ছাব্বিশে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসের ঐতিহাসিক এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধাবনত মস্তকে স্মরণ করি। তিনি শুধু বাংলাদেশের নন, আন্তর্জাতিক বিশ্বের মহান নেতা ছিলেন। তিনি প্রথমে নিজেকে, পরে আওয়ামী লীগকে, এরপর বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে তৈরি করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি উপলব্ধি করেন- এই পাকিস্তান বাঙালির জন্য হয়নি। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিকেই হতে হবে।
বঙ্গবন্ধু জানতেন, ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না এবং তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করবেন। সেজন্য বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিকভাবে এগিয়েছেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে সারাদেশ সফর করে তিনি বাংলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেন। নির্বাচনের পরপরই ১৮ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ডেকে জাতীয় চার নেতার সামনে আমাদের চারজনকে- মনি ভাই (শেখ ফজলুল হক মনি), সিরাজ ভাই (সিরাজুল আলম খান), রাজ্জাক ভাই (আবদুর রাজ্জাক) ও আমাকে একটি ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন। ভারতে গেলে আমরা কোথায় আশ্রয় পাব, থাকব; সেজন্য আমাদের চার টুকরা কাগজ দিয়ে বলেছিলেন, মুখস্থ করো। কাগজে ঠিকানা লেখা ছিল- ‘সানি ভিলা, ২১ নং রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা।’ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ওই ঠিকানায় আমরা আশ্রয় গ্রহণ করি। অর্থাৎ বহু আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীনের পরিকল্পনা করেন। এই পরিকল্পনার ছক এঁকেছিলেন যখন তিনি ১৯৬৯-এর অক্টোবরে লন্ডন সফরে যান। সেখানে ভারতীয় প্রতিনিধি ফনীন্দ্র নাথ মুখার্জী, তথা পিএন মুখার্জী, যাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ‘মিস্টার নাথ’ বলে সম্বোধন করতাম- বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে লন্ডনে দেখা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভারত সরকারের ভূমিকা বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন। যেগুলো পরবর্তীকালে বাস্তবায়িত হয়। বঙ্গবন্ধু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে তবেই স্বাধীনতা ঘোষণা করার রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন করেন। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেও তিনি বিচক্ষণতার সঙ্গে বক্তব্য পেশ করেছেন। বঙ্গবন্ধু সব সময় চেয়েছেন তিনি আক্রান্ত হবেন, কিন্তু আক্রমণকারী হবেন না।
প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য এরকম একটি চূড়ান্ত ঘোষণায় পৌঁছতে বঙ্গবন্ধুকে দীর্ঘ ২৪ বছর বাঙালি জাতিকে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে লক্ষ্য স্থির করে, ধাপে ধাপে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনা করে, জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে, শাসকগোষ্ঠীর সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, জেল-জুলুম-হুলিয়া-ফাঁসির মঞ্চকে উপেক্ষা করে মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়েছে। বহু বছর ধরে, অগণিত মানুষের আত্মদানের মধ্য দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতি প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণাকে শিরোধার্য জ্ঞান করেছে। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ঘোষণাই ১৯৭১-এর এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ কর্তৃক গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ৬ নম্বর প্যারায় অনুমোদিত হয়ে সাংবিধানিক বৈধতা অর্জন করেছে। বঙ্গবন্ধুর ওই স্বাধীনতার ঘোষণাই ২৬ মার্চ দুপুর দেড়টায় চট্টগ্রাম বেতার থেকে এমএ হান্নানের কণ্ঠে বারবার প্রচারিত হয়েছে। ইয়াহিয়া খান ২৬ মার্চের ভাষণে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করে একজন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘সপ্তাহখানেক আগেই আমার উচিত ছিল শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। …কেননা, কয়েকটি শর্ত দিয়ে সে আমাকে ট্র্যাপে ফেলতে চেয়েছিল। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সে আক্রমণ করেছে- এই অপরাধ বিনা শাস্তিতে যেতে দেওয়া হবে না।’ এবং এই একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধেই রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে সামরিক আদালতে বিচার হয়। সামরিক শাসক কতটা প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিল যে, আমার মতো একজন ক্ষুদ্র কর্মীকেও আমার অনুপস্থিতিতে সামরিক আদালতে বিচার করল। ১৯৭১-এর ২০ এপ্রিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান, আবিদুর রহমান ও আমাকে মার্শাল ল কোর্টে হাজির হওয়ার নির্দেশ জারি করা হয়। পরে ২৭ এপ্রিল আমাদের অনুপস্থিতিতে ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড, অর্ধেক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। এখন বিভিন্নজন বিভিন্নরকম দাবি করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছাড়া আমরা ছাত্রলীগের কেউ কিছু করতে পারিনি। কোনো কিছু বঙ্গবন্ধুর অনুমোদন ছাড়া হয়নি।
১৯৭১-এর মার্চের ১ তারিখে দুপুর ১টা ৫ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণে ৩ মার্চ ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত করেন। পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা বক্তব্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা নগরীসহ সমগ্র বাংলাদেশ। এদিন হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় ৬ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছিল। অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ মানুষ হোটেল পূর্বাণীর সামনে এসে সমবেত হয় এবং স্লোগানে স্লোগানে চারদিক প্রকম্পিত করে তোলে। বঙ্গবন্ধু হোটেলের সামনে এসে সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘অধিবেশন বন্ধ করার ঘোষণায় সারাদেশের জনগণ ক্ষুব্ধ। আমি মর্মাহত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। আমি সংগ্রাম করে এ পর্যন্ত এসেছি। সংগ্রাম করেই মুক্তি আনব। আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকুন।’ এরপর আসে বাঙালির ইতিহাসের পরম কাঙ্ক্ষিত দিন ৭ মার্চ। সেদিন ছিল রোববার। সংগ্রামী বাংলা সেদিন অগ্নিগর্ভ, দুর্বিনীত। বঙ্গবন্ধু যখন ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে বক্তৃতা শুরু করেন জনসমুদ্র পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে ডুবে যায়। সেদিন নেতার বক্তৃতার শেষাংশ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বস্তুত এটাই ছিল বীর বাঙালির জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা।
আজ সেই ঐতিহাসিক ভাষণ জাতিসংঘের ইউনেস্কো ঘোষিত ‘বিশ্বঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল’ হিসেবে বিশ্বসভায় স্বীকৃত। দেশ স্বাধীন করে জাতির পিতা তার জীবনের প্রথম লক্ষ্য পূরণ করেছেন। কিন্তু তার দ্বিতীয় লক্ষ্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি, যা তিনি শেষ করতে পারেননি। সেই লক্ষ্য পূরণে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ আজ আন্তর্জাতিক বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। আমি সর্বান্তকরণে কামনা করি, জাতির পিতার আরাধ্য স্বপ্নের বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাওয়ার মহতী যাত্রা অব্যাহত রাখবে।
লেখক : তোফায়েল আহমেদ: আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। tofailahmed69@gmail.com