শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ, শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের ঘরে। নানা শেখ আবদুল মজিদ আদরের নাতির নাম শেখ মুজিবুর রহমান রাখলেও বাবা-মার কাছে ছিলেন ‘খোকা’।
ইতিহাসের মহানায়ক হয়ে ওঠা এই খোকা ছেলেবেলায় কেমন ছিলেন, তার কিছু বিবরণ পাওয় যায় বঙ্গন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে।
তিনি লিখেছেন, “১৯৩৪ সালে যখন আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি তখন ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। ছোট সময়ে আমি খুব দুষ্ট প্রকৃতির ছিলাম। খেলাধুলা করতাম, গান গাইতাম এবং খুব ভালো ব্রতচারী করতে পারতাম।”
পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে সবার আদর পাওয়ার বিষয়ে তিনি লিখেছেন, “আব্বার কাছে থেকেই আমি লেখাপড়া করি। আব্বার কাছেই আমি ঘুমাতাম। তাঁর গলা ধরে রাতে না ঘুমালে আমার ঘুম আসত না। আমি বংশের বড় ছেলে, তাই সমস্ত আদর আমারই ছিল।”
স্বভাবে দুরন্ত হলেও ছোটবেলায় নানা রোগও তাকে কম ভোগায়নি। শৈশবে বেরিবেরি রোগ হওয়ার পর হৃদযন্ত্র হয়ে পড়েছিল দুর্বল, ১৯৩৬ সালে গ্লুকোমা হওয়ায় অস্ত্রোপচারের পর চোখে উঠেছিল চশমা। বেশকিছুদিন পড়াশোনা বন্ধ থাকে। পরে ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি হন তিনি।
“রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা যান। তারপর সে আমার মা’র কাছে চলে আসে। আমার ভাইবোনদের সাথেই রেণু বড় হয়।”
গত শতকের ত্রিশের দশকের মধ্যেই স্বদেশী আন্দোলন দেখে ইংরেজবিরোধী মনোভাব জেগে ওঠে বালক শেখ মুজিবের মনে।
বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “চোখের চিকিৎসার পর মাদারীপুর ফিরে এলাম, কোনো কাজ নেই। লেখাপড়া নেই, খেলাধুলা নেই, শুধু একটা মাত্র কাজ, বিকালে সভায় যাওয়া। তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ।…ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হল। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম।”
পরে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ বিভাজনে মুসলিম লীগের প্রতি ঝুঁকে পড়েন শেখ মুজিব। সারাজীবন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী রাজনীতির ভক্ত ছিলেন।
গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুল, মিশনারি স্কুলে পড়াশোনার সময়ই রাজনীতির দীক্ষা হয়ে যায় শেখ মুজিবুর রহমানের।
১৯৩৮ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গোপালগঞ্জ সফরে এলে তাদের সংবর্ধনা দেওয়া তার নেতৃত্বে। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আলাপ ওই সময়ই।
“হক সাহেব পাবলিক হল দেখতে গেলেন। আর শহীদ সাহেব গেলেন মিশন স্কুল দেখতে। আমি মিশন স্কুলের ছাত্র। তাই তাকে সম্বর্ধনা দিলাম। তিনি স্কুল পরিদর্শন করে হাঁটতে হাঁটতে লঞ্চের দিকে চললেন, আমিও সাথে সাথে চললাম। তিনি ভাঙা ভাঙা বাংলায় আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছিলেন, আর আমি উত্তর দিচ্ছিলাম।”
ওই আলাপের পর শেখ মুজিবের নাম-ঠিকানা লিখে নেন সোহরাওয়ার্দী। পরে কিশোর মুজিবুর রহমানকে চিঠিও লেখেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। চলে পত্র যোগাযোগ।
এর আগে স্কুলে পড়ার সময়ই ‘মুসলিম সেবা সমিতির’ সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেন শেখ মুজিবুর রহমান। সমিতির পক্ষ থেকে মুসলমান বাড়ি থেকে সংগৃহীত মুষ্টিভিক্ষার চাউলের অর্থ দিয়ে গরিব ছাত্রদের পড়ালেখাসহ অন্যান্য খরচের জোগান দেওয়া হত।
এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “…আব্বা কাজী আবদুল হামিদ এমএসসি মাস্টার সাহেবকে আমাকে পড়াবার জন্য বাসায় রাখলেন। তার জন্য একটা আলাদা ঘরও করে দিলেন। গোপালগঞ্জের বাড়িটা আমার আব্বাই করেছিলেন। মাস্টার সাহেব গোপালগঞ্জে একটা ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করেন, যার দ্বারা গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন। মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠাতেন সকল মুসলমান বাড়ি থেকে। …যদি কোন মুসলমান চাউল না দিত আমার দলবল নিয়ে তার উপর জোর করতাম। দরকার হলে তার বাড়িতে রাতে ইট মারা হত। এজন্য আব্বার কাছে অনেক সময় শাস্তি পেতে হত। আমার আব্বা আমাকে বাধা দিতেন না।”
১৯৩৯ সালে কলকাতায় বেড়াতে গিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “১৯৩৯ সালে কলকাতা যাই বেড়াতে। শহীদ সাহেবের সাথে দেখা করি। আবদুল ওয়াসেক সাহেব আমাদের ছাত্রদের নেতা ছিলেন। তাঁর সাথেও আলাপ করে তাঁকে গোপালগঞ্জে আসতে অনুরোধ করি। শহীদ সাহেবকে বললাম, গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করব এবং মুসলিম লীগও গঠন করব। খন্দকার শামসুদ্দীন সাহেব এমএলএ তখন মুসলিম লীগে যোগদান করেছেন। তিনি সভাপতি হলেন ছাত্রলীগের। আমি হলাম সম্পাদক। মুসলিম লীগ গঠন হল। একজন মোক্তার সাহেব সেক্রেটারি হলেন, অবশ্য আমিই কাজ করতাম মুসলিম লীগ ডিফেন্স কমিটি একটা গঠন করা হল। আমাকে তার সেক্রেটারি করা হল। আমি আস্তে আস্তে রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ করলাম।”
অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগের ফরিদপুর জেলা ও প্রাদেশিক কাউন্সিলরও হন তিনি। বেঙ্গল মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন এক বছরের জন্য ১৯৪১ সালে। ওই বছরই তিনি দুই বার সাময়িকভাবে গ্রেপ্তার হন।
১৯৪২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমানে মৌলানা আজাদ কলেজ) ভর্তি হন শেখ মুজিব। তার রাজনৈতিক তৎপরতা বাড়তে থাকে। কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হন ১৯৪৬ সালে। ১৯৪৭ সালে এই কলেজ থেকেই তিনি স্নাতক ডিগ্রি নেন।
ভারত এবং পাকিস্তানের পাশাপাশি তৃতীয় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৪৭ সালে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন শেখ মুজিব। এই উদ্যোগ ব্যর্থ হলেও পরবর্তীতে এটাই তার স্বপ্নের রাষ্ট্র গড়ার ভিত্তি গড়ে দেয়।