1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

কৃষিজমি সুরক্ষায় অঙ্গীকার জরুরি

পাভেল পার্থ : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বুধবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

কেন, কীভাবে, কী কারণে কতটুকু কৃষিজমি কমছে—এই হিসাব সঠিক ও সুস্পষ্ট হওয়া জরুরি। কৃষিজমি দখল, দূষণ ও বিনষ্টকারীদের চিহ্নিত করে আইন ও বিচারের আওতায় আনা জরুরি।

একটা নিদারুণ খবরের পাশাপাশি আরেক আশাজাগানিয়া খবর দিয়ে শুরু হলো ৭ ফেব্রুয়ারির সকাল। তুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্প এবং কৃষিজমি সুরক্ষায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার। নিজ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে কৃষিজমি সুরক্ষায় আবারও নির্দেশনা দিলেন প্রধানমন্ত্রী। সভা শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব সংবাদ সম্মেলনে জানান, প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন, তিন ফসলি জমি ধ্বংস করা যাবে না। এ ধরনের জমিতে কোনো প্রকল্প নেওয়া যাবে না; বরং এই জমিগুলো রক্ষা করতে হবে।

তবে এই প্রথম নয়, এর আগে বহুবার, বহু অনুষ্ঠান এবং প্রকল্পের উদ্বোধনে বহু বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী কৃষিজমি সুরক্ষার ঘোষণা দিয়েছেন। ২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫তম বিশ্ববিদ্যালয় দিবস ও প্রযুক্তি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও কৃষিজমি নষ্ট করে যেখানে-সেখানে শিল্পকারখানা না করার কথা বলেন তিনি। একই বছরের ৬ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও কৃষিজমি বিনষ্ট করে শিল্পায়ন না করার ঘোষণা দেন তিনি। ২০১৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী ভূমি মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করে কৃষিজমি সুরক্ষা করে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে নির্দেশনা দেন। কৃষিজমি সুরক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও ঘোষণা একত্র করলে এই বিবরণ বেশ দীর্ঘ হবে। নির্বাচনী ইশতেহার থেকে শুরু করে নানা কর্মসূচি ও অনুষ্ঠানে দেশের আর কোনো রাজনীতিবিদ কৃষিজমি সুরক্ষায় এত বেশি ঘোষণা করেছেন কি না, জানা নেই। কিন্তু তারপরও কেন দেশে কৃষিজমি সুরক্ষিত থাকছে না? কেন প্রতিদিন বিদীর্ণ, চুরমার, উধাও হচ্ছে দেশের শত সহস্র বছরের কৃষিজমিগুলো? প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদ কেন কৃষিজমি সুরক্ষায় সাহসী অঙ্গীকার করছেন না?

এখনো দেশে কৃষিজমি সুরক্ষায় আইনটি চূড়ান্ত হয়নি। ২০১১ সালে কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার নিয়ে একটি আইনের খসড়া হয়। পরে ‘কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন, ২০১৫’-এর খসড়া তৈরি হয়। পরে ‘কৃষিজমি সুরক্ষা আইন, ২০২১’ শিরোনামে আইনের খসড়া যুগোপযোগীকরণ, সংশোধন, নতুন অনুচ্ছেদ সংযোজন, বিয়োজনের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় ২২ নভেম্বর ২০২১ একটি সভার আয়োজন করে। যদিও সেই সভার সিদ্ধান্ত জানা যায়নি। এমনকি জনগুরুত্বপূর্ণ এই আইন নিয়ে দেশের কৃষকসমাজ, কৃষক সংগঠক, নাগরিক সমাজের কোনো মতামত ও অংশগ্রহণ প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি। কৃষিজমি সুরক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ও অঙ্গীকারের প্রতি আমরা কোনোভাবেই বিশ্বাস হারাতে চাই না। কিন্তু আমরা বিস্মিত হই, প্রধানমন্ত্রীর বারবার ঘোষণার পরও দেশজুড়ে প্রতিদিন কমছে কৃষিজমি। কৃষিজমি সুরক্ষায় প্রতিদিন সংগ্রাম করতে হচ্ছে পাহাড় কি সমতল, হাওর কি বরেন্দ্র, চর কি বিল, গড় থেকে নদী অববাহিকার গ্রামীণ সমাজকে। কৃষিজমি সুরক্ষায় দেশের গরিষ্ঠ ভাগ নাগরিকের যেন কোনো দায় ও দায়িত্ব নেই। তাহলে কীভাবে আমরা আমাদের কৃষি উৎপাদন, গ্রামীণ অর্থনীতি এবং খাদ্য সুরক্ষার ভিত মজবুত করে দাঁড়াব? আমরা আশা করব, কৃষিজমি সুরক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে সত্য প্রমাণ করবে তাঁর মন্ত্রিপরিষদ। দ্রুত ‘কৃষিজমি সুরক্ষা আইন, ২০২১’ অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করবে।

জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি ২০০১-এর প্রেক্ষাপট অংশে বলা হয়েছে,…বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষি হচ্ছে এ দেশের এক-তৃতীয়াংশ জাতীয় আয়ের উৎস এবং দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের জীবিকার অবলম্বন। তাই বাংলাদেশের ভূমি ও পানিসম্পদের গুরুত্বও অপরিসীম। ভূমি হচ্ছে মৌলিক প্রাকৃতিক সম্পদ, যা মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী, শিল্পপণ্য, ভোগবিলাস, স্বাস্থ্য রক্ষার উপকরণ ইত্যাদি সবকিছুরই উৎস। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মাথাপিছু জমির পরিমাণ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নগরায়ণের প্রবণতা বাড়ছে, শিল্পোন্নয়ন ঘটছে, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদির ক্রমাগত সম্প্রসারণ হচ্ছে, ফলে কৃষিজমির পরিমাণ ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও কৃষি তথ্য সার্ভিসের (২০১৫) সূত্র উল্লেখ করে কৃষি মন্ত্রণালয় তাদের ওয়েব পোর্টালে জানিয়েছে, দেশে মোট আবাদযোগ্য জমি ৮৫০৫২৭৮.১৪ হেক্টর, মোট সেচকৃত জমি ৭১২৪৮৯৫.৪১ হেক্টর, আবাদযোগ্য পতিত জমি ২০৪৩৬৬.২৪ হেক্টর। মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (২০১০) হিসাবে কৃষিজমির পরিমাণ ৯ দশমিক ৫ মিলিয়ন হেক্টর, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (২০১১) হিসাবে ৮ দশমিক ৫২ মিলিয়ন হেক্টর এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (২০১১) হিসাবে ৯ দশমিক ১ মিলিয়ন হেক্টর। বাংলাদেশ মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের মাটি ও জমিবিষয়ক পরিসংখ্যান বই, পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রকাশিত কৃষি ডায়েরি (২০১১) থেকে দেখা যায়, ১৯৭৬ সালে দেশে কৃষিজমি ছিল ৯ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন হেক্টর। ১৯৮০-৮১ সালে ৯ দশমিক ৩৮; ১৯৮৫-৮৬ সালে ৯ দশমিক ৪৪; ১৯৯০-৯১ সালে ৯ দশমিক ৭২; ১৯৯৫-৯৬ সালে ৮ দশমিক ৭২; ২০০০-০১ সালে ৮ দশমিক ৪০; ২০০৫-০৬ সালে ৮ দশমিক ৪২ এবং ২০১০-১১ সালে ৮ দশমিক ৫২ মিলিয়ন হেক্টর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (২০১৫) তথ্যমতে, দেশে মোট ভূমির পরিমাণ প্রায় ১৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন হেক্টর। দেশের মোট ভূমির ১৩ দশমিক ৩ শতাংশজুড়ে বনভূমি, ২০ দশমিক ১ শতাংশে জলাধার, ঘরবাড়ি, শিল্পকারখানা এবং বাকি ৬৬ দশমিক ৬ শতাংশ কৃষিকাজের জন্য ব্যবহার করা হয়। এর ভেতর আবাদযোগ্য জমি ৮৫ লাখ ৫ হাজার ২৭৮ দশমিক ১৪ হেক্টর। সেচকৃত জমি ৭১ লাখ ২৪ হাজার ৮৯৫ দশমিক ৪১ হেক্টর। এ ছাড়া আবাদযোগ্য ‘পতিত’ জমি আছে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৬৬ দশমিক ২৪ হেক্টর।

দেশজুড়েই প্রতিদিন কমছে কৃষিজমি। গণমাধ্যমে কৃষিজমি হ্রাস ও বিনষ্টের খবর নিয়মিত প্রকাশিত ও প্রচারিত হয় না। সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে আবাসন, নগরায়ণ, জবরদখল, শিল্পায়ন এসবকেই প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু কৃষিজমি হ্রাসের সঙ্গে জড়িত সমাজ ও রাষ্ট্রের নানাবিধ সম্পর্ক এবং দরবারগুলো এ ক্ষেত্রে উপেক্ষিত থাকে। ইউএনডিপির (২০০৩) প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রতিবছর ১ শতাংশ কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রহমান ও হাসান (২০০৩) তাঁদের এক গবেষণায় জানিয়েছেন, এর পরিমাণ শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (২০১১) ১৯৭৬-৭৭ থেকে ২০১০-১১ সালের কৃষিজমির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, কৃষিজমি হ্রাসের হার শূন্য দশমিক ২৭ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের (২০০৯) এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রতিবছর ১ শতাংশ কৃষিজমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। রহমান (২০১০) তাঁর এক গবেষণায় জানিয়েছেন, প্রতিবছর শূন্য দশমিক ১ শতাংশ কৃষিজমি গৃহায়ণ, রাস্তাঘাট ও শিল্পাঞ্চলের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। হাসান ও অন্যরা (২০১৩) বাংলাদেশের কৃষিজমির অবস্থা শীর্ষক এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, ১৯৭৬ সালে দেশে কৃষিজমি ছিল ১৩ দশমিক ১ মিলিয়ন হেক্টর, ২০১০ সালে যা কমে দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৪৪ মিলিয়ন হেক্টরে। মানে ৩৪ বছরে দেশে শূন্য দশমিক ৬৬ মিলিয়ন হেক্টর কৃষিজমি কমেছে। দেশে সর্বাধিক কৃষিজমি কমেছে চট্টগ্রামে এবং তা বছরে ১৭ হাজার ৯৬৮ হেক্টর। রাজশাহীতে ১৫ হাজার ৯৪৫ হেক্টর, ঢাকায় ১৫ হাজার ১৩১ হেক্টর, রংপুরে ১১ হাজার ৯৬ হেক্টর, খুলনায় ৮ হাজার ৭৮১ হেক্টর এবং বরিশালে ৬ হাজার ৬৬১ হেক্টর।

১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলনে টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেওয়া হয়। মাটি, পানি, প্রাণী, উদ্ভিদসহ মৃত্তিকা সম্পদের কার্যকর ব্যবহার, যা মানুষের চাহিদা মিটিয়ে প্রাণিসম্পদ ও পরিবেশগত সম্পর্ককে এক দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে সংরক্ষণ করার চর্চাকেই টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। প্রতিদিন কৃষিজমি কমতে থাকা একটি দেশ কীভাবে এত সংকট সামাল দিয়েও সবার সামনে হাজির করছে খাবারভর্তি থালা, তা আসলেই এক বিস্ময়ের বিষয়। কেন, কীভাবে, কী কারণে কতটুকু কৃষিজমি কমছে—এই হিসাব সঠিক ও সুস্পষ্ট হওয়া জরুরি। কৃষিজমি দখল, দূষণ ও বিনষ্টকারীদের চিহ্নিত করে আইন ও বিচারের আওতায় আনা জরুরি। কেবল প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা নয়; নাগরিক হিসেবে দেশের কৃষিজমি সুরক্ষায় জনতৎপরতা আরও সক্রিয় হওয়া জরুরি।

লেখক: পাভেল পার্থ – লেখক ও গবেষক।


সর্বশেষ - রাজনীতি