1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

কৃষকের আশার আলো তিস্তা সেচ প্রকল্প

বিশেষ প্রতিবেদক : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
মঙ্গলবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ কমান্ড এলাকায় কমমূল্যে সেচের পানি পেয়ে বোরো ধান আবাদের ধুম পড়েছে। তিস্তার সেচে ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিস্তা সেচ প্রকল্পের পানিতে তিন জেলা- নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুরের কৃষক এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন বোরো রোপণে।

নীলফামারী সদরের রামনগর ইউনিয়নের মাঝাপাড়া গ্রামের কৃষক রমজান আলী বলেন, সেচ ক্যানেলের পানি দিয়ে এবার তিন বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করছি। তিনি জানান, প্রকল্পের আওতায় বছরে তিন মৌসুমে (আউশ, আমন, বোরো) একরপ্রতি জমির সেচ খরচ দিতে হয় ৪৮০ টাকা। সে হিসেবে শুধু বোরো মৌসুমে এক একর জমিতে সেচ দিতে হয় মাত্র ১৬০ টাকা। তিস্তার সেচের বাইরে যেখানে গুনতে হয় সাড়ে চার হাজার টাকা থেকে ছয় হাজার টাকা। প্রকল্পের সেচের পানিতে ধান চাষে কম খরচে লাভ বেশি বলে উল্লেখ করে রমজান আলীর মতো কমান্ড এলাকার সকল কৃষক জানালেন। অপরদিকে তিস্তা ব্যারাজ থেকে ৬৫ কিলোমিটার অদূরে দিনাজপুরের চিরিরবন্দর ও দেবীগঞ্জ এলাকার কৃষকরা সেচ পাচ্ছেন পুরোদমে। সেখানকার তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের কৃষকদের পানি ব্যবস্থাপনা সংগঠনের প্রতিনিধি ধীরাজ চন্দ্র রায় জানালেন, শেখ হাসিনার সরকার কৃষকদের অনেক সুবিধা হাতের কাছে এনে দিয়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুতের খরচ বেশি হওয়ায় কমান্ড এলাকার কৃষকরা তিস্তার সেচে লাভবান হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরের সফলতা পেয়ে কমান্ড এলাকার কৃষকরা বলছেন, তিস্তার সেচ আমাদের কাছে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে।

এদিকে তিস্তা সেচ প্রকল্পের পরিধি আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এর মাধ্যমে এক লাখের বেশি হেক্টর জমি সেচ সুবিধার আওতায় আসবে। ফলে বছরে অতিরিক্ত প্রায় ১ লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন বাড়বে। একই সঙ্গে অন্যান্য খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়বে ৫ লাখ মেট্রিক টনের বেশি। যার বর্তমান বাজারমূল্য এক হাজার কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচের পানির অভাবে প্রকট শস্যসঙ্কট একটি চিরন্তন সমস্যা। শুষ্ক মৌসুমে তো বটেই আমন মৌসুমেও খরা দেখা দেয়। একমাত্র তিস্তা ছাড়া অন্যান্য ছোট নদী এবং খালে পানি প্রবাহ খুবই কম। তাই তিস্তা নদীতে ব্যারাজ নির্মাণের মাধ্যমে এই অঞ্চলে সেচ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা ব্রিটিশ আমলেই সৃষ্টি হয়। নীলফামারীর ডিমলা, ডালিয়া ও লালমনিরহাট জেলার দোয়ানী নামক স্থানে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের (প্রথম পর্যায়) আওতায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যারাজ নির্মিত হয়। বৃষ্টির অভাবে অন্যান্য এলাকায় যখন সেচের পানির জন্য হাহাকার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তিস্তা সেচ প্রকল্পের কমান্ড এলাকায় তখন কম মূল্যে প্রয়োজনীয় সেচ সুবিধা পেয়ে কৃষকরা বাম্পার ফলন উৎপাদন করছে। বর্তমানে চলছে বোরো ধান আবাদ। যা গত বছরের ন্যায় এবারও তিস্তা থেকে ৫৩ হাজার হেক্টর জমি সেচ পাচ্ছে। এর মধ্যে নীলফামারী জেলায় ৩১ হাজার হেক্টর, রংপুর জেলায় ১৫ হাজার হেক্টর ও দিনাজপুর জেলায় ৭ হাজার হেক্টর।

প্রথম পর্যায়ে তিস্তা ব্যারাজ কমান্ড এলাকায় মোট জমি রয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪৬৯ হেক্টর। এরমধ্যে আবাদযোগ্য এলাকা ১ লাখ ১৮ হাজার ১৪৮ হেক্টর ও সেচযোগ্য এলাকা ৮৬ হাজার ৫২৯ হেক্টর। এ ছাড়া সেচ প্রদানে ৭১০ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার সেচ খাল রয়েছে। এরমধ্যে ৩৩ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার প্রধান সেচখাল, ৭৪ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার মেজর সেকেন্ডারি সেচখাল, ২১৪ দশমিক ৭০ কিলোমিটার সেকেন্ডারি সেচখাল এবং ৩৮৭ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার টার্শিয়ারি সেচখাল রয়েছে। প্রতি ১২ ঘণ্টা অন্তর প্রতিটি ক্যানেল পাঁচ হাজার কিউসেক করে পানি সেচ পাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তিস্তা নদীতে এখন উজানের প্রবাহ চলছে ৫ থেকে ৬ হাজার কিউসেকের বেশি। তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট বন্ধ রেখে চাহিদা অনুযায়ী নদীর পানি সেচ ক্যানেলে প্রবেশ করানো হচ্ছে। চিরিরবন্দর দেবীগঞ্জ এলাকার তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের কৃষকদের পানি ব্যবস্থাপনা সংগঠনের প্রতিনিধি ধীরাজ চন্দ্র রায় বলেন, তিস্তার সেচে এলাকার জমিতে বোরো ধান আবাদ চলছে।

তিস্তা সেচ ক্যানেল পানি ব্যবস্থাপনা সমিতির সভাপতি আমিনুর রহমান বলেন, তিস্তা সেচ ক্যানেলের পানি বোরো, ভুট্টাসহ রবি ফসলের ব্যাপক সাফল্য বয়ে এনে দিয়েছে। চলতি বছর সেচের পানির কোন ধরনের ঘাটতি না থাকায় কৃষকরা কম খরচে আশানুরূপ ফসল উৎপাদন করছে উল্লেখ করে তিনি জানান, এবার তিস্তার সেচ সুবিধা পেতে তিন জেলার সুবিধাভোগী কৃষকের মধ্যে ২৪২টি পানি ব্যবস্থাপনা দল গঠন করা হয়। এসব দল মূলত কৃষকের সুবিধার্থে পানি বণ্টনের কাজটি করে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় পানি সমবণ্টন ও সেচ প্রদান সহজে করা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প থেকে ২০১৪ সালে ১৮ হাজার হেক্টর, ২০১৬ সালে ১০ হাজার হেক্টর, ২০১৭ সালে আট হাজার হেক্টর, ২০১৮ সালে ৩৫ হাজার হেক্টর এবং ২০১৯ সালে ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করে। গত বছর ২০২১ সালে ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হয়েছিল। সেচ পাচ্ছে নীলফামারী সদর, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরীগঞ্জ ও সৈয়দপুর; রংপুর জেলার সদর, বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ, গঙ্গাচড়া এবং দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর, খানসামা ও চিরিরবন্দর।

নাউতরা শালহাটি গ্রামের কৃষক ও ক্যানেল তীরবর্তী বাসিন্দা সাজু মিয়া জানান, গত কয়েক বছর ধরে তিস্তা সেচ প্রকল্পের পানি চাহিদামতো পাওয়া যাচ্ছে। একই গ্রামের সমসের আলী বলেন, ক্যানেলের পানিতে আবাদ করি হামরা ভালো আছি। শ্যালো দিয়া আবাদ করলে খরচ বেশি পড়ি যায়। ক্যানেলের পানিতে আবাদও ভালো হয়। জলঢাকা উপজেলা পানি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি খাইরুল ইসলাম বলেন, তিস্তার পানি দিয়েই বোরো আবাদ করি। খরচ কম, সময়মতো পানিও পাওয়া যায়। তিনি আরও বলেন, তিস্তা সেচের ফলে বোরো আবাদে খরচ অনেক কম হয়।

তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাফিউল বারী বলেন, করোনাকালেও আমরা প্রতিটি কমান্ড এলাকার বোরো চাষিদের চাহিদামতো সেচ প্রদান করতে সক্ষম হয়েছি। তিন জেলার ১২ উপজেলায় ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে রোটেশন পদ্ধতিতে সেচ প্রদান করা হচ্ছে। ফলে সেচ প্রকল্পের কমান্ড এলাকায় প্রায় তিন লাখ মেট্রিক টন বোরো ধান উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে। যা এই অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিগত সময়ের ন্যায় পুরো বোরো মৌসুম মনিটরিং করা হচ্ছে সেচ প্রকল্প এলাকায়। এজন্য দায়িত্ব পালন করছেন আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সেচ প্রদানে কোথাও কোন সমস্যা দেখা দিলে তা তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করা হচ্ছে।

তিস্তা সেচ প্রকল্পের রংপুর পওর সার্কল-২ তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ মাহবুবর রহমান জানালেন, মুজিবর্ষ ও স্বাধীনতা এবং বিজয়ের ৫০ বছর উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুপ্রেরণায় এবার আগাম সেচ কার্যক্রম শুরু করা হয়। চলতি বছর ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব হলেও এর পরিধি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। তিস্তা সেচ প্রকল্প উত্তরাঞ্চলের কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রকল্পের কমান্ড এরিয়ার এক লাখ ১৬ হাজার হেক্টর জমির তৃণমূল পর্যায়ে সেচের পানি পৌঁছে দিয়ে ৭৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ সেকেন্ডারি আর টার্শিয়ারি সেচ ক্যানেল নির্মাণে একটি বিশেষ প্রকল্প হাতে নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা। ফলে বছরে অতিরিক্ত প্রায় এক লাখ মেট্রিকটন ধানের উৎপাদন বাড়বে। একই সঙ্গে অন্য খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়বে পাঁচ লাখ মেট্রিক টনের বেশি। যার বর্তমান বাজারমূল্য এক হাজার কোটি টাকা। এতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অধিকতর উন্নীতকরণ, পরিবেশ তথা জীববৈচিত্র রক্ষা ও প্রকল্প এলাকায় বসবাসরত ৩০ লাখ জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হবে। ২০২৪ সালের জুন মেয়াদ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে।

এদিকে নীলফামারীর কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের বাইরে যেসব বোরোধান আবাদের জমি রয়েছে সেগুলোতে বোরোর চারা রোপণ চলছে। তিনি বলেন, চলতি মৌসুমে রংপুর কৃষি অঞ্চলে ৫ লাখ ৩ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছে। এরমধ্যে নীলফামারী জেলায় ৮১ হাজার ৫৫০ হেক্টর, রংপুর জেলায় ১ লাখ ৩০ হাজার ৯৫০ হেক্টর, গাইবান্ধা জেলায় ১ লাখ ২৭ হাজার ৮৪৫ হেক্টর, কুড়িগ্রাম জেলায় ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৫৫ হেক্টর ও লালমনিরহাট জেলায় ৪৭ হাজার ৬৫০ হেক্টর। বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও ধারণা করা হচ্ছে আবাদ বেশিই হবে। আশা করা হচ্ছে, বোরোচাষ সফল হলে রংপুর কৃষি অঞ্চলের পাঁচ জেলায় ২২ লাখ ৭ হাজার ১৩২ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হবে।


সর্বশেষ - রাজনীতি