1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

আমেরিকায় ঋণসংকট এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট

নিরঞ্জন রায় : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শুক্রবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে আইএমএফ (ইন্টারন্যাশনাল মানিটরি ফান্ড) বাংলাদেশের পক্ষে ৪.৭০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ মঞ্জুর করেছে এবং এরই মধ্যে এই ঋণের প্রথম কিস্তি ৪৭৬ মিলিয়ন ডলার ছাড়ও করেছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও কিছু আশার কথা শুনিয়েছেন এই বলে যে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই সংকট কেটে যাবে, ডলার সমস্যাও থাকবে না, বৈদেশিক মুদ্রার রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পাবে এবং এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলা নিয়ে কোনো সমস্যা থাকবে না। সুতরাং আশা করা যায় যে কয়েক মাস ধরে চলা আর্থিক সংকট খুব সহসাই কেটে যাবে। কিন্তু বাস্তবতার দিকে তাকালে আর এই আশাবাদ ধরে রাখতে পারি না। বিশেষ করে বিশ্বরাজনীতি এবং বিশ্ব অর্থনীতি যেভাবে নানা বাঁকে মোড় নিতে শুরু করেছে, তাতে দ্রুত আর্থিক সংকট কেটে যাওয়ার ব্যাপারে আশবাদী থাকা কষ্টকর। আমার আগের অনেক লেখায় স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছি যে এবারের বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকট অর্থনীতির কারণে নয়, বরং রাজনৈতিক কারণে দেখা দিয়েছে। অর্থনীতির কারণে সৃষ্ট সংকট অর্থনীতির নিয়মেই একটি নির্দিষ্ট সময় পরে কেটে যায়। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে সৃষ্ট সংকট কাটার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট খুব সহসা কেটে যাওয়ার কোনো লক্ষণ আপাতত নেই। এর সঙ্গে নতুন যোগ হয়েছে আমেরিকার ঋণসংকট।

আমেরিকার সরকারের গৃহীত ঋণের পরিমাণ এরই মধ্যে রাষ্ট্রীয় ঋণ গ্রহণের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছে। আমেরিকার ট্রেজারি সেক্রেটারির ঋণ গ্রহণের স্বাধীনতা থাকলেও ইচ্ছামতো যেকোনো পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করতে পারেন না। আমেরিকার সরকার কী পরিমাণ ঋণ নিতে পারবে তার একটি সর্বোচ্চ সীমারেখা বা সিলিং আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে। রাষ্ট্রীয় ঋণের এই সর্বোচ্চ সীমা কংগ্রেস থেকে অনুমোদন করাতে হয়। কংগ্রেসের সর্বশেষ অনুমোদন অনুযায়ী আমেরিকার সরকারি ঋণের সর্বোচ্চ সীমা হচ্ছে ৩১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার, যার পুরোটাই নেওয়া হয়ে গেছে। এখন নতুন করে ঋণ নেওয়ার সুযোগ আর ট্রেজারি সেক্রেটারির হাতে নেই। গত ১৯ জানুয়ারি আমেরিকার বর্তমান ট্রেজারি সেক্রেটারি জ্যানেট ইয়েলেন জানিয়ে দিয়েছেন যে আমেরিকার সরকারি ঋণের পরিমাণ এরই মধ্যে সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছে। এখন অত্যাবশ্যক সরকারি ব্যয় নির্বাহের জন্য তাঁকে কিছু বিশেষ কৌশলী ব্যবস্থার আশ্রয় নিতে হবে, যা মূলত সরকারি হিসাব-নিকাশের মারপ্যাঁচ ছাড়া আর কিছুই নয়। যেমন—সরকারি কর্মকর্তাদের পেনশন ফান্ডে অর্থ জমা বন্ধ রেখে ট্রেজারি বন্ডের ওপর সুদ প্রদান অব্যাহত রাখা, যাতে খেলাপির খাতায় নাম না লেখাতে হয়। ট্রেজারি সেক্রেটারির এই বিশেষ ব্যবস্থাও যখন শেষ হয়ে যাবে তখন তাঁকে উদ্বৃত্ত বাজেটের দিকে হাঁটতে হবে, যার অর্থ হচ্ছে যতটুকু রাজস্ব আদায় হবে সেটা দিয়ে যে পরিমাণ ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব তা-ই করতে হবে। বর্তমানে অর্থনীতির যে কাঠামো, বিশেষ করে আমেরিকার মতো দেশে যেখানে ঋণই হচ্ছে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, সেখানে উদ্বৃত্ত বাজেট নিয়ে চলা বাস্তবসম্মত কোনো পদক্ষেপ হতে পারে না। তা ছাড়া আমেরিকার ফেডারেল বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৪.৬ শতাংশ, সুতরাং তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয় যে ট্রেজারি সেক্রেটারি আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে উদ্বৃত্ত বাজেট দিয়েই চলার চেষ্টা করবেন, তাহলে আমেরিকার অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে প্রায় ৪.৬ শতাংশ হারে, যা অর্থনীতির জন্য এক ভয়ংকর ধাক্কা।

এহেন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় হচ্ছে আমেরিকার রাষ্ট্রীয় ঋণের সর্বোচ্চ সীমা বাড়ানো। অতীতে এভাবেই ঋণের সর্বোচ্চ সীমা বাড়িয়ে সংকট মোকাবেলা করা হয়েছে এবং ফলে মোট ঋণের পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে ৩১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার, যা আমেরিকার জিডিপির ১২৩.৪ শতাংশ। বলা হয়ে থাকে যে আমেরিকার বর্তমান জাতীয় ঋণ এবং জিডিপির অনুপাত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের পর্যায়ে চলে গেছে, যা খুবই উদ্বেগের কারণ। এর পরও কংগ্রেসে আমেরিকার রাষ্ট্রীয় ঋণের সর্বোচ্চ সীমা বৃদ্ধির প্রস্তাব বিবেচনায় আছে। তবে এবার কাজটা বেশ কঠিন হবে, কেননা বর্তমানে কংগ্রেসে রিপাবলিকানরা হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাঁরা এই সুযোগে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে কিছুটা বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা তো করবেনই। এরই মধ্যে কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্যরা ঋণসীমা না বাড়িয়ে খরচ কমানো এবং বাজেট কর্তনের ওপর গুরুত্ব দিতে শুরু করেছেন। যদি কোনো কারণে কংগ্রেস সরকারি ঋণসীমা বৃদ্ধি না করে এবং সেটা যদি খুবই অল্প সময়ের জন্যও হয়, তাতেও আমেরিকার জো বাইডেনের সরকার একটি কঠিন সমস্যায় পড়ে যেতে পারে।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, কংগ্রেসে ঋণসীমা বৃদ্ধি করা নিয়ে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা যদি কোনো কারণে এক মাস বা তার অধিক সময় পর্যন্ত গড়ায়, তাহলে এক ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হবে। সরকার বাধ্য হয়েই ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করবে, যার প্রভাবে জিডিপি হ্রাস পাবে। ট্রেজারি বন্ডের ওপর সুদ প্রদান এবং মেয়াদোত্তীর্ণ বন্ডের অর্থ পরিশোধ করতে না পারলে খেলাপি বা ডিফল্টের দুর্নাম নিতে হবে। সার্বিকভাবে সুদের হার আরো বেড়ে যাবে, যার খেসারত দিতে হবে আমেরিকার জনগণকে বন্ধকি ঋণ এবং ব্যক্তিগত ঋণের ওপর অতিমাত্রায় সুদ প্রদানের কারণে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এমন এক বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হবে, যার কারণে জনগণ এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট দেখা দিতে পারে। এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে স্টক মার্কেটে এবং শেয়ারের অব্যাহত দরপতন ঘটতে পারে। শুধু আমেরিকায়ই নয়, আমেরিকার বাইরের বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ নিয়ে আমেরিকার ট্রেজারি বন্ড ক্রয় করেন একমাত্র কারণে যে, এই ট্রেজারি বন্ড ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগের মর্যাদা ভোগ করে। যদি সত্যি কংগ্রেস আগামী এক মাস রাষ্ট্রীয় ঋণের সিলিং বৃদ্ধি না করে, তাহলে আমেরিকার ট্রেজারি বন্ড ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগের বিশেষ মর্যাদা হারাতে পারে, যার সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে আমেরিকার আর্থিক বাজারে। এসব উদ্বেগের বিষয় নিয়ে এখানকার মূলধারার কিছু সংবাদমাধ্যম প্রতিবেদন এবং প্রবন্ধ প্রকাশ করে আসছে বিগত কয়েক দিন ধরে। একটি স্বনামধন্য পত্রিকা তো হিসাব করেই দেখিয়েছে যে কংগ্রেসে ঋণসীমা বৃদ্ধির অচলাবস্থা যদি তিন মাস বা তার অধিক সময় দীর্ঘ হয়, তাহলে আমেরিকার জিডিপি ১৫ শতাংশ হ্রাস পাবে।

ইতিহাস বলে, আমেরিকার ঋণসংকট যতই জটিল এবং ভয়ংকর হোক না কেন, তা খুব বেশি দীর্ঘ হবে না এবং অল্প সময় পরেই সেটি কেটে যাবে। কেননা আমেরিকাসহ বেশির ভাগ উন্নত দেশের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য যতই তীব্র হোক না কেন, জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে তারা একমত। এ কারণেই কংগ্রেসে রিপাবলিকান সদস্যরা সরকারি ঋণসীমা বাড়ানোর ব্যাপারে যতই আপত্তি করুন না কেন, এক পর্যায়ে তাঁরা এটি অনুমোদন করবেন। যখন দেখবেন যে এই ঋণসংকটের কারণে আমেরিকার অর্থনীতির এবং সুনামের এমন ক্ষতি হবে, যা তাঁরা নিজেরা ক্ষমতায় গিয়েও পুনরুদ্ধার করতে পারবেন না, তখন তাঁরা এই ঋণসীমা বৃদ্ধি করতে বাধ্য হবেন। ঠিক একই রকম অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দার সময়, যখন ৭০০ বিলিয়ন ডলারের বেইল-আউট প্যাকেজ কংগ্রেস অনুমোদন করতে অস্বীকার করেছিল।

ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়ই শেষ রক্ষা হয়তো হবে। কংগ্রেস রাষ্ট্রীয় ঋণসীমা বৃদ্ধির প্রস্তাবও অনুমোদন করবে এবং আমেরিকার ঋণসংকট হয়তো কেটে যাবে। কিন্তু এর ফলে যে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হবে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব শুধু যে আমেরিকায় পড়বে তা-ই নয়, আমেরিকার বাইরে সমগ্র বিশ্বেই কমবেশি পরিলক্ষিত হবে। বিশেষ করে আমেরিকার নিজের দেশেই তখন ডলারের প্রকট চাহিদা থাকবে এবং সুদের উচ্চহার থাকায় আমেরিকার ডলার হার্ড কারেন্সি হিসেবে চালু থাকতে পারে আরো দীর্ঘ সময়। এর ফলে বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট ডলারসংকট দীর্ঘ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এসব কারণে আমাদের দেশের ডলার সংকট যে খুব সহসা কাটবে না তার আলামত তো যথেষ্ট স্পষ্ট। সুতরাং সময় থাকতেই কিছু প্রতিকারমূলক বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতি জরুরি। আমাদের দেশের অর্থনীতির যে আকার এবং আগামী দিনের আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ যে পর্যায়ে পৌঁছবে, তাতে আইএমএফের ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ মোটেই আশ্বস্ত হওয়ার মতো কিছু নয়। তবে এ কথা ঠিক যে এই ঋণ কিছুদিনের জন্য স্বস্তি দেবে। আর এই স্বস্তি থাকতে থাকতে কিছু বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পর্যাপ্ত বাড়িয়ে নিতে হবে, যাতে ডলার সংকট দীর্ঘ হলে বা আরো খারাপ হলে পরিস্থিতি খুব সহজে সামাল দেওয়া যায়। অতীতে এই বিশেষ উদ্যোগ না নেওয়ার কারণেই মাত্র ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের জন্য আইএমএফের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। এবারও যদি আমরা সেসব বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ না করি, তাহলে আরো খারাপ অবস্থার সম্মুখীন হতে পারি।

 লেখক : নিরঞ্জন রায় – সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা।


সর্বশেষ - রাজনীতি