1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

প্রথম মুক্তিবাহিনী গঠন ও প্রথম বিজয়ের নায়ক

শাহরিয়ার কবির : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
সোমবার, ২৮ মার্চ, ২০২২

১৯৭১-এর ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার সর্বাত্মক আহ্বানের পাশাপাশি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বানও জানিয়েছিলেন। তবে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয় ২৬ মার্চ রাত্রির প্রথম প্রহর পর্যন্ত, যখন পাকিস্তানি সামরিক জান্তা রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পরিকল্পিত গণহত্যা আরম্ভ করে দিয়েছিল। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা ছাড়াও সর্বস্তরের জনগণ অংশগ্রহণ করেছিলেন। দুর্ধর্ষ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রাথমিক প্রশিক্ষণ ও রসদ আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম পেয়েছিলেন ভারতের সীমান্তরক্ষাকারী বাহিনী বিএসএফ-এর কাছ থেকে।

৩০ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধ-গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও আমি আমাদের কাজের সুবিধার জন্য ক্ষেত্র ভাগ করে নিয়েছিলাম। মামুন বেছে নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সামগ্রিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সার্বিক গবেষণা, যে কারণে তাকে পাকিস্তানে যেতে হয়েছিল। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় মিত্রবাহিনীসহ সে দেশের সরকার, রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী এবং আমজনতার ভূমিকা সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধান, যার জন্য আমাকে বহুবার ভারতে যেতে হয়েছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যুক্ত ভারতীয় নায়কদের সন্ধানে আমার তিরিশ বছরের অভিযানে বহুজনকে পেয়েছি, যারা মুক্তিযুদ্ধের এক একটি অধ্যায়কে এক একভাবে আলোকিত করেছেন। তিরিশ বছর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জীবিত ছিলেন না। তবে ১৯৭১-এ এই মহান নেত্রীর সহযোগী যারা মুক্তিযুদ্ধের ২২-২৩ বছর পরেও বেঁচে ছিলেন, তাদের সাক্ষাৎকার আমি গ্রহণ করেছি।

ফিল্ড মার্শাল মানেক শ, জেনারেল অরোরা, জেনারেল জ্যাকব, জেনারেল উবান, জেনালের থাপান, জেনারেল লছমন সিং, মন্ত্রী করণ সিং, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর উপদেষ্টা পি এন হাকসার, পররাষ্ট্র সচিব টি এন কল, গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর প্রধান আর এন কাও ও বিএসএফ প্রধান রুস্তমজীসহ ভারতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরও অনেকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। এই তালিকার সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে ভারতের বিএসএফ-এর তৎকালীন তরুণ কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন পরিমল কুমার ঘোষ, বন্ধুমহলে যিনি ‘পি কে ঘোষ’ নামে পরিচিত।

গত সপ্তাহে (মার্চ ১৩-২২, ২০২২) ভারত সফরে গিয়েছিলাম আমাদের জাতীয় কমিটির কাজে, মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য যেসব বিশিষ্ট ভারতীয় নাগরিকদের এখনও রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদান করা হয়নি, তাদের খোঁজখবর নেয়ার জন্য। অধিকাংশই বেঁচে নেই, মরণোত্তর সম্মাননা কে গ্রহণ করবেন সেটাও জানা দরকার ছিল। এদের খুঁজে বের করার জন্য স্বাভাবিকভাবেই সাংবাদিক বন্ধুদের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল, যাদের একজন বিবিসির প্রাক্তন সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক। সাংবাদিকদের কাছে অনেক খবর থাকে, যা অন্যদের জানা নেই। সুবীর বললেন, আপনারা ভারতের অনেককে সম্মাননা দিয়েছেন, আবার অনেকের নাম আপনাদের তালিকায় নেই। সুবীরই আমাকে এবার বিএসএফ-এর মেজর পরিমল ঘোষের সন্ধান দিয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধে যে বিএসএফ-এর অবদান বিশেষ কারণে ভারত সরকার গোপন রেখেছিল, ৫০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তা এবারই প্রথম জনসমক্ষে এসেছে।

২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে ঐতিহাসিক বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী বাংলাদেশের মতো ভারতেও আড়ম্বরের সঙ্গে উদযাপন করা হয়েছে, যেখানে বিএসএফ-এর অবদান বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। সুবীর আমার হোয়াটসঅ্যাপে বিএসএফ-এর বার্ষিক জার্নাল ‘বর্ডারমেন ২০২১’ পাঠিয়েছেন, যেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী রয়েছে। এই জার্নালেই প্রকাশিত হয়েছে মেজর পিকে ঘোষের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ- যার শিরোনাম- “BSF made history in 1971” এবং উপ-শিরোনাম হচ্ছে “First crossing over and formation of first Mukti Bahini by BSF”।

লেখাটি পড়ে অভিভূত হলাম। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতার প্রথম প্রহরে ত্রিপুরায় ভারত-বাংলাদেশ (তখন পাকিস্তান) সীমান্তে দায়িত্ব পালনরত বিএসএফ-এর ৩২ বছর বয়সি এক তরুণ ক্যাপ্টেন শ্রীনগর ‘বিওপি’র কোম্পানি কমান্ডার পি কে ঘোষ কীভাবে বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে নিয়ে ফেনী-চট্টগ্রাম সীমান্তের শুভপুর ব্রিজে যুদ্ধ করে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে পরাজিত করে সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেতুটি দখল করেছিলেন- তারই অত্যন্ত রোমাঞ্চকর ও চিত্তাকর্ষক বর্ণনা রয়েছে মেজর পি কে ঘোষের নাতিদীর্ঘ রচনায়।

সুবীরের কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে দিল্লিতে মেজর ঘোষকে ফোন করলাম। সুবীর তাকে আগেই আমার সম্পর্কে জানিয়ে রেখেছিলেন। মেজর ঘোষ সাদর সম্ভাষণ জানালেন। তার লেখা পড়েছি জেনে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। বললাম, তার এই যুদ্ধের কথা বাংলাদেশে কেউ জানে না। এ বিষয়ে আমি লিখতে চাই, তার এই অসামান্য বিজয়ের দিন ২৬ মার্চেই। মেজর ঘোষ অভিভূত হয়ে বললেন, বিজয়ের ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। এ সব কথা বলার এখন সময় হয়েছে।

বিএসএফ-এর জার্নালে তিনি যা লিখেছেন তার মুখ থেকে আবার তা শুনলাম। প্রিয় পাঠক, তার জবানিতেই শুনুন ৫১ বছর আগে ২৬ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ঘটনা-

‘১৯৭১-এর ২৬ মার্চ সকালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তাদের পদাতিক ব্যাটেলিয়নের একটি দল কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে চট্টগ্রাম পাঠিয়েছিল মেজর জিয়ার বাহিনীকে দমন করার জন্য। একজন পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ারকে এই অভিযানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। শুভপুর ব্রিজের পাহারায় রাখা হয়েছিল ১০-১৫ জন সৈন্যকে। বেলা ২টার সময় আমার ইপিআর-এর কন্টাক্ট হাবিলদার নূরউদ্দিন এলেন আমার শ্রীনগরের সীমান্ত ঘাঁটিতে। তার সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এবং জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সদস্য অধ্যাপক ওবায়দুল্লাহ মজুমদার ও আরেক আওয়ামী লীগ নেতা ড. আমীর আলী। তারা আমাকে পূর্ব পাকিস্তানের ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করে ভারতের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক সাহায্যের অনুরোধ জানালেন। তারা আরও বললেন, শুভপুর ব্রিজে পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থানের কারণে গ্রামের মানুষ, বিশেষভাবে নারীরা অত্যন্ত আতঙ্কের ভেতর রয়েছেন। তারা আমাকে শুভপুর ব্রিজে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সৈন্যদের হটিয়ে দিতে বললেন।

‘ইপিআর হাবিলদার নূরুদ্দিনের অবস্থান আমার সীমান্ত ঘাঁটির ঠিক বিপরীতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ যখন স্বাধীনতার আহ্বান জানালেন তখনই তিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, যেভাবে ইপিআর, পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে স্বাধীনতার সবুজ সংকেত পেয়েছিলেন। ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি আর্মির ক্র্যাক ডাউনের আগে থেকেই নূরুদ্দিন আমাকে ইপিআর-এর অবাঙালি কর্মকর্তাদের সন্দেহজনক গতিবিধির খবর জানাতেন। নূরুদ্দিন আমাকে বার বার বললেন, বিএসএফ যেন এখনই শুভপুর ব্রিজে আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানিদের হটিয়ে দেয়।

‘আমার জন্য অত্যন্ত কঠিন এক সময় ছিল সেটা। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আমরা পাকিস্তানের সীমান্ত অতিক্রম করতে পারি না। আমি সহানুভূতির সঙ্গে বললাম, তাদের অনুরোধ আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব। কিন্তু তারা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে মানবতার দোহাই দিলেন। আমি তাদের যুক্তি মেনে নিলাম। সমস্যা হলো বিএসএফ-এর উর্দি পরে আমি সীমান্ত অতিক্রম করতে পারব না। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি অধ্যাপক ওবায়দুল্লাহ মজুমদার বললেন, আমি পটিয়া কলেজের অধ্যক্ষ। আমি আপনাকে গ্রামবাসীর কাছে আমার সহকর্মী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেব। তখন আমি প্রফেসর আলী ছদ্মনাম গ্রহণ করে তাদের সঙ্গে সীমান্ত অতিক্রম করে গ্রামে গেলাম। হতবিহ্বল গ্রামের মানুষ তাদের নেতা অধ্যাপক মজুমদারকে কাছে পেয়ে আবেগাক্রান্ত হয়ে উচ্চকণ্ঠে স্লোগান দিল- ‘জয় বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা, জয় বাংলাদেশ…।’

‘স্লোগানের তাৎক্ষণিক জবাবে পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রামের দিকে তাক করে মেশিনগানের গুলি বর্ষণ করল। তবে এতে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। সঙ্গে সঙ্গে আমি শত্রুর অবস্থান জানার উদ্যোগ গ্রহণ করলাম। বিকেল ৫টা নাগাদ আমি হাবিলদার নূরুদ্দিনের নেতৃত্বে ইপিআর-এর ছয়জন তরুণকে নিয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রথম দল গঠন করলাম। তাদের দুটি গ্রুপে ভাগ করে উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে ব্রিজের তলায় অবস্থান নিতে বললাম। পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থান ছিল ব্রিজের ঠিক ওপরে। তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলাম। গেরিলা যুদ্ধের কৌশল তো বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ভাষণেই বলেছিলেন। ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ শত্রুকে ভাতে মারতে হবে, পানিতে মারতে হবে। আমি ইপিআর-এর তরুণদের বললাম, তারা পাকিস্তানি সৈন্য গ্রামে প্রবেশ থেকে বিরত রাখবে, কোনোভাবে তাদের নদীর দিকে নামতে দেবে না এবং একবারে এক রাউন্ডের বেশি গুলি ছুড়বে না। কারণ সেই সময় আমার কাছে মাত্র ৩০০ রাউন্ড গুলি ছিল, যা তাদের ভাগ করে দিয়েছিলাম। বললাম, আমাদের এক রাউন্ডের জবাবে ওরা একশ’ রাউন্ড ছুড়বে। পাকিস্তানিরা বৃষ্টির মতো গুলি করবে কিন্তু আমাদের গুলির মজুদ ঠিক রাখতে হবে।

‘সন্ধ্যা সাতটার দিকে আমি শ্রীনগর পোস্টে ফিরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পরিস্থিতি প্রতিবেদন (SITREP) পাঠালাম, আমার সীমান্ত অতিক্রম করার বিষয়টি গোপন রেখে। পরদিন সকালে আমার Commanding Officer কর্নেল অরুণ কুমার ঘোষ এলেন। আমার রিপোর্টের জন্য সন্তোষ প্রকাশ করে ধন্যবাদ জানালেন। একজন শৃঙ্খলাপরায়ণ সৈনিক হিসেবে আমার সীমান্ত অতিক্রমের কথা তাকে বললাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার সিও-র মেজাজ পাল্টে গেল। ক্রুদ্ধ গলায় তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘কোন সাহসে তুমি আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করেছ?… তোমাকে কোর্ট মার্শালের সম্মুখীন করা হতে পারে,’ এই বলে ক্রুদ্ধ মেজাজ নিয়েই তিনি চলে গেলেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আচরণের জন্য আমার খারাপ লাগলেও আমি বিন্দুমাত্র দুঃখিত ছিলাম না- সীমান্তের ওপারের হতভাগ্য নিরাপরাধ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তের জন্য। আমি স্বামী বিবেকানন্দের ভক্ত। তিনি বলেছেন, “বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে, অসহায় প্রতিবেশীকে সাহায্য করতে”।

‘শুভপুর ব্রিজের দখল নিয়ে তুমুল গুলিবিনিময় চলছিল। পাকিস্তানি সৈন্যদের খাদ্য ও গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেল। তাদের সাহায্য করার জন্য কেউ আসছিল না। ২৮ মার্চ তারা মনোবল হারিয়ে হাবিলদার নূরুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করল। গ্রামবাসীদের দাবির মুখে নুরুদ্দিন তাদের হত্যা করেন। যুদ্ধের নিয়ম হচ্ছে- তুমি যদি শত্রুকে হত্যা না কর শত্রু তোমাকে হত্যা করবে। বিপুলসংখ্যক উল্লসিত গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে আমরা শুভপুর ব্রিজে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করলাম। পূর্ব রণাঙ্গণে মুক্তিযুদ্ধে এটা ছিল মুক্তিবাহিনীর প্রথম বিজয়।’

এরপর মেজর পি কে ঘোষ বলেছেন, তারা কীভাবে মুক্তিবাহিনীকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং শুভপুর ব্রিজ দখল নিয়ে পাকিস্তানিদের হামলার জবাব দিয়েছেন। এই তরুণ অফিসারকে অভিনন্দন  জানাবার জন্য ৪ এপ্রিল বিএসএফর-এর মহাপরিচালক কে এফ রুস্তমজী এবং অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শ্রীনগর এসে মুক্তিবাহিনী এবং ক্যাপ্টেন ঘোষের বাহিনীর জওয়ানদের বীরত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম- কোর্ট মার্শালে চরম শাস্তি হতে পারে জেনেও আপনি কেন বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এবং নিরস্ত্র মানুষকে সাহায্যের জন্য আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করেছিলেন?

জবাব দিতে গিয়ে মেজর ঘোষ আবেগাপ্লুত গলায় বলেছেন, ‘আমার জন্ম বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের ফাজিলহাটি গ্রামে। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত সেখানকার স্কুলে লেখাপড়া করেছি। আওয়ামী লীগের নেতারা আমাকে যখন বাংলাদেশের নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের উপর পাকিস্তানি সৈন্যদের নৃশংস গণহত্যা ও নির্যাতনের কথা বললেন, তখন আমি আমার বাংলা মায়ের প্রতি তীব্র টান অনুভব করেছি। বাঙালি ও বাংলাদেশের প্রতি এই আকর্ষণের কারণে আমি কোর্ট মার্শালের পরোয়া করিনি।’

মুক্তিযুদ্ধকালে সেক্টর এক ও সেক্টর দুই-এর মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক ও উপ-অধিনায়কদের অনেকের কথা বলেছেন মেজর ঘোষ, যাদের ভেতর উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন, কর্নেল (পরবর্তী জেনারেল) ওসমানী, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন ওলি আহমেদ, ক্যাপ্টেন মফিজুর, ক্যাপ্টেন এনামুল, ক্যাপ্টেন মতিন প্রমুখ। তবে বার বার তিনি বলেছেন ইপিআর-এর হাবিলদার মুক্তিবাহিনীর নূরুদ্দিনের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের কথা।

মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে মেজর পি কে ঘোষের অনেক স্মৃতি রয়েছে। ওসমানী পূর্ব রণাঙ্গন সফর করতে এলে শ্রীনগরও আসতেন। ক্যাপ্টেন ঘোষ তাকে সব ঘুরিয়ে দেখাতেন। ব্রিটিশ আমলে কমিশনপ্রাপ্ত ওসমানী সব সময় ইংরেজিতে কথা বলতেন। মেজর ঘোষ আমাকে বলেছেন, তিনি বাংলায় কথা বলছেন অথচ বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর প্রধান ইংরেজি বলছেন এটা তার ভালো লাগেনি। যে বাঙালি মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করছে তাদের অধিনায়ক কেন ইংরেজি বলবেন! মেজর ঘোষ বললেন, একদিন কর্নেল ওসমানীকে বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার সময় বলেই ফেললাম, স্যার আপনি বোধহয় ইংরেজিতে কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন? ওসমানী আমার কথা বুঝতে পেরেছিলেন। এরপর আমার সঙ্গে তিনি আর ইংরেজি বলতেন না। শিশুর মতো সরল ছিলেন তিনি। ক্ষেতের কচি শসা খেতে পছন্দ করতেন। মুক্তিবাহিনীর ১নং সেক্টরের অধিনায়ক মেজর রফিকুল ইসলামের সঙ্গেও তার অনেক স্মৃতি আছে।

এপ্রিলের ১৫ তারিখে মুক্তিযুদ্ধে জেড ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান এসেছিলেন শ্রীনগর ‘বিওপি’তে ক্যাপ্টেন পি কে ঘোষকে অভিনন্দন  জানানোর জন্য, তখন তিনি প্রফেসর আলী নামে পরিচিত। জিয়া তার নতুন নামকরণ করেছেন ক্যাপ্টেন আলী। অধ্যাপক পদবিটি সম্ভবত মেজর জিয়ার পছন্দ ছিল না। এরপর থেকে মুক্তিযুদ্ধের বাকি সময় বিএসএফ-এর ক্যাপ্টেন পি কে ঘোষকে সবাই চিনতেন ক্যাপ্টেন আলী নামে।

মুক্তিযুদ্ধের পর মেজর পি কে ঘোষ একবারই বাংলাদেশে এসেছিলেন। ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে গাড়ি চালিয়ে সোজা চাঁদপুর এসে, সেখান থেকে স্টিমারে ঢাকা এসেছেন। তখন ভারতীয় সামরিক বাহিনী বাংলাদেশে ছিল। কাউকে কিছু না বলে ঢাকা থেকে তিনি টাঙ্গাইল গিয়েছেন। শহর থেকে দশ মাইল দূরে ফাজিলহাটি গ্রামে পৈত্রিক ভিটা দেখে এসেছেন। পরিচয় জেনে টাঙ্গাইলের এসডিও নিজের গাড়িতে করে মেজর ঘোষকে তার গ্রামের বাড়ি দেখিয়ে এনেছেন।

আশা করি, ’৭১-এর বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর বছরই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের এই নায়ক তার মাতৃভূমি বাংলাদেশে আসবেন আমাদের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা গ্রহণের জন্য।

লেখক : শাহরিয়ার কবির – কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা। সভাপতি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কম


সর্বশেষ - রাজনীতি