রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তরে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সাত বছর পার হলো। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর-এর বিপথগামী সদস্যরা ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। বিদ্রোহী সদস্যদের হাতে বিডিআর মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদও নিহত হন। বিদ্রোহীদের হাত থেকে রেহাই পাননি ডিজির স্ত্রী, বাসার কাজের মেয়ে এবং বেড়াতে আসা আত্মীয়স্বজনও। প্রায় চার বছর বিচারকার্য চলার পর আদালত সংশ্লিষ্টদের সাজা প্রদান করে রায় দেয়া হয় এবং চূড়ান্ত রায় দেয়া হয় ২০১৭ সালে। রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদন্ডাদেশ বহাল রেখে ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন ও ১৯৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয় হাইকোর্ট।
বিডিআর হত্যাকাণ্ডে নিহতদের পরিবারের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে সরকার বেশকিছু সহযোগিতামূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উদ্যোগ উল্লেখ করা হলঃ
১. শহীদ পরিবার সহায়তা কেন্দ্রঃ
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পরই সেনা সদরদপ্তরের তত্ত্বাবধানে শহীদ পরিবারদের সকল ধরনের সহযোগিতা প্রদানে শহীদ পরিবার সহায়তা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০ অক্টোবর ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত শহীদ পরিবারদের সহযোগিতা প্রদানে কেন্দ্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন। ইতোমধ্যে তাদের পেনশন ও সংশ্লিষ্ট সকল প্রাপ্য প্রদান করা হয়েছে।
২. প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব তহবিল থেকে প্রত্যেক পরিবারকে দশ লক্ষ টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে।
৩. প্রত্যেক পরিবারকে সেনাবাহিনী কল্যাণ তহবিল থেকে ৪. লক্ষ টাকা অনুদান দেয়া হয়।
৫. প্রত্যেক পরিবার সেনাবাহিনী পরিবার নিরাপত্তা প্রকল্প থেকে আট লক্ষ টাকা করে পেয়েছে।
৬. বিডিআর তহবিল থেকে পরিবার প্রতি ৫০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়।
৭. সকল পরিবার কর্মকর্তাদের কল্যাণ তহবিল থেকে নির্দিষ্ট ভাতা পাচ্ছেন।
৮. ব্যাংকারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ থেকে পরিবার প্রতি দশ বছর মেয়াদে মাসে ৪০ হাজার টাকা ভাতা প্রদান করা হচ্ছে।
৯. ট্রাস্ট ব্যাংক মিউচুয়াল ফান্ড প্লেসমেন্টের ২ লক্ষ টাকা মূল্যের শেয়ার পেয়েছে ৫৬ পরিবার।
১০. প্রত্যেক পরিবার সিএসডি ডিসকাউন্ট কার্ড সহ ২১ হাজার ৩ শ টাকার নিত্য ব্যবহার্য পণ্য পাচ্ছেন।
১১. মৃত্যু পরবর্তি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নে পরিবার প্রতি ২০ হাজার টাকা অনুদান প্রদান করা হয়।
১২. শহীদ পরিবারের সদস্যদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ভর্তি ও টিউশন ফি মওকুফ করা হয়েছে।
১৩. ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ জন এবং সেনাবাহিনী পরিচালিত বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে ৪০ জন শহীদ পরিবারের সদস্যের ভর্তি ফি ও টিউশন ফি ছাড়া অধ্যয়ন করছেন। এছাড়া ৩২ জন বিভিন্ন প্রাইভেট স্কুল ও কলেজে ভর্তি ও টিউশন ফি ছাড়া অধ্যয়ন করছেন। ৯ জনকে বিভিন্ন ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করা হয়েছে।
১৪. আগ্রহী ৪৬ শহীদ পরিবার বিভিন্ন সেনানিবাসে বসবাসের সুবিধা পেয়েছেন। অপর ১১ পরিবার সেনানিবাসে বসবাসে আগ্রহী ছিলেন না। বর্তমানে ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স কোয়ার্টারে ৬ জন এবং স্বপ্নচূড়ায় ৯ পরিবার বসবাস করছে।
১৫. যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ দূতাবাসে ২ জন, অস্ট্রেলিয়ায় ১ জন সহ শহীদ পরিবারের ৩১ জনকে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
১৬. সকল শহীদ পরিবার সিএমএইচে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন।
১৭. ৫৮ শহীদ পরিবারের ১১ জন
ইতোমধ্যে ডিওএইচএস ও রাজউকের প্লট পেয়েছেন এবং অপর ৪৭ জন মিরপুর ডিওএইচএসে প্লটের এলটমেন্ট পেয়েছেন।
৬ শহীদ পরিবারকে ডিওএইচএসে দুটি করে ফ্ল্যাট দেয়া হয়েছে।
পুনরায় বিবাহ করা চার পরিবার একটি ফ্ল্যাট পেয়েছেন।
১৮. সকল শহীদ পরিবার সেনাবাহিনী আবাসন প্রকল্পে প্লট, সাভারের খেজুরটেকে একটি ফ্ল্যাট ও জলসিঁড়িতে প্লট পেয়েছেন।
১৯. সকল পরিবার গৃহে টেলিফোন সংযোগ পেয়েছেন।
২০. সকল পরিবারের মিল্ক কুপন কার্ড হালনাগাদ নবায়ন করা হয়েছে।
২০. ১৫ পরিবারের ব্যাংক থেকে গৃহীত গৃহনির্মাণ ঋণের আসল ও সুদ মওকুফ করা হয়েছে এবং তিন পরিবারের বাণিজ্যিক ঋণ মওকুফ করা হয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিচার সম্পন্ন করা ছাড়াও নিহতদের পরিবারের জন্য যত সহযোগিতাই দেয়া হোক না কেন, ৫৭ জন চৌকস সামরিক কর্মকর্তার অভাব অপূরণীয়। তবে সরকারের আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে একটি বিশেষ গোষ্ঠী ঘটনার অব্যবহিত পরে “কিছু প্রাণী মারা গেছে” বা “বিডিআর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে” ইত্যাদি মন্তব্য করে যে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছিল, তেমনিভাবে এখনো উইকিলিকসের নাম ব্যবহার করে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অপপ্রচার চালিয়ে অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। ধারণা করা কঠিন নয় যে, উইকিলিকসে এ ঘটনার নেপথ্যে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির যে উৎসের কথা অনুমান করা হয়েছে, তাদের সহযোগীরাই এ নারকীয় হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। কারা এ মর্মান্তিক ঘটনার সময় আত্মগোপন করেছিল, কারা এ ঘটনার হোতাদের নিয়োগ দিয়েছিল এবং কারা হত্যাযজ্ঞের হোতাদের রক্ষায় দলীয় আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছিল তা এখন আর গোপন কিছু নয়। কিন্তু তারপরও আমরা মনে করি মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে বীর শহীদদের অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। ব্যক্তিগত ও হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে ঘৃণাকে, যার অবসান জরুরি। আমাদের চৌকস ও বীর সেনানীরা যে আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, সেটিই আমাদের কাছে ভবিষ্যতের পাথেয় হয়ে থাকবে।