1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

‘কেমন করে গান করো হে গুণী’

অধ্যাপক ড. মো. আবদুর রহিম : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ২ মার্চ, ২০২৩

এ মাটির কন্যা শেখ হাসিনাকে দক্ষ রাজনীতিক, ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতিক, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক সবশেষে দেশমাতৃকার সূর্যসন্তানের জন্য উদারচিত্ত জননী বসুন্ধরা রূপে আমরা দেখেছি বহুবার। এত কিছুর মধ্যে তার কৃষকসত্তা দেখে বিস্ময় জাগে মনে—‘কেমন করে গান করো হে গুণী’!

সম্প্রতি গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শখের কৃষি কার্যক্রম সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনের প্রতি সবার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। সংবাদপত্রসমূহে এ বিষয়ে ‘গণভবন আঙিনায় শেখ হাসিনার ফসলি উঠোন’, ‘গণভবন শেখ হাসিনার যেন এক খামারবাড়ি’, ‘গণভবনের আঙিনা থেকে তোলা হলো ৪৬ মণ পেঁয়াজ, খেতে আরো ৫০ মণ, গণভবন যেন গ্রামের খামার বাড়ি’ ইত্যাদি নানা শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়েছে। উন্নয়ন সাংবাদিক শাইখ শিরাজের একটি বিশেষ প্রতিবেদন চ্যানেল আই-এ প্রচারিত হয়েছে। করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের খাদ্য পরিস্থিতি কিছুটা স্বস্তিদায়ক রাখতে প্রধানমন্ত্রীর শখের কৃষি সবার জন্য শিক্ষণীয় ও অনুপ্রেরণাদায়ক হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

করোনার অভিঘাতে সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা যখন টালমাটাল, সারা পৃথিবীর আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হতে বসেছিল, তখন শেখ হাসিনা নিজস্ব উত্পাদনব্যবস্থার ওপর জোর দিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তারও আগে ২০০৯ সালে তিনি ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের সূচনা করেন। তিনি নিজে কৃষি অধ্যুষিত এলাকার মানুষ। উত্তরাধিকার সূত্রে তার মা শেখ ফজিলাতুন নেছা ছিলেন অঢেল ভূসম্পত্তির মালিক, বাবা তো বটেই। পিতা শেখ মুজিব নিজেকে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে উৎসর্গ করেছেন। কৃষি ও কৃষক ছিল তার অস্তিত্ব জুড়ে। পাকিস্তান শাসনামলে শেখ মুজিবের রাজনীতির পুরোভাগে ছিল কৃষি, কৃষক-শ্রমিকের অধিকার, খাদ্য ঘাটতি মেটানো, পাটের উৎপাদন ও মূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি। পাকিস্তান গণপরিষদ, পূর্ব বাংলা বিধানসভা, গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট, রাজনৈতিক জনসভার বক্তব্যে এসবের তথ্য মেলে। তিনি কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে কাজ করেছেন। বিশেষ করে পাকিস্তান শাসনামলে দাওয়ালদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে সরকারের রোষানলে পড়েন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলে তিনি ‘সবুজ বিপ্লবের’ ডাক দিয়েছিলেন। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার পাশাপাশি প্যান্ট-শার্ট খুলে কৃষিকাজে হাত লাগানোর কথা বলেছিলেন। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কারণে পয়সা দিয়ে কিনেও যখন খাদ্যশস্য দেশে আনতে পারছিলেন না, তখন তিনি ঘাম ঝরিয়ে দেশজ উৎপাদনের ওপর জোর দিয়েছিলেন। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু দেশকে দুর্ভিক্ষাবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে স্থিতিশীল অবস্থায় আনতে পেরেছিলেন। সার্বিক উন্নয়নে যখন গতি এলো, মানুষ যখন নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করল তখন তাকে হত্যা করা হলো। এরপর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের নীতি ছিল ভিক্ষার ঝুলি হাতে দাতাসংস্থার দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ানো। দাতা দেশ ও সংস্থার দ্বারে দ্বারে ঘুরে ১০-২০ কোটি ডলার ঋণ ভিক্ষার প্রতিশ্রুতি নিয়ে দেশে ফিরে এয়ারপোর্টে সংবাদ ব্রিফিং-এ অর্থমন্ত্রীগণ এক বিজয়ের হাসি হেসে সাংবাদিকদের ‘সুখবর’টি দিয়ে বিশ্বজয়ের আনন্দ পেতেন। এ টাকায় তারা বেশ খুশি হতেন, কারণ এ ঋণের দায় কৃষকের ঘাড়ে গিয়ে পড়লেও পকেট ভরত তাদের। সঙ্গে উপরি হিসেবে পাওয়া যেত দাতাদের চোখরাঙানি আর সার্বভৌমত্ব নিয়ে টানাটানি। পাকিস্তানিদের ইচ্ছে অনুসারে বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপনের উপায় বইকি! এখান থেকে মুক্তি পেতেই ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেই শেখ হাসিনা দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। কৃষি গবেষণা আর কৃষির বহুমুখীকরণের ওপর জোর দেন। কৃষি গবেষণায় অকৃপণ বরাদ্দ দেন। দ্রুতই দেশ তার ফলাফল পেয়ে যায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও বাংলাদেশের খাদ্য আমদানিনির্ভরতা কমে যায়। খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে দেশ।

শাইখ সিরাজ কর্তৃক গণভবনের খামার ব্যবস্থাপনার ভিডিও ধারণকালে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনি দেখানোর পর সবার একটু আগ্রহ হবে, সবাই করবে।’। কত সহজ অথচ মানবিক অভিব্যক্তি—‘শখ করে করলাম সবাইকে দিয়েথুয়ে খাওয়া যাবে’। যত গরিব দেশই হোক, একজন প্রধানমন্ত্রীর বিলাসিতা করার অবাধ সুযোগ থাকে—জনগণেরই যা-ই হোক। অথচ আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপরিচালনার মতো ব্যস্ত জীবনের মধ্যেও নিজের খাবার নিজেই উৎপাদন করছেন। অন্যকেও সযত্নে বিলিয়ে দিচ্ছেন। দিল্লির সুলতান নাসির উদ্দিন নিজে টুপি সেলাই করে এবং তার স্ত্রী ঘর-গৃহস্থালির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তারা ইতিহাসে মহিমান্বিত হয়েছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রতি ইঞ্চি জমির সদ্ব্যবহারের আহ্বান জানিয়ে নিজে বসে থাকেননি। নিজে করে দেখিয়ে দিলেন ইচ্ছে থাকলে অনেক কিছু করা সম্ভব। আর এ কাজ করতে তিনি সরকার পরিচালনায় ফাঁকি দেননি। একজন সরকারপ্রধান হিসেবে বারবারই বিশ্বস্বীকৃতি পেয়েছেন। তিনি বিশ্বের ক্ষমতাধর সরকারপ্রধানের একজন। শীর্ষস্থানীয় নারীদের মধ্যে অন্যতম। প্রধানমন্ত্রী ৫০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। এসবের মধ্যে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার ‘সেরেস পদক’ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘ডিপ্লোমা অ্যাওয়ার্ড’ এবং ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের জন্য ‘সাউথ এশিয়া ও এশিয়া প্যাসিফিক ম্যানহাটন অ্যাওয়ার্ড’ খাদ্যনিরাপত্তায় ভূমিকার জন্য পেয়েছেন। ভোরবেলা প্রার্থনার মধ্য দিয়ে তার কর্মব্যস্ত দিন শুরু হয়, চলে গভীর রাত অবধি। এর মধ্যেই সময় বের করে ফল-ফসলের খামার পরিচর্যা, প্রাণিকুলের দেখভাল সবই করেন। কী নেই তার খামারে। গ্রামের গরিবের মাংসখ্যাত বথুয়া শাক থেকে শুরু করে বিদেশি ফল স্ট্রবেরি—সবই আছে। এ খামারে কাকতাড়ুয়ারও দেখা মিলল। ‘মালসায়’ মৌমাছির জন্য পানি রাখেন। আমার ধারণা গণভবনের বাইরে মালসার ব্যবহার খুব একটা নাই—এ শব্দটির অর্থ অনেকে জানেনই না। তিনি একেবারেই মাটির সন্তান—দেশজ প্রযুক্তি আগলে রেখেছেন। ইট-কাঠের শহরের মধ্যে এ যেন একটি সাজানো গ্রাম্য বাড়ি। শেখ হাসিনা গণভবনে কৃষি প্রকল্পের অনুপ্রেরণা পিতার কাছ থেকেই পেয়েছেন। শেখ মুজিবও সেখানে প্রথম ধান, আনারসসহ ফসল ফলিয়েছিলেন, তা তিনি বলেছেন। সেগুনবাগিচায় থাকাকালে পিতা মুজিব তাদেরকে বাগান করার জন্য প্লট ভাগ করে দিতেন তা তার স্মৃতিতে ভাস্বর। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত জীবনাচরণের সব ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নিত্য উপস্থিতি মানুষের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার শক্তি ও সাহস জোগায়। আধুনিক জীবনের সব শৌখিনতা পরিহার করে গণভবনকে বাঙালির আদিরূপের এক গেরস্থ বাড়িতে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালিত্বের ঐতিহ্যকে সমুন্নত রেখেছেন বাবার মতোই। তার এ প্রকল্প নিছক শখের কৃষি বললে ভুল হবে। একেকটি ব্লক যেন একেকটি গবেষণা প্রকল্প। হারিয়ে যেতে বসা বাঁশফুল, লাল আউশ ধান, তিল, সরিষাসহ সব ধরনের কৃষিপণ্যই সেখানে হয়। হয় মধুর চাষ। গবাদিপশু ও মৎস্য চাষও বাদ নেই। এই সমারোহ যেন কৃষি গবেষণা আর বাঙালিত্বে অপূর্ব মেলবন্ধন। প্রক্রিয়াকরণের ব্যবস্থাও সেখানে রয়েছে।

আমি নিশ্চিত শেখ হাসিনার শখের কৃষি শহরের মানুষের মধ্যে নগর কৃষির সম্প্রসারণ ঘটাবে। গ্রামের মানুষের মধ্যেও একধরনের আত্ম-উপলব্ধির সঞ্চার করবে। একজন প্রধানমন্ত্রী সারা দিনের কর্মব্যস্ত সময়ের মধ্যেও কীভাবে গৃহস্থালির কাজে সম্পৃক্ত রাখেন তা সবাইকে সময়ের সঠিক ব্যবহারে উত্সাহ জোগাবে। বাংলাদেশের মাটির এমনি গুণ যে এর প্রতি ইঞ্চির সদ্ব্যবহারের বিষয়টি শুধু কথার কথা নয়। গ্রামের একটি খুবই সাধারণ বাড়িতেও একচিলতে আঙিনা থাকে। সেখানে একটি গরু, দু-একটি ছাগল, কয়েকটি হাঁস-মুরগি অনায়াসেই পালন করা যায়। অল্প একটু জমিতেই বীজ বুনে পরিবারের প্রয়োজনীয় শাকসবজির জোগান সম্ভব। এমনকি সরকারি রাস্তা বা নদী-খালের ধারে কিছু না কিছু ফসল ফলানো সম্ভব। এখানে বছরের সব ঋতুই খুলে দেয় নতুন সম্ভাবনার দ্বার। সারা বছরই বাড়ির অব্যবহৃত আঙিনাকে খামারে রূপান্তরিত করে প্রয়োজনীয় পুষ্টির আংশিক জোগান সম্ভব। এর ফলে বাজারের ওপরও চাপ কমবে। নিজের খরচও কিছুটা সাশ্রয় হবে। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত সহজে ফসল ফলে না। সে কারণেই বঙ্গবন্ধু বলেছেন ‘আমার মাটি আছে, সোনার মাটি আছে…।

শেখ হাসিনা সোনার মাটিতে কীভাবে রাশি রাশি রত্ন ফলাতে হয় তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন। বাসস্থানকে কৃষি খামারে রূপান্তরের এ ভাবনা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজ উপদেষ্টা চাণক্যের ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে’ দেখা যায়। আধুনিককালে রবীন্দ্রনাথের শ্রীনিকেতনও ছিল সেই একই ভাবনার প্রতিচ্ছবি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষকদের সম্মান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তুলে ধরলেন। কৃষক পিতার হাড়ভাঙা খাটুনির পয়সায় নব্য শিক্ষিত ‘ভদ্দরলোক’ সন্তানেরা পিতার কৃষক পরিচয় দিতে গর্ববোধ করবেন। ‘প্যান্ট-শার্ট’ খুলে বাবার সঙ্গে কাজে হাত লাগাতে উত্সাহিত হবেন। এখন থেকে কৃষির উন্নতি দেখতে কৃষিহীন কোনো দেশে আমাদের অধিকর্তারা না গিয়ে বাসার আঙিনাকেই বেছে নেবেন গবেষণার ক্ষেত্র রূপে। পুষ্টিকর খিচুড়ি রান্না শিখতে হয়তো আর বিদেশ যাওয়া লাগবে না আমাদের—প্রধানমন্ত্রী নিজেই যখন একজন দক্ষ রাঁধুনি। আগামী দিনে হয়তো আর খাদ্য আমদানির পেছনে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হবে না।

লেখক : ড. মো. আবদুর রহিম – অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ - রাজনীতি