1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলন

ডা. এস এম ইয়ার ই মাহাবুব : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
সোমবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের যুদ্ধের বহু পূর্বেই বাঙালি জাতির আরেক অধিকার আদায়ের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। নিজের মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়া এবং সেই অধিকারকে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে ফিরে পাওয়ার মানব-ইতিহাসের একমাত্র ঘটনা ছিলো এই আন্দোলন। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার জন্য ঐতিহাসিক এই আন্দোলন, যা ভাষা আন্দোলন নামেই সমধিক পরিচিত, তাতে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

তিনি ছিলেন আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা, যার লক্ষ্য ছিলো বাংলা ভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে তৎকালীন সময়ে স্বীকৃতি দেওয়া।

১৯৫২ সালে যখন পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে উর্দুই হবে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, সেসময় পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক প্রতিবাদ ও ক্ষোভের জন্ম দেয় মানুষের মধ্যে। শেখ মুজিব আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কণ্ঠস্বর ছিলেন, যিনি বাংলাকে অন্যতম সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি এবং বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর সমান অধিকারের আহ্বান জানিয়েছিলেন।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে পুলিশ গুলি চালায়, এতে সালাম বরকত রফিক সহ বেশ কয়েকজন ছাত্র নিহত হন এবং অনেকে আহত হন। এই হত্যাকাণ্ড ও গণআন্দোলন, যা এখন ভাষা আন্দোলন দিবস হিসাবে পরিচিত, বাংলা ভাষার অধিকারের সংগ্রামে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত হয়ে রয়েছে এবং এটি জাতি হিসাবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম নেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসাবে বিবেচিত হয়।

ভাষা আন্দোলনের সময় শেখ মুজিব তখন ৩২ বছরের যুবক। এই আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ও আন্দোলনকে সুসংগঠিত করার কারণে তাঁকে কয়েকবার গ্রেপ্তার ও কারাবরণ করতে হয়, কিন্তু তিনি বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর অধিকারের জন্য অবিরত লড়াই চালিয়ে যান। তাঁর ভাষায় ‘৫২ সালের ভাষা আন্দোলন শুধু বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলন ছিল না, এই আন্দোলন ছিল বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির আন্দোলন’।

তিনি তাঁর বিশ্বাসকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সংকল্প থেকে ৫২র সেই চেতনাকে বুকে ধারণ করে তাকে আরও পরিপুষ্ট করে ১৯৭১ সালে এক রক্তাক্ত যুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে পাকিস্তানের পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতা আদায় করে ছাড়েন আর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, জাতির পিতা এবং এর প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি এবং বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর সমানাধিকারের জন্য লড়াই করেন। এই সময়ের মধ্যে তার সাংগঠনিক নেতৃত্ব বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়কে বৈশ্বিক পরিসরে পরিপূর্ণ রূপ দিতে এবং দেশের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে তাঁর ভবিষ্যৎ ভূমিকার জন্য মঞ্চ তৈরি করতে সহায়তা করেছিল। এই ঐতিহাসিক আন্দোলনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদানসমূহ স্বল্প পরিসরে লিখে শেষ করা যাবে না। তারপরও কয়েকটি ব্যাপারে আলোচনা করা প্রয়োজন।

আজন্ম নেতৃত্ব গুণাবলীর অধিকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির স্বাধিকার আদায়ের অন্যতম প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি কথা বলার অধিকারের সংগ্রামে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীকে অনুপ্রাণিত ও নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিনি বিশাল সমাবেশে জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেন, দেশব্যাপী প্রতিবাদের আয়োজন করেন, পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানান।

জনগণকে সংগঠিত করার অদ্ভুত গুন ছিল তাঁর। শেখ মুজিব বাংলাভাষী জনগণকে সংগঠিত করতে এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। তিনি তাঁর ক্যারিশমা এবং নেতৃত্বের দক্ষতা ব্যবহার করে ছাত্র, বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণ নাগরিকদের এক ছাতার নিচে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র সরকারি ভাষা করার সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর জন্য সমান অধিকারের দাবি জানান। বাঙালির সংস্কৃতি ও পরিচয় রক্ষার জন্য বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে তিনি পাকিস্তান সরকারকে বাধ্য করেছিলেন।

দেশ ও নিপীড়িত জনগণের জন্য নিঃস্বার্থ ভালোবাসার বিচারে বঙ্গবন্ধুর তুলনা বাংলাদেশ ও বিশ্বে বিরল। এই আন্দোলনের জন্য তিনি কয়েকবার গ্রেফতার ও কারাবরণ করেন। তিনি বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রামের প্রতীক হয়ে ওঠেন এবং পুরো জাতিকে এই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করেন। বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয় গঠনের একটি বিশেষ মুহূর্ত হিসাবে বিবেচিত হয় এবং শেখ মুজিব এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসাবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আন্দোলনে তাঁর অবদান তাঁকে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা পিতা এবং প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর ভূমিকার ভিত্তি স্থাপনে সাহায্য করেছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের জন্য বেশ কয়েকবার নিজের জীবনকে বিপণ্ন করেছিলেন। প্রথমেই আসে তাঁর গ্রেফতার ও কারাবরণের প্রসঙ্গ। ভাষা আন্দোলনের সময় তার ভূমিকার জন্য শেখ মুজিব বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হন এবং কারাবরণ করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক আবহাওয়া অত্যন্ত অস্থির ছিল এবং অনেক রাজনৈতিক কর্মী সরকারের দমন-পীড়ন ও সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছিল।

শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের বেশিরভাগ সময় জুড়ে ছিল পাকিস্তান সরকার ও তাদের পেটোয়া বাহিনীর হাতে নির্মম নির্যাতন নিপীড়ন। তিনি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মীরা বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করার সময় পাকিস্তান সরকার কর্তৃক মারাত্মক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালে একটি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়, এতে বেশ কয়েকজন ছাত্র নিহত হন এবং অনেকে আহত হন।

শেখ মুজিব এবং অন্যান্য নেতাকর্মীরা এসব অনুষ্ঠানে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই অংশগ্রহণ করেন। তাছাড়া ভাষা আন্দোলনের সময় শেখ মুজিবের সক্রিয় অংশগ্রহণ তাঁর রাজনৈতিক জীবনকে হুমকির মুখে ফেলতে পারত। তিনি সেই সময়ে একজন উঠতি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং আন্দোলনে তাঁর সম্পৃক্ততা তাঁর ভবিষ্যত রাজনৈতিক সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারত। কিন্তু এসব ঝুঁকি শেখ মুজিবকে তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।

১৯৫২ সালের বাংলা ভাষার আন্দোলনে অংশগ্রহণের ফলে বঙ্গবন্ধুশেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করেছিলেন। তাঁর আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল সরকারি ভাষা হিসেবে উর্দুকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি। পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি আদায়ের মাধ্যমে তিনি তাঁর সেই লক্ষ্য পূরণ করেছিলেন। এটি ছিল তাঁর অক্লান্ত আন্দোলন ও সাংগঠনিক প্রচেষ্টার ফসল এবং এটি ছিল বাঙালি সংস্কৃতি ও স্বকীয়তা রক্ষায় একটি বড় মাইলফলক।

ভাষা আন্দোলনের সময় শেখ মুজিবের সাংগঠনিক দক্ষতা তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছিল। তাঁর ক্যারিশমা, নেতৃত্বের দক্ষতা, কোটি কোটি মানুষকে সংগঠিত করার ক্ষমতা তাঁকে ব্যাপক জনপ্রিয় করে তুলেছিল এবং তিনি পূর্বপাকিস্তানের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হন। তাছাড়া এই আন্দোলন তাঁকে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর ভবিষ্যত ভূমিকার ভিত্তি তৈরি করতে সাহায্য করেছিল। তাঁর অবদান বাংলাদেশের মানুষ চিরকাল স্মরণ করবে। ৭১ আর ৫২ সালে তাঁর ভূমিকা তাঁকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসাবে অমর করে রাখবে। তাঁর এই আন্দোলনের আবেদন আজ দেশের সীমানা পেরিয়ে বৈশ্বিক মাত্রা পেয়েছে।

সেই প্রতিকূল সময়ে তিনি তাঁর ও পরবর্তী প্রজন্মকে নিজের ভাষা অধিকার ও সংস্কৃতিকে সংরক্ষণের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। এখন তাঁর সেই চেতনাকে বিশ্বব্যাপী স্মরণ করা হয় আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসাবে। অপশক্তির বিরুদ্ধে তাঁর নেতৃত্ব এবং সাহসিকতা বাংলাদেশ সহ সারা পৃথিবীতে অসংখ্য মুক্তিকামী মানুষের কাছে আজও অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে চলেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে আমরা আজ বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারতাম না। আর স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে মুক্ত আলো বাতাসে দম ভরে শ্বাস নিতে পারতাম না। ৫২র আন্দোলনের অগ্নিস্ফূলিঙ্গটি বঙ্গবন্ধুর অফুরন্ত প্রাণশক্তির বলে বলীয়ান হয়ে একাত্তরে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের বিশাল অগ্নিশিখায় পরিণত হয়। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, বাংলাভাষী মানুষ থাকবে, ততদিন এই শিখা পৃথিবীর মানুষকে স্বাধীনতার আলো বিলিয়ে যাবে।

লেখক : ডা. এস এম ইয়ার ই মাহাবুব – ইন্টারভেনশনাল ও ক্লিনিক্যাল কার্ডিওলজিস্ট, সহযোগী অধ্যাপক, বিএসএমএমইউ


সর্বশেষ - রাজনীতি