বাংলাদেশে আল জাজিরার সম্প্রচার বন্ধ এবং অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ ডকুমেন্টারি সরাতে নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ভিন্নমত দিয়েছেন ছয় অ্যামিকাস কিউরির (আদালতের বন্ধু) মধ্যে পাঁচজন।
সোমবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) শুনানিতে অংশ নিয়ে পাঁচজন অ্যামিকাস কিউরি বলেন, আল জাজিরার সম্প্রচার বাংলাদেশে বন্ধ করা উচিত নয়। আর রিট আবেদনকারীর সংক্ষুব্ধ হওয়ার যৌক্তিকতা নেই।
পরে ১৭ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য শুনানি করে আদেশের জন্য রাখেন আদালত।
হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
প্রথমে আদালতে মতামত প্রকাশ করেন আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী, এরপর কামাল উল আলম, ফিদা এম কামাল, প্রবীর নিয়োগী, শাহদীন মালিক ও আব্দুল মতিন খসরু।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন রিটকারী ব্যারিস্টার এনামুল কবির ইমন। বিটিআরসির পক্ষে শুনানিতে ছিলেন খন্দকার রেজা-ই রাকিব। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার নওরোজ মো. রাসেল।
অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে প্রথমেই সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলী এ রিটের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
তিনি বলেন, যিনি রিট দায়ের করেছেন তিনি কীভাবে সংক্ষুব্ধ হয়েছেন। যেখানে বিটিআরসি রয়েছে। সংশ্লিষ্ট আইন রয়েছে। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সেখানে আবেদন করতে পারতেন। তা না করে তিনি রিট দায়ের করেছেন। এছাড়া আমাদের সংবিধানে ফ্রিডম অব প্রেসের (মুক্ত গণমাধ্যম) কথা বলা হয়েছে। সে বিবেচনায় বাংলাদেশে চ্যানেলটি বন্ধ করা উচিত হবে না বলে আমি মনে করি।
রিট দায়েরের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে একই প্রশ্ন তুলে আইনজীবী কামাল উল আলম বলেন, রিটটি দায়েরের পূর্বে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আইনি (লিগ্যাল) নোটিশ পাঠাতে পারতেন। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইনও রয়েছে। তা তিনি করেননি।
এরপর তিনি ফ্রিডম অব প্রেসের বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, এখানে (আল জাজিরার প্রতিবেদনে) জনগণের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন হয়েছে এমনটি আমার মনে হয়নি। বিভিন্ন অনুসন্ধান রিপোর্ট তুলে ধরে তিনি বলেন, আল জাজিরা একটি আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেল। এর সীমা বিশ্বব্যাপী, কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সর্বোচ্চ আদালতের তো ট্যারিটরি (অধিক্ষেত্র) শুধুমাত্র বাংলাদেশ। বাংলাদেশ চাইলেই সেই চ্যানেল বন্ধ করতে পারবে না। তবে, বাংলাদেশে এর লিংকটা বন্ধ করা যাবে।
তিনি বলেন, অভিযোগসহ ঘণ্টাব্যাপী একটা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করল আল জাজিরা। যেখানে প্রধানমন্ত্রীর নাম বললেও কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কোনো যোগসূত্র দেখাতে পারেনি। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীকে বিতর্কিত করা হলে রাষ্ট্রকেই বিতর্কিত করা হয়।
তবে এ বিষয়ে করা রিটের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে একই ধরনের প্রশ্ন তুলেন তিনিও। তার কারণ রিটকারী কি কারণে সংক্ষুব্ধ হয়েছে তা তিনি দেখাতে পারেননি।
আইনজীবী ফিদা এম কামাল বলেন, রাষ্ট্রের কাছে সেটা বন্ধ করার ক্ষমতা আছে। কিন্তু তারা সেটা করেনি। এখন রাষ্ট্র সেটা কেন করেনি, সেটা রিট আবেদনকারীকে রাষ্ট্রের এই অ্যাকশন বা ইন-অ্যাকশন জনগণের স্বার্থে বিপরীতে গেছে সেটা প্রমাণ করে দেখাতে হবে।
রিটের অধিক্ষেত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবী প্রবীর নিয়োগী। ক্ষেত্র বিশেষে রিটটি গ্রহণযোগ্য নয় বলে মত দেন তিনি। বলেন, এটি একটি আন্তর্জাতিক চ্যানেল। সেটি আমাদের এখন থেকে বন্ধ করা সম্ভব কিনা, বরং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রয়েছে। সেখানে না গিয়ে তিনি কেন সংক্ষুব্ধ হয়েছে সে প্রশ্ন উঠে এসেছে।
আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, বিটিআরসি তথ্যগতভাবে বাংলাদেশে তার লিংকটি ব্লক করতে পারে। কিন্তু দেশের বাইরে তো আর পারবে না। তবে দেশ থেকে যদি চ্যানেলটির লিংক বন্ধ করা হয় তাহলে দেশের যে ফ্রিডম অব প্রেসের ইমেজ আছে সেটি নষ্ট হবে।
এদিকে রিটের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুললেও আব্দুল মতিন খসরু ভিন্ন মত দেন। তিনি রিটের গ্রহণযোগ্যতার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। বলেন, এখানে রিটকারীর সংক্ষুব্ধ হওয়ার যৌক্তিকতা রয়েছে। কেননা সকলেরই আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার আছে। সে কারণে এই রিট দায়েরের যৌক্তিকতা আছে বলে আমি মনে করি। কেননা সংবিধান তাকে সে অধিকার দিয়েছে।
বাংলাদেশে আল জাজিরার সম্প্রচার বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি রিট দায়ের করেন আইনজীবী এনামুল কবির ইমন। রিটে ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব, তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসির) চেয়ারম্যান, পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ (আইজিপি) সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়।
ওই রিটের শুনানি নিয়ে গত ১০ ফেব্রুয়ারি আদালত মতামত গ্রহণের জন্য ৬ অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দেন। তারই ধারাবাহিকতায় আজকে ছয় অ্যামিকাস কিউরি তাদের মতামত তুলে ধরেন।