দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ১০ শতাংশ হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি। এ লক্ষ্য অর্জনে সৌরশক্তি সর্বাধিক কাজে লাগানোকে প্রধান হিসেবে ধরা হয়েছিল। ২০২১ সালের মধ্যে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারের প্রচেষ্টা থাকলেও মূলত জমির স্বল্পতার কারণে তা সফল হয়নি। তবে লক্ষ্য অর্জনে কাজ চলছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাদে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। আর বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে ৪ শতাংশের কম।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রচলিত উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে, তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং কয়লা। এই তিনটিই হচ্ছে জীবশ্ম জ্বালানি। এগুলো জলবায়ু পরিবর্তনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। তাই বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় পুরো বিশ্বই এখন বিকল্প হিসেবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
দেশেও বিদ্যুত্সংকট মোকাবেলায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিলেও এখনো তেমন সাফল্য আসেনি। জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি ও গবেষণা শাখা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন গতকাল বলেন, ‘বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের বাস্তবতায় আমাদের মূল অগ্রাধিকার সৌরভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো। এতে আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হলো জমির স্বল্পতা, অন্যটি হলো পর্যাপ্ত সূর্যের আলো। দিনের বেলা সূর্যের তাপে সোলার থেকে বিদ্যুৎ পেলেও রাতের বেলা বিকল্প উৎস থেকে বিদ্যুৎ পাওয়ার বিষয়টি মাথায় নিয়েই আমরা কাজ করছি।’
মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘আমাদের অনাবাদি খাসজমি ও সরকারি-বেসরকারি ভবনের ছাদ এবং শিল্প-কারখানার ছাদে সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছি। সেচের অনেক পাম্পকে এরই মধ্যে সোলারের আওতায় আনা হয়েছে, বাকি সেচ পাম্পগুলোকেও সোলারে রূপান্তর করতে কাজ করছি।’ তিনি জানান, মোট উৎপন্ন বিদ্যুতের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও তা জমিস্বল্পতার কারণে অর্জন সম্ভব হয়নি।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যানে (পিএসএমপি) নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে গত ২০২১ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ১০ শতাংশে পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। সৌরশক্তি সর্বাধিক কাজে লাগানোকে প্রধান হিসেবে ধরা হয়েছিল।
টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে ৯৫৮.৪৫ মেগাওয়াট, যা দেশে মোট উৎপন্ন বিদ্যুতের ৩.৮৩ শতাংশ। শুধু সৌরশক্তি থেকেই উৎপন্ন হচ্ছে ৭২৪.৪৬ মেগাওয়াট। এ ছাড়া হাইড্রো থেকে ২৩০ মেগাওয়াট, বায়ু থেকে আসছে ২.৯ মেগাওয়াট, বায়োগ্যাস থেকে আসছে .৬৯ মেগাওয়াট ও বায়োম্যাস থেকে আসছে .৪ মেগাওয়াট।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘আগামী বছরের মাঝামাঝিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আরো দুই হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এর সঙ্গে ৫০০ মেগাওয়াট যুক্ত হলেই আমাদের লক্ষ্য পূরণ হবে।’ নসরুল হামিদ বলেন, ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদন বাড়াতে স্বল্প, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। ২০৪১ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশই নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। সেই লক্ষ্যেই কাজ করা হচ্ছে।’
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যানশিয়াল অ্যানালিসিসের (আইইএফএ) জ্বালানি বিশ্লেষক শফিকুল আলম বলেন, ‘নিজস্ব জ্বালানির নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ব্যাপকভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াচ্ছে বিভিন্ন দেশ। বাংলাদেশের বাস্তবতায় আর্থিক দিক বিবেচনা করলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বৃহৎ আকারে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো উচিত। সেই সঙ্গে জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষতা বাড়াতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমানে গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে শিল্প-কারখানার যে খরচ হচ্ছে, রুপটফ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ব্যবহার করলে তা অনেক খরচ কম হচ্ছে। বড় শিল্প-কারখানাগুলোতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে খরচ হচ্ছে ৯ টাকা ৩২ পয়সা এবং যেসব শিল্প-কারখানায় রুপটফ সোলার থেকে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে তাদের প্রতি ইউনিটে খরচ হচ্ছে গড়ে সাড়ে পাঁচ টাকা থেকে সাড়ে ছয় টাকা। তাই শিল্প-কারখানাগুলোকে রুফটপ ব্যবহারে বেশি উৎসাহিত করা উচিত।’
আইইএফএর এই জ্বালানি বিশ্লেষক বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে মোট উৎপাদনের ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদন করতে গেলে প্রচুর জমির প্রয়োজন হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারের লক্ষ্যে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের জমি পাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের সহায়তা করতে হবে। সোলারের জন্য এখন ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে চায় না, ঋণ পাওয়ার ব্যাপারেও সরকারের সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। সোলারের প্রসার বাড়াতে ইনভার্টারের ওপর ভ্যাট বাতিল করা উচিত।’
সৌর প্যানেলের দাম কমছে ৮৮ শতাংশ : আন্তর্জাতিক রিনায়েবল এনার্জি এজেন্সির (আইআরইএনএ) তথ্য মতে, বিশ্ববাজারে ২০১০ সাল থেকে ২০২১ সালের তুলনায় সৌর প্যানেলের দাম ৮৮ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।