আমরা দেখেছি যে, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি সম্পন্ন হবার পর নবগঠিত ভারত রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দ দেশে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রকৃতির সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের নীতি গ্রহণ করেন। অপরদিকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ও মুসলিম লীগ নেতৃত্ব দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রকৃতির সংসদীয় শাসন অর্থাৎ জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার নীতি গ্রহণ না করে পূর্ব বাংলার নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষের ওপর এক উপনিবেশ সুলভ নীতি চাপিয়ে দিতে চায়। এই নীতির অংশ হিসেবে তারা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র শুরু করে। যেখানে পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৪.৬% লোক বাংলা এবং মাত্র ৭% লোক উর্দু ভাষায় কথা বলে সেখানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার অর্থই ছিল বাঙালি জনগণকে দাবিয়ে রাখা, শোষণ করার এক ষড়যন্ত্র।
বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর এই ষড়যন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল দুটি। প্রথমত, পূর্ব বাংলার জনগণকে নেতৃত্বশূন্য ও আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা। কারণ, বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হলে বাঙালি জনগণকে চাকরি তথা প্রশাসনে অংশগ্রহণের জন্য একটি বিদেশী ভাষা শিক্ষার বোঝা বহন করতে হতো। এতে করে বাঙালির স্বাভাবিকভাবেই অবাঙালিদের থেকে পিছিয়ে পড়তো।
দ্বিতীয়ত, পূর্ব বাংলার জনগণ বাংলাভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত ছিল। তারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য গর্ববোধ করতো। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ ছিল তাদের আদর্শ, চেতনা, মূল্যবোধ। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার জনগণের এমন বাঙালি সংস্কৃতি প্রীতিকে সন্দেহের চোখে দেখতো। তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে হিন্দুদের সংস্কৃতি বলে মনে করতো। তারা আরও মনে করতো যে, পূর্ব বাংলার জনগণের এ ধরনের সংস্কৃতি চর্চা ভারতের ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়।
মোটকথা, পূর্ব বাংলার জনগণের বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে তাদের নেতৃত্বশূন্য এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যেই পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং এই ষড়যন্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ইসলামীকরণের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে।