসে আমাদের ৩০ হাজার করে বাসাভাড়া বাসা মালিককে দিতে হবে। এই ২ বছরের চুক্তি চলাকালীন যদি আমরা দুই মাস বা একমাস দেশের বাইরে থাকি, তারপরও সেই মাসের ভাড়া আমাদের দিতে হবে। কারণ বাড়ির মালিক দুই বছরের চুক্তিবদ্ধ। এ দুই বছরের মাঝে আমি কয়েকদিন বাসাতে না থাকলেও বাসা আমার জন্যই বরাদ্দ থাকবে। ঠিক এভাবেই বেসরকারি কোম্পানিগুলো সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকার কারণে কোনো মাসে সরকার বিদ্যুৎ না নিলেও বা কম নিলেও তাদের নির্দিষ্ট সার্ভিস চার্জ প্রদান করতে হয়। বিশ্বে এমন কোনো প্রাইভেট সেক্টর নেই, যাদের ক্যাপাসিটি চার্জ না দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করানো যায়।

সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্র কখনো ব্যবহার করবে, কখনো করবে না। কিন্তু পুরো সময়টা শুধু সরকারের জন্যই এভেইলেবল থাকবে। এ কারণেই কখনো কখনো ব্যবহার না করলেও ক্যাপাসিটি চার্জ কোম্পানিকে দিতে হয়। এরপরও পত্রিকায় হেডলাইন করা হয়, ‘ব্যবহার না করেও দিয়ে দেওয়া হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ’। তখন সাধারণ মানুষের মনে হয়, এখানে দুর্নীতি হচ্ছে। ফলে এই বিষয়টি নিয়ে অদ্ভূত ধরনের একটি রূপকথার গল্প সৃষ্টি হয়। বাসাভাড়ার বদলে যদি আপনি আপনার সুবিধামতো সময়ে হোটেলে থাকতে চান, সে ক্ষেত্রে আপনার বাসাভাড়া অপেক্ষা হোটেল ভাড়া বেশি পড়ে যাবে হিসাব করলে। ঠিক এভাবেই চুক্তি ছাড়া সরকার যদি খোলা বাজার থেকে প্রয়োজনমতো বিদ্যুৎ ক্রয় করতে যায়, তার খরচও বেশি পড়ে যাবে। তাছাড়া এমন খোলা বাজারে বিদ্যুৎ ক্রয়ের ব্যবস্থা বিশ্বের কোথাও নেই। তাই ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়ার পরও এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিকৃত বিদ্যুতের দাম কম পড়ে থাকে। একেক সময় একেকজন বিক্রেতা থেকে বিদ্যুৎ কেনা যাবে- এমন কোনো বিক্রেতা বা সিস্টেম নেই। তাই প্রাইভেট সেক্টরকে ধরে তাদের সঙ্গে এগ্রিমেন্ট করে বিদ্যুৎ ক্রয় করতেই হবে। ১০ বছর বা ২০/২৫ বছরের চুক্তিতে ওই প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানকে পুরো সময়টা বিদ্যুৎ সরবরাহ ডেডিকেটেডলি সরকারের জন্য রাখতে হয়। যে কারণে পুরো খরচা সরকারের দায়ের মধ্যে চলে আসে। সরকার এ কাজটি যদি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে না করিয়ে নিজে করতো, তাহলেও সরকারের নিজেরও এসব খরচ করতে হতো। এ ব্যাপারটা সম্পর্কে না বুঝে অনেকেই সরকারের প্রতি ভুল ধারণা করে থাকেন। সবাই মনে করে থাকেন, আমরা যখন প্রাইভেট সেক্টরকে দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করাবো, ফলে যখন বিদ্যুৎ খরচ করবো তখনই তাদের চার্জ দেবো আর যখন খরচ করবো না, তখন দেবো না। আসলে এটা যুক্তিহীন বা দুনিয়ার কোথাও এমন নিয়ম নেই। কিন্তু আমাদের দেশের কিছু গণমাধ্যম এসব ভ্রান্ত ধারণা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে।

একটা জিনিস আমাদের মাথায় রাখতে হবে, বাংলাদেশ সরকার এযাবৎকালে যতো টাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ খরচ করেছে, এর প্রতিটি টাকার সুবিধা ভোগ করছে জনগণ, যারা বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন। আমরা যদি সময়মতো নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ পেতে চাই, তাহলে আমাদের পূর্ণ চুক্তিতে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই। সুতারাং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পেতে আমাদের ক্যাপাসিটি চার্জ খরচ করতেই হবে। আর আমরা যদি এই খরচ করতে না চাই, তাহলে প্রয়োজনমতো বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব নয়। হয় আমাদের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে, না হয় আমাদের ভোগান্তি পোহাতে হবে। কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জ না দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়ার কোনোরকম পথ নেই।

সারা দুনিয়ায় দেখা যায়, যে পরিমাণ বিদ্যুতের চাহিদা থাকে, তার চেয়েও ৪০ শতাংশ বেশি ক্যাপাসিটি তৈরি করে থাকে দেশগুলো। এর ২০ শতাংশ বিভিন্ন কারণে নষ্ট হয়ে থাকে, বাকি ২০ শতাংশ হাতে রাখা হয়ে থাকে। কারণ যে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি হয়, তাদের কারও কারও সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষের পথে চলে আসে। হয়তো ৬ মাস বাকি থাকে, ৬ মাস পরই নতুন কারও সঙ্গে চুক্তি শুরু করে নতুন করে বিদ্যুৎ উৎপন্ন শুরু করতে হয়। এটি করতে সময়ের প্রয়োজন, ঠিক এ কারণেই ২০ শতাংশ বাড়তি ক্যাপাসিটি রাখা হয়। আমেরিকা, চীন, জাপান, রাশিয়ার মতো উন্নত দেশগুলোতেও এ কাজটিই করে থাকে। ৬০ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত ক্যাপাসিটি তৈরি করে রাখে দেশগুলো। বিশ্বের সব দেশের সরকারকেই বিভিন্ন সময় কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে বসিয়ে রাখতে হয়। তবে এই সময়ে তাদের ভ্যারিএবল খরচটা দিতে হয় না, কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জটি অবশ্যই বহন করতে হয়। এটাই লজিক্যাল নিয়ম। শুধু বাংলাদেশের জন্য এই নিয়মটি অন্যভাবে বা উল্টাভাবে করার কোনো সুযোগ নেই।

লেখক : অধ্যাপক মোহাম্মদ এ. আরাফাত – রাজনীতিক, গবেষক ও চেয়ারম্যান, সুচিন্তা ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। অনুলিখন: খসরুল আলম


সর্বশেষ - রাজনীতি