1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

যেভাবে বঙ্গবন্ধু উপাধি পেলেন শেখ মুজিব

তোফায়েল আহমেদ  : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বুধবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

ফেব্রুয়ারি মাসের ২৩ তারিখটি প্রতি বছর গভীরভাবে স্মরণ করি। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ দিন। দিবসটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। যতদিন বেঁচে থাকব হৃদয়ের গভীরে লালিত এ দিনটিকে স্মরণ করব। ১৯৬৯-এর এই দিনে বাংলার দুঃখী মানুষের বন্ধু, বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতাকে জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলাম।

বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ’৬৯-এর গণ-আন্দোলন এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। কালপর্বটি ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ‘ড্রেস রিহার্সেল’। জাতির মুক্তিসনদ ৬ দফা দেয়াকে অপরাধ গণ্য করে বঙ্গবন্ধু মুজিবসহ মোট ৩৫ জনকে ফাঁসি দেয়ার লক্ষ্যে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ তথা আগরতলা মামলার আসামি করা হয় এবং নির্বিঘ্নে পুনরায় ক্ষমতায় আরোহণের এক ঘৃণ্য মনোবাসনা চরিতার্থে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেন স্বৈরশাসক আইয়ুব খান। আগরতলা মামলার বিচার যখন শুরু হয় তখন আমরা উপলব্ধি করি বঙ্গবন্ধুকে যদি ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হয় তাহলে চিরদিনের জন্য বাঙালি জাতির কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যাবে।

কেননা এই একটি কণ্ঠে কোটি কণ্ঠ উচ্চারিত হয়। তাই আমরা ’৬৯-এর ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডাকসু’ কার্যালয়ে চার ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন এবং ৬ দফাকে হুবহু যুক্ত করে ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করি। ১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ’৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জমায়েত অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বটতলায় এবং পূর্বঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়।

’৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি যে আন্দোলন আমরা শুরু করেছিলাম, ২০ জানুয়ারি শহীদ আসাদের রক্তাক্ত জামা হাতে নিয়ে যে শপথ নিয়েছিলাম, ২৪ জানুয়ারি মতিউর-মকবুল-রুস্তম-আলমগীরের রক্তের মধ্য দিয়ে সেই আন্দোলন সর্বব্যাপী গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি করেছিল। ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে শপথ দিবসে স্লোগান দিয়েছিলাম ‘শপথ নিলাম শপথ নিলাম মুজিব তোমায় মুক্ত করবো; শপথ নিলাম শপথ নিলাম মা-গো তোমায় মুক্ত করবো।’ আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে ১৫ ফেব্রুয়ারি ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে নির্মমভাবে হত্যা করে সান্ধ্য আইন জারি করা হলে তা ভঙ্গ করে রাজপথে প্রতিবাদ মিছিল করি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি সেনারা বেয়োনেট চার্জে নির্মমভাবে হত্যা করে পুনরায় সান্ধ্য আইন জারি করলে যথারীতি আমরা তা ভঙ্গ করে প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রাখি।

২০ ফেব্রুয়ারি সমগ্র ঢাকাকে মশাল আর মিছিলের নগরীতে পরিণত করলে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে পল্টনের জনসমুদ্রে প্রিয় নেতা শেখ মুজিবসহ আগরতলা মামলায় আটক সব বন্দির নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম প্রদান করি। সমগ্র দেশ গণবিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয়। জনরোষের ভয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান সব রাজবন্দিকে বিনা শর্তে মুক্তি দিলে দেশজুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।

প্রিয় নেতাকে কারামুক্ত করার মধ্য দিয়ে শপথ দিবসের স্লোগানের প্রথম অংশ ‘মুজিব তোমায় মুক্ত করবো’, এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে হাতিয়ার তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে প্রিয় মাতৃভূমিকে হানাদার মুক্ত করে স্লোগানের দ্বিতীয় অংশ ‘মা-গো তোমায় মুক্ত করবো’ বাস্তবায়ন করেছিলাম। বস্তুত, ’৬৬-এর ৮ মে’র গভীর রাতে ৬ দফা কর্মসূচি প্রদানের অভিযোগে দেশরক্ষা আইনে যে মুজিব গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, ৩৩ মাস পর ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি যে মুজিব মুক্তিলাভ করেন।

আগরতলা মামলাটি ছিল সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য অগ্নিপরীক্ষার মতো। সেই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি বন্দিদশা থেকে মুক্তমানব হয়ে বেরিয়ে আসেন। ২২ ফেব্রুয়ারি আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেই, প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে গণসংবর্ধনা জানাব। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারেই রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩টায় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে গণসংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়।

শুরুতেই বলেছি ২৩ ফেব্রুয়ারি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। সেদিনের রেসকোর্স ময়দান যারা দেখেননি তাদের বলে বোঝানো যাবে না সেই জনসমুদ্রের কথা। আমরা যখন সেখানে পৌঁছেছি, তখন রেসকোর্স ময়দানে মানুষ আর মানুষ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রেন-বাস, ট্রাক, লঞ্চ-স্টিমার বোঝাই হয়ে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, কৃষক-শ্রমিক, সাধারণ মানুষ ছুটে এসেছে। ঢাকার মানুষ তো আছেই। অভিভূত হয়ে পড়লাম। এর আগে এত বড় জনসভা দেখিনি। সেই জনসমুদ্রে লাখ লাখ লোক এসেছে প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে এক নজর দেখতে।

প্রিয় নেতাকে নিয়ে আমরা মঞ্চে উঠলাম। সে দিন সেই মঞ্চে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রেখেছিলেন। চিরাচরিত প্রথা ভঙ্গ করে আগেই সভাপতির ভাষণ দেয়ার জন্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে লাখ লাখ মানুষকে অনুরোধ জানিয়ে বলেছিলাম, ‘সবার শেষে বক্তৃতা করার কথা থাকলেও আপনাদের অনুমতি নিয়ে আমি আগেই বক্তৃতা করতে চাই।’ দশ লাখ লোকের সম্মতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আগেই বক্তৃতা করি। সেদিন যে ভালোবাসা মানুষের কাছ থেকে পেয়েছি তা বলে বোঝাতে পারব না। বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে বলেছিলাম, ‘প্রিয় নেতা তোমার কাছে আমরা ঋণী, বাঙালি জাতি চিরঋণী। এই ঋণ কোনোদিনই শোধ করতে পারব না। সারা জীবন এই ঋণের বোঝা আমাদের বয়ে চলতে হবে। আজ এই ঋণের বোঝাটাকে একটু হালকা করতে চাই জাতির পক্ষ থেকে তোমাকে একটা উপাধি দিয়ে।’

১০ লাখ লোক ২০ লাখ হাত তুলে সম্মতি জানিয়েছিল। তখনই ঘোষণা করেছিলাম, “যে নেতা তার জীবনের যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে, সেই নেতাকে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করলাম।” ১০ লাখ লোক তুমুল করতালির মধ্য দিয়ে এই প্রস্তাব গ্রহণ করে প্রিয় নেতাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে লাখ লাখ কণ্ঠে ধ্বনি তুলেছিল, ‘জয় বঙ্গবন্ধু!’

বাংলাদেশে অনেক আন্দোলন হয়েছে- ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ। একেকটি আন্দোলনের একেক রকম চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য ছিল। ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য এমন ছিল যে, তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বিচার চলছিল। বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে আগরতলা মামলা দায়ের করে ’৬৮-এর ১৯ জুন বিচার শুরু হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানোর জন্য আইয়ুব খান পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। আইয়ুব খানের তথ্য সচিব আলতাফ গওহর ‘আইয়ুব খান’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। সেই বইয়ে উল্লেখ আছে কীভাবে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেয়ার চেষ্টা হয়। কিন্তু ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনের শহীদদের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগ সেই ষড়যন্ত্রের প্রচেষ্টাকে সমাধিস্থ করে এবং আসাদ-মতিউর-মকবুল-রুস্তম-আলমগীর-সার্জেন্ট জহুরুল হক-আনোয়ারা-ড. শামসুজ্জোহার জীবনের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির আন্দোলন সফল হয়। জানুয়ারির শেষের দিকে নারায়ণগঞ্জের এক জনসভায় দম্ভোক্তি করে আইয়ুব খান বলেছিলেন, তিনি আবার পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হবেন। অথচ ১৭ জানুয়ারি আন্দোলন শুরু হলো, ২০ জানুয়ারি আসাদ শহীদ হলেন, ২৪ জানুয়ারি শহীদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হলে সর্বব্যাপী গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় এবং সেই আইয়ুব খান একদিন পরেই বলেছেন ‘আমি আর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব না।’ একটি আন্দোলন সাত দিনের মধ্যে গণ-অভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়-ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে, ছাত্র সমাজের নেতৃত্বে! এর তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

বছর ঘুরে এমন একটি মধুর দিন যখন ফিরে আসে হৃদয়ের মানসপটে কত স্মৃতি ভেসে ওঠে। আমরা সংখ্যাসাম্যের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরুর অবস্থান থেকে ‘এক মাথা এক ভোটে’র দাবি তুলে তা আদায় করেছিলাম। ফলে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাধিক্য আসন আমরা লাভ করেছিলাম। এ দিনের প্রতিটি মুহূর্তে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে মনে পড়ে। সেদিন বক্তৃতায় আরও বলেছিলাম, ‘৬ ও ১১ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের রক্তের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আমরা ফিরে পেয়েছি। তাদের সে রক্ত যেন বৃথা না যায়, তার জন্য জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাই। কৃষক-শ্রমিক, ছাত্রসহ সব মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য এই আন্দোলন শুরু হয়েছে।’ বক্তৃতা শেষ করে ঘোষণা করেছিলাম, ‘এখন বক্তৃতা করবেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।’

তুমুল করতালির মধ্যে তিনি বক্তৃতা করতে দাঁড়ালেন। চারদিকে তাকিয়ে উত্তাল জনসমুদ্রের উদ্দেশে বললেন, ‘রাতের অন্ধকারে সান্ধ্য আইনের কঠিন বেড়াজাল ছিন্ন করে যে মানুষ ‘মুজিবকে ফিরিয়ে আনতে হবে’ বলে আওয়াজ তুলে গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে তাদের দাবির সাথে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না।’ সংগ্রামী ছাত্রসমাজকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি ছাত্রদের ১১ দফা শুধু সমর্থনই করি না, এর জন্য আন্দোলন করে আমি পুনরায় কারাবরণে রাজি আছি। ছাত্রদের ১১ দফার মধ্যে আমার ৬ দফা দাবিও নিহিত রয়েছে। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি যদি এ দেশের মুক্তি আনতে ও জনগণের দাবি আদায় করতে না পারি, তবে আন্দোলন করে আবার কারাগারে যাবো।’ সে দিন বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, ‘আমি গোল টেবিল বৈঠকে যাবো, সেখানে আমার ৬ দফাও পেশ করব, ১১ দফাও পেশ করব।’ তিনি জীবদ্দশায় কোনোদিন ১১ দফার কথা ভোলেননি।

তার বক্তৃতায় সবসময় ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনের কথা থাকত। এমনকি ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে আছে, ‘১৯৬৯-এর আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম।’ পরিশেষে স্বভাবসুলভ কণ্ঠে কৃতজ্ঞস্বরে বলেছিলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, তোমরা যারা রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছো, যদি কোনদিন পারি নিজের রক্ত দিয়ে আমি সেই রক্তের ঋণ শোধ করে যাবো।’

তিনি একা রক্ত দেননি-’৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে রক্ত দিয়ে বাঙালি জাতির রক্তের ঋণ তিনি শোধ করে গেছেন। ’৬৯-এর ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহওরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে তার সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বঙ্গবন্ধু এই জনপদের নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ।’ সেদিন তিনি স্বকণ্ঠে স্লোগান তুলে বলেছিলেন, “আমার সাথে কণ্ঠ মেলাও, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ।’’

যে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ, যাদের রক্তঋণে গোটা জাতি ঋণী, তাদের সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে ভোলায় নিজগ্রামে ‘স্বাধীনতা জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা করেছি। সেই জাদুঘরে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে শহীদ সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারের স্মৃতি, মহান ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-আন্দোলন, শহীদদের স্মৃতিচিহ্ন, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির পিতার দুর্লভ সব আলোকচিত্র স্থান পেয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। এই বাংলাদেশের স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন। তিনি ছিলেন বিশ্ববরেণ্য মহান নেতা। তার কোনো তুলনা হয় না। তিনি জন্মেছিলেন বলেই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। তিনি যদি না জন্মাতেন আমরা আজও পাকিস্তানের দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ থাকতাম। সেই মহান নেতা তার জীবদ্দশায় সবসময় এই দিনগুলোর কথা সংবাদপত্রে বাণী, বিবৃতি দিয়ে শহীদদের কথা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করতেন।

কেননা, তিনি জানতেন ৬ দফা আন্দোলন না হলে ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান হতো না; ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান না হলে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে পারতাম না; বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে মুক্ত না হলে ’৭০-এর নির্বাচনে পাকিস্তানে আমরা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারতাম না; আর পাকিস্তানে যদি আমরা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারতাম, তাহলে ৯ মাস যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করতে পারতাম না। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্রসমাজের যে ভূমিকা তা গৌরবোজ্জ্বল।

ইতিহাসের মহামানব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ তথা ‘মুজিববর্ষ’ ও মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের মহতি কালপর্বে ভাষার মাস ‘ফেব্রুয়ারি’ আজ আমাদের জাতীয় জীবনে নবরূপে আবির্ভূত হয়েছে। বছরব্যাপী ‘মুজিববর্ষ’ পালনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার চেতনা আজ স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি ক্ষণ আজ নতুন প্রজন্মসহ সবাই জানতে পারছেন।

মহান ভাষা আন্দোলন থেকে মহত্তর মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে জাতির পিতার ঐতিহাসিক অবদান পরম শ্রদ্ধায় সবাই স্মরণ করছেন। মহান ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক দিন ‘অমর একুশে ফেব্রুয়ারি’ ১৯৯৯ থেকে অর্থাৎ বিগত ২৩ বছর যাবত বিশ্বের প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার প্রতীকে পরিণত হয়ে বিশ্বজুড়ে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে সগৌরবে পালিত হচ্ছে।

সর্বস্তরের বাঙালির জন্য দিনটি গৌরবের ও মর্যাদার। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের গৌরবময় এই ইতিহাস সৃষ্টি করতে যে নেতা তার যৌবনের তেরোটি মূল্যবান বছর পাকিস্তানের কারাগারে কাটিয়েছেন; কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে যে নেতা প্রিয় মাতৃভূমি বাংলার ছবি হৃদয় দিয়ে এঁকেছেন; সেই নেতার জন্মশতবর্ষে ৭০ হাজার গৃহহীন পরিবার গৃহ পেয়েছে; ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন ৮ লাখ পঁচাশি হাজার ৬২২ জন গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষকে গৃহ ও ভূমি দেয়া হবে; দেশের শতভাগ লোক বিদ্যুৎ ব্যবহারের দ্বারপ্রান্তে; শিক্ষার হার ৭৪.৯%; গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে ৭৩ বছর; ২০২১-২২ অর্থাৎ চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫৫৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে; বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন ডলার; রপ্তানি ৪৬.৪ বিলিয়ন ডলার; অনেকগুলো মেগাপ্রজেক্ট আজ শেষ হওয়ার পথে; অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহত্তম অর্থনীতি। সফলভাবে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা ও কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন প্রদানেও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সমগ্র বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। জনহিতকর এসব সাফল্য বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। এসবই সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সবল-সমর্থ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে।

জাতির পিতা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই উপলব্ধি করেছিলেন এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি, একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদের হতে হবে। সেই লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে তিনি ’৪৮-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ এবং ’৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর সংগ্রামের সুদীর্ঘ পথে নেতৃত্ব দিয়ে মহান বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে বাংলার মানুষের জন্য পাঁচটি মৌলিক অধিকার সাংবিধানিকভাবে বিধিবদ্ধ করেন।

সাংবিধানিক সে-সব সুফল আজ দেশের মানুষ ভোগ করছে। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ষাটোর্ধ্ব নাগরিকদের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা করবার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নির্দেশ দিয়েছেন। আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের মহত্তর আদর্শ ছিল স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার স্থলে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাষ্ট্রকে জনকল্যাণমুখী করার এই মহতি প্রচেষ্টা ইতিহাস হয়ে থাকবে।

লেখক : তোফায়েল আহমেদ – আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় সংসদ।


সর্বশেষ - রাজনীতি