১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব বাংলায় বাংলা ভাষার দাবিতে যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয় তাতে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতৃত্ব বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। উপরস্ত পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগ নেতৃত্বে উপদলীয় কোন্দল, গণবিচ্ছিন্নতা (যা আমরা বিস্তারিত পরে আলোচনা করবো) প্রভৃতি কারণে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯ মার্চ ঢাকা সফরে আসেন। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে প্রায় এক বছর আগে পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতা যে কায়েদে আজমকে মাথায় নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শামিল হয়েছিল জিন্নাহর ঢাকা আগমনে সেই ছাত্র জনতার মধ্যে তেমন কোন স্বতঃস্ফূর্ততা লক্ষ্য করা গেল না। এ প্রসঙ্গে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম ছাত্রনেতা, শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী তাজউদ্দিন আহমদ তাঁর ডায়েরীতে লিখেছেন : …১৯ মার্চ, ১৯৪৮ সালে কায়দে আযম এসেছেন ঢাকায়। রাস্তার দুপাশে হাজার হাজার লোক।…একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, লোকজনের মধ্যে শ্লোগান তোলার মতো তেমন উচ্ছাস দেখা গেল না। সাম্প্রতিক পুলিশী নির্যাতনের ফলে ছাত্ররা নিস্পৃহ। রাতে শহরের নানা জায়গায় বোমা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল।
যাই হোক ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ জিন্নাহ বিকেলের দিকে ঢাকা এসে পৌঁছান। এরপর ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভাষণদানকালে বাংলা ভাষার বিরোধিতা করে বলেন, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। যারা এ ব্যাপারে বিভ্রান্তির-সৃষ্টি করছেন তাঁরা বিদেশী রাষ্ট্রের অর্থভোগী চর তথা পাকিস্তানের শত্ৰু। রাষ্ট্রভাষা একটি হলে কোন জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে না। জিন্নাহর এই বক্তব্য সাধারণ মানুষ তেমন কোন প্রতিবাদ না করলেও ছাত্ররা ঠিকই না’ ‘না বলে এর প্রতিবাদ করে। আর ছাত্র সমাজের এই সমবেত প্রতিবাদেও নেতৃত্ব প্রদান করেন শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদ ও আব্দুল মতিন। এ প্রসঙ্গে জিল্লুর রহমান এক নিবন্ধে বলেছেন :
..ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে তিনি (জিন্নাহ) বলেছিলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। জিন্নাহ সাহেবের এ উক্তির সাথে সাথেই জনতার মধ্য থেকে প্রতিবাদ উঠেছিল। সকলকে আমি চিনতাম না। কিন্তু অনেকের মধ্যে আমাদের বঙ্গবন্ধু, সেদিনকার মুজিব ভাই-তিনিই সকলের আগে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘না’ বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।
যদিও শেখ মুজিবের এই না’, ‘না’ প্রতিবাদ সেদিন রেসকোর্সের বিশাল জনসমুদ্রের গুঞ্জনে চাপা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্জন হলে তা আবার গর্জে উঠল । আর এবার শুধু শেখ মুজিব, আব্দুল মতিন বা তাজউদ্দিন নয় বরং কার্জন হলের সকল ছাত্রের কণ্ঠে তা ধ্বনিত হল। উক্ত সমাবর্তনে জিন্নাহ আবারও ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ বলে ঘোষণা দিলে ছাত্রদের ‘না’, ‘না’ প্রতিবাদ গুঞ্জনে জিন্নাহর কণ্ঠস্বর যেন স্তিমিত হয়ে এল। বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন ভাষায় : …রেসকোর্সের বক্তৃতা এবং এই একই সমাবর্তন বক্তৃতায় প্রথম দিকেও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা জিন্নাহ যে কারণেই বলেছেন সেখানেই তিনি সেটাকে একটা ঘোষণার মতো প্রচার করেছেন। কিন্তু এই প্রথম তিনি উর্দুকে উল্লেখ করতে গিয়ে অপেক্ষাকৃত মৃদু ভাষা প্রয়োগ করে বললেন, ‘আমার মতে একমাত্র উর্দুই হতে পারে সেই ভাষা।
মোটকথা, রেসকোর্সের ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বাঙালির প্রাণের ভাষা, মায়ের ভাষা বাংলাকে কটাক্ষ করে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তাতে করে বাংলার ছাত্রসমাজ পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিল যে জিন্নাহ কার্জন হলের সমাবর্তনেও বাংলা ভাষাকে আক্রমণ করে অনুরূপ বক্তব্য রাখবেন। তাই শেখ মুজিবুর রহমান, আব্দুল মতিন, তাজউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ ছাত্রনেতা জিন্নাহর বাংলাভাষা বিরোধী এমন আচরণের প্রতিবাদ করার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন। ফলশ্রুতিতেই ২৪ মার্চ জিন্নাহ একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা দিলে কার্জন হলের ছাত্ররা সম্মিলিতভাবে না’, ‘না প্রতিবাদ করে জিন্নাহর কণ্ঠস্বরকে রুদ্ধ করে দেয়।
কার্জন হলের ঘটনার গুরুত্ব উপলব্ধি করে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় সংগ্রাম পরিষদ ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সাথে পৃথক পৃথকভাবে বৈঠকে মিলিত হন। অবশ্য এসব বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল ছাত্র রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন। তাই সেসব বৈঠকে তিনি ভাষার ব্যাপারে কোন আপোষ রফা না করে বরং একমাত্র উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি ইতোপূর্বে সংগ্রাম পরিষদ ও নাজিমুদ্দীন সরকারে (প্রাদেশিক সরকার) মধ্যে সম্পাদিত ভাষা সম্পর্কিত চুক্তিটি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন এবং পূর্বের ন্যায় অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেন যে, উর্দু ব্যতীত অন্যকোন ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দাবি করার অধিকার পাকিস্তানের কোন নাগরিকের নেই। শুধু তাই নয় সে দাবি কেউ উত্থাপন করলে, একথা নিশ্চিতভাবেই ধরে নেয়া হবে যে, সেই ব্যক্তি রাষ্ট্রের শত্রু, ভারতের পোষা গুপ্তচর এবং সেই হিসেবে নাগরিক অধিকারের অযোগ্য।
এসময় মুসলিম ছাত্রলীগের শাহ আজিজুর রহমানের গ্রুপটি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সমর্থন ও আশীর্বাদ লাভ করে। ফলে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাথে শাহ আজিজুর রহমানের সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে। শেখ মুজিব স্পষ্ট বুঝতে পারেন যে, জিন্নাহসহ মুসলিম লীগ নেতৃত্ব শুধু ভাষার প্রশ্নেই নয় আর্থ-রাজনৈতিক কোন প্রশ্নেই বাংলার জনগণকে সহানুভূতি দেখাবে না। তাই তিনি মুসলিম লীগ রাজনীতি থেকে একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নেন এবং তাজউদ্দিন, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, শামসুল হক, নঈমুদ্দিন আহম্মদ, কামরুদ্দিন আহমেদ প্রমুখের সাথে মাতৃভাষা বাংলাসহ অন্যান্য আর্থ-রাজনৈতিক অধিকারের দাবিতে মুসলিম লীগ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন।
কিন্তু মুসলিম লীগের অব্যাহত ষড়যন্ত্র, সরকারের দমননীতি, নির্যাতনে এ প্রচেষ্টা ব্যাহত হয়। শেখ মুজিবের ক্রমবর্ধমান ভাষার আন্দোলন ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদানে ঈর্ষান্বিত হয়ে সরকার তাঁকে ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কারারুদ্ধ করেন। উল্লেখ্য যে এই দিনেই অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করেন।
মুজিবের গ্রেফতারের কারণে ভাষা আন্দোলনের গতি কিছুটা শ্লথ হয়ে আসলেও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ, গণতান্ত্রিক যুব লীগভুক্ত নেতাকর্মীরা ও সাধারণ ছাত্রসমাজ ভাষার দাবিতে আন্দোলন বেগবান করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম শরীক তমদুন মজলিসের পিছুটান ও আপোসকামিতা এই উদ্যোগকে ব্যাহত করে। এ প্রসঙ্গে একজন গবেষক লিখেছেন : ..এই পর্বের আন্দোলনে তমদ্দুন মজলিশের পিছুটান ও আপোসকামিতা অবশ্যই স্মরণযোগ্য। বস্তুত এই সংগঠন রাজনৈতিক চিন্তায় প্রগতিশীল সমাজ ব্যবস্থার ঘোর বিরোধী ছিল। সম্ভবত বাংলা রাষ্ট্রভাষা বিষয়টিকে তাদের এই বিশেষ প্রয়োজনের অংশ হিসেবেই তারা দেখতে চেয়েছিলেন, বাঙালি জাতিসত্তার সাথে সমন্বিত করে নয়। মতাদর্শগত এই বৈশিষ্ট্যের কারণে তারা ভাষা আন্দোলনকে একটি সংকীর্ণ দৃষ্টির পরিসীমায় ধরে রাখতে চেয়েছিলেন এবং এই জন্য তারা আন্দোলনে আপোসপন্থা গ্রহণে দ্বিধা করেননি। এর প্রমাণ মার্চে জিন্নাহ সাহেবের পূর্ববঙ্গ সফর উপলক্ষে ভাষা বিষয়ক লক্ষ্য অর্জনে তাদের আনন্দ ও প্রত্যাশা এতই স্পষ্ট ছিল যে, কোন দূরদর্শিতার পরিচয় না রেখেই লীগ শাসকদের সাথে সমঝােতার ভিত্তিতে তারা মাঝপথে আন্দোলন স্থগিত করে দিতে এতটুকু দ্বিধা করেননি। এমনকি জিন্নাহ সাহেবের চলে যাবার পর লক্ষ্য অর্জনে চূড়ান্ত ব্যর্থতা সত্ত্বেও সেই স্থগিত আন্দোলন শুরু করা কোন উদ্যোগ তারা গ্রহণ করেননি। এই বিষয়ে সংগ্রাম পরিষদকে উজ্জীবিত করার কোন চেষ্টাও তারা করেননি।
তমদ্দুন মজলিসের এমন আপোসকামী মনোভাবের কারণে এই সময় আন্দোলন কিছুটা ঝিমিয়ে পড়লেও একেবারে থেমে যায়নি। এসময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা সাধারণ ছাত্রসমাজকে সঙ্গে নিয়ে ভাষার দাবিতে আন্দোলনে শরীক হয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এসময় (১৯৪৯ সালে) বাংলাকে ধ্বংস করার লক্ষ্য হিসেবে আরবি হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এক বিবৃতির মাধ্যমে এর জোরালো প্রতিবাদ করে। প্রতিবাদলিপিতে ছাত্রনেতা নঈমুদ্দিন আহমদ বলেন, “…তোগলকী প্ল্যানের উদ্যোক্তাদের আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই যে, আরবি বর্ণমালার ধুয়া তুলে গত বছরের ভাষা প্রস্তাব নাচক করার ষড়যন্ত্রকে আমরা কোনমতেই সহ্য করে নেব না।”