ইশতেহার বা মেনিফেস্টো, বাংলায় ঘোষণাপত্র। সাধারণত নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য জনগণকে জানাতে ইশতেহার ঘোষণা করে থাকে। কিন্তু ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ স্বাধীনতাসংগ্রামকে সামনে রেখে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ কেমন হবে, তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কী হবে—তা জনগণকে জানাতে আওয়ামী লীগের পক্ষে ইশতেহার ঘোষণা করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এই দিনে পল্টন ময়দানের লাখো ছাত্র-জনতার সামনে স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। দিবসটি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী নির্বাচনের ফল মেনে নিতে পারেনি। এ জন্যই নির্বাচনে বিজয়ী দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সংকট সমাধানে ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকেন। কিন্তু আকস্মিকভাবে ১ মার্চ তা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়। গর্জে ওঠে পুরো দেশ। পুরো ঢাকা প্রতিবাদী মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। অন্যায় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সারা দেশে হরতাল আহ্বান করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক নেতাদের ১০ মার্চ গোলটেবিল বৈঠকে বসার প্রস্তাব দেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রস্তাব গ্রহণ করলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সরাসরি প্রস্তাব নাকচ করে দেন।
স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের আন্দোলনে স্লোগানের জয়ধ্বনি কী হবে সেটাও তুলে ধরে সভায় বলা হয়—‘স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ, দীর্ঘজীবী হোক; স্বাধীনবাংলার মহান নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব; গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়, মুক্তিবাহিনী গঠন কর; বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর; মুক্তি যদি পেতে চাও, বাঙালিরা এক হও।’
স্বাধীনতার ইশতেহারটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের পরিপূর্ণ রূপরেখা হিসেবে তুলে ধরা হয়। দেশের নাম হবে ‘বাংলাদেশ’, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক হবেন জাতির পিতা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি হবে জাতীয় সংগীত, ‘সবুজের ওপর লাল বৃত্তের মাঝে মানচিত্র’ হবে জাতীয় পতাকাসহ বিষয়গুলোকে স্পষ্ট করে ইশতেহারে তুলে ধরা হয়।
সভা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ৩ মার্চের জনসভা থেকেই তিনি ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক জনসভার ঘোষণা দেন। ইশতেহার ঘোষণার পরই লাখ লাখ ছাত্র-জনতা প্রচণ্ড করতালির মাধ্যমে ইশতেহারকে সমর্থন করে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে পুরো পল্টন এলাকাকে মুখরিত করে তোলে।
শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ৭ই মার্চের পরে আন্দোলন নতুন গতি পায়। অবস্থা বেগতিক দেখে সংকট সমাধান না করে ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। আন্দোলন দমনের নামে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ঢাকাসহ সারা দেশে নির্বিচার গণহত্যা শুরু করেন। ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
স্বাধীনতার ইশতেহার দিবসটি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ দিবস। কারণ এই দিনই দেশের নাম, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হয়েছিল।
লেখক: তাপস হালদার – সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।