নারায়ণগঞ্জে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সকালে তৎকালীন ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একটি দল নারায়ণগঞ্জ কোর্টে অবস্থিত মালখানা থেকে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য যায়। মালখানার বাঙালি কর্মকর্তারাও সংগ্রামের পক্ষে ছিলেন। সে সময় কোর্টে কর্মরত নুরু মিয়া চৌধুরী বাচ্চু তাদের সহায়তা করেন। তারা ছাত্রদের বলেন, আমরা তোমাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে পারব না, তবে তোমরা লুট করে নিয়ে যাও; আমরা বাধা দেব না। ছাত্ররা মালখানা ভেঙে সেখান থেকে ১২১টি রাইফেল ও ৬ পেটি গুলি সংগ্রহ করেন। অস্ত্রগুলো প্রথমে ২নং রেলগেটসংলগ্ন রহমতুল্লাহ ক্লাবে জমা করা হয়; জায়গাটিকে নিরাপদ মনে না হলে পরে সেখান থেকে অস্ত্রগুলো দেওভোগ জনকল্যাণ সমিতিতে নিয়ে রাখা হয়। ওইদিন বিকেল থেকেই তারা দেওভোগ নাগবাড়ি মাঠে অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ শুরু করেন। ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেন সাধারণ জনতা।
২৫ মার্চ রাতেই ঢাকায় হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়ে যায়। ২৬ মার্চ সকাল থেকেই নারায়ণগঞ্জে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে- যে কোনো সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এখানে চলে আসবে এবং এখানেও তারা হত্যাযজ্ঞ চালাবে। ২৫ মার্চ দিনগত রাত থেকেই এখানে ব্যারিকেড স্থাপনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ আসার পথে নারায়ণগঞ্জের সব রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করা হয়। বড় বড় গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়। রেলস্টেশন থেকে ওয়াগন এনে চাষাঢ়া ও ২নং রেললাইনের ওপরে রাখা হয়। তখন মণ্ডলপাড়া ও সলিমুল্লাহ রোডের ২টি কারখানায় ১টি চিনিকলের জন্য ট্রলি তৈরি হচ্ছিল। ছাত্র-জনতা সেই ট্রলিগুলো এনে রাস্তায় ফেলে ডায়মন্ড হল মোড় থেকে চাষাঢ়া রেললাইন পর্যন্ত ব্যারিকেড তৈরি করে। বিক্ষুুব্ধ জনতা ফতুল্লা থেকে চাষাঢ়া পর্যন্ত রেললাইনের স্লিপার তুলে ফেলে; যাতে রেলপথেও পাকিস্তানি বাহিনী নারায়ণগঞ্জে প্রবেশ করতে না পারে। ওইদিন দুপুর থেকেই নারায়ণগঞ্জবাসী শহর ছাড়তে শুরু করে।
২৭ মার্চ ভোররাতে পাকিস্তানি বাহিনী ট্যাঙ্ক, কামান ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে ঢাকা থেকে রওনা হয়। তারা ব্যারিকেড তুলে নারায়ণগঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। রহমতুল্লা ক্লাব তখন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছিল। সকাল ১০টার দিকে ক্যাম্পে খবর আসে পাকিস্তানি সেনারা নারায়ণগঞ্জের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকার টিকাটুলী থেকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাগলা অঞ্চলে প্রথমে তারা এক নৈশপ্রহরীকে হত্যা করে। বেলা ১১টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী পঞ্চবটীর কাছাকাছি চলে আসে। এদিকে ছাত্রজনতা ৩ ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি গ্রুপ মাসদাইর কবরস্থানের কাছে অবস্থান নেয়, একটি গ্রুপ মাসদাইর খায়ের সাহেবের বাড়ির কাছে ও অপর গ্রুপটি চাষাঢ়ায় চাঁদমারী টিলাতে অবস্থান গ্রহণ করে- যাতে রেলপথেও তাদের প্রতিরোধ করা যায়। অন্যদিকে ছাত্রদের একটি দল অস্ত্র সংগ্রহ করতে থাকে। বিভিন্ন ব্যক্তি তাদের সংগ্রহে থাকা বন্দুক, পিস্তল রহমতুল্লা ক্লাব ক্যাম্পে এসে জমা দিতে থাকেন। বহু পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্য তাদের অস্ত্র দেশের যুদ্ধের জন্য ক্যাম্পে এসে জমা দেন।
পাকিস্তানি বাহিনী পঞ্চবটী থেকে শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে কবরস্থানের কাছে অবস্থান নেওয়া গ্রুপটি অতর্কিতে পাকিস্তানি বাহিনীর দিকে গুলি ছুড়তে থাকে। এতে একজন পাকিস্তানি সেনা গুলিবিদ্ধ হলে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি জিপ তাকে নিয়ে ঢাকায় রওনা হয়। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে পাকিস্তানি সেনারা সেখানেই থমকে যায় এবং তাদের রণকৌশল পরিবর্তন করে। ট্যাঙ্ক সামনে রেখে জিপ থেকে নেমে হামাগুড়ি দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। ছাত্রদের গ্রুপটি পেছনে হটতে থাকে এবং চাষাঢ়া এসে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি বাহিনী গুলি ছুড়তে ছুড়তে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। বিকেল ৩টার দিকে তারা মাসদাইর এলাকায় পৌঁছে গান পাউডার দিয়ে বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাড়িঘর থেকে ধরে এনে গুলি করে নির্বিচারে হত্যা করে নিরীহ সাধারণ মানুষকে। নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চলে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত।
লেখক : রফিউর রাব্বি – কলাম লেখক ও নাগরিক অধিকারকর্মী।