‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ শিরোনামে আল জাজিরার থ্রিলারধর্মী ডকুড্রামাটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এই আশায় যে, এটি প্রকাশের পর বাংলাদেশে একটি অভ্যুত্থান ঘটবে। অভিনব সিনেম্যাটোগ্রাফি, নাটকীয় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ও দারুণ কিছু থ্রিলারধর্মী অ্যানিমেশনের ব্যবহারের মাধ্যমে এটিকে সরকারবিরোধী প্রোপাগান্ডার একটি অস্ত্র হিসেবে ছড়ানো হয়েছিল। তাদের ধারণা ছিল, এটি প্রকাশের পর দেশে তুলকালাম শুরু হয়ে যাবে, কিন্তু তাদের সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
দেশের মানুষ ইতোমধ্যে জেনে গেছেন যে, এই ডকুড্রামাটি একসময়ের একটি সফল প্রতিবেদনের অনুকরণে বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৭৬ সালে ‘অল দ্য প্রেসিডেন্টস মেন’ শিরোনামে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল, যার ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন নিক্সন সরকারের পতন ঘটে। এর প্রতিবেদক ছিলেন বব উডওয়ার্ড ও কার্ল বার্নেস্টাইন। তারা যথাযথ তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছিলেন। তবে এবারের প্রক্ষাপট ভিন্ন। এবার বাংলাদেশকে নিয়ে যে ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ নামের ডকুড্রামাটি তৈরি করা হয়েছে, সেটিকে সাংবাদিকতা বলার কোনো সুযোগই নেই, কারণ এখানে প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে একটা হাইপ তোলার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণই উপস্থাপন করা হয়নি। এটি তৈরি করেছে বার্গম্যান। সে এখানে সাংবাদিকতার কোনো নৈতিকতাই মানেনি। সে যে কাজটি ভালো পারে, তা হলো ব্যাপকহারে নেতিবাচক প্রচারণা চালানো। আওয়ামী লীগের প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে বার্গম্যান এবারও তাই করেছে। এর কারণ হলো, বার্গম্যানের শ্বশুর ড. কামাল হোসেন ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াতকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে একটি জোট গঠন করে, তখন এটি বেশ হাইপ তুলেছিল কিন্তু ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র ৭টি আসনে জয় লাভ করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের কাছে ধরাশায়ী হওয়ার পরও তারা নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়েছে।
এবারের এই ডকুড্রামাটি তৈরি করা হয়েছে মিস্টার হারিস নামে এক ব্যক্তির গোপন ভয়েস রেকর্ডকে ভিত্তা করে, আল জাজিরার এই থ্রিলারের মধ্যেই (৬ মিনিট ৪২ সেকেন্ডে) হারিসকে সাইকোপ্যাথ বা মানসিক রোগী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, হারিস বাংলাদেশ থেকে পলাতক এক ব্যক্তি যে খুনের দায়ে দণ্ডিত হয়ে দেশ ছেড়েছে এবং অনেক অবিশ্বাস্য বিষয়ে নিজেকে জাহির করে সে। এই ডকুড্রামায় অভিযোগ করা হয়েছে যে, মিস্টার হারিস ও তার ভাই বাংলাদেশের সব রাষ্ট্রীয় বিষয়াবলী পরিচালনা কর থাকে। এই দাবির জবাবে ইতোমধ্যে দুটি প্রতিবাদলিপি দেখেছি আমরা। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে একটি প্রতিবাদ জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আরেকটি প্রতিবাদলিপি দিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে আইএসপিআর। এছাড়াও বিভিন্ন মিডিয়াতে আমরা এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যও শুনেছি।
আল জাজিরার দাবি এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রতিক্রিয়া
আল জাজিরা যেসব বিষয়ে অভিযোগ তুলে বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের খেলায় মেতে উঠতে চেয়েছে, সেসব প্রত্যেকটি বিষয় ধাপে ধাপে নিচে খোলাসা করা হয়েছে। মূলত এসব বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইএসপিআর-এর অফিসিয়াল প্রতিবাদ রয়েছে এবং তাদের বক্তব্যের মাধ্যমেই বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো।
১. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী মিস্টার হারিস
আল জাজিরার এই ডকুড্রামায় দাবি করা হয় যে, মিস্টার হারিস আহমেদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ছিলেন। এই দাবির পক্ষে নব্বইয়ের দশকের একটি ছবি দেখিয়েছে আল জাজিরা, যেখানে শেখ হাসিনা বক্তব্য দিচ্ছিলেন এবং একই মঞ্চে তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় হারিসকে। তখন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীই হননি। আর এমন একটি মাত্র ছবি প্রমাণ করে না যে- কোনো সময় শেখ হাসিনার দেহরক্ষী ছিলেন হারিস। আর এই ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন, বিরোধী দলীয় নেত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা কখনোই কোনো ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ছিল না। আল জাজিরার ‘বডিগার্ড (দেহরক্ষী)’ শব্দটা সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেছেন- বডিগার্ড বলতে যদি দলীয় নেতাকর্মীদের বোঝানো হয়, তাহলে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার কোটি কোটি বডিগার্ড আছে। প্রকৃতপক্ষে একজন নেতার সঙ্গে অনেক মানুষের ছবি থাকে। কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়া, শুধু একই ফ্রেমের মধ্যে থাকা একটা পুরনো ছবি দিয়ে আল জাজিরার কী বোঝাতে চাচ্ছে তা বোধগম্য নয়, আর এটি বিশ্বাসযোগ্যও নয়।
২. হারিসের ব্যাপারে ভুয়া দলিল এবং অর্থ-পাচারের অভিযোগ
ডেভিড বার্গম্যানের সঞ্চালনায় আল জাজিরার ডকুড্রামায় দেখানো হয় যে, আহমেদ ভাইয়েরা ‘ডিএইচএল এক্সপ্রেস সার্ভিস’ ব্যবহার করে মিস্টার হারিসের কাছে একটি নতুন পাসপোর্ট এবং কিছু ডকুমেন্ট পাঠিয়েছে। তারা সেখানে সেই কুরিয়ার পাঠানোর সিরিয়াল নাম্বার, কুরিয়ার পাঠানোর এবং তা গ্রহণ করার সময়সহ আরো কিছু তথ্য দেখিয়েছে। আল জাজিরা দাবি করেছে যে, হারিসের কাছে পাঠানো পাসপোর্ট এবং অন্যান্য ডকুমেন্ট পাঠানোর সেই সিরিয়াল নাম্বার হলো ১৪৯৪৬০২৯৫৫। আরও বলা হয় যে, ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি দুপুর ১২টা ৪৬ মিনিটে ঢাকা থেকে এই পার্সেলটি পাঠানো হয় এবং ১৩ জানুয়ারি সকাল ১১টা ৫৫ মিনিটে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে পা ডেলিভারি দেওয়া হয়।
কিন্তু ডিএইচএল ‘ডিএইচএল এক্সপ্রেস সার্ভিস’ অনলাইন আর্কাইভের পুরনো তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, এই তথ্য পুরোপুরি মিথ্যা। ১১ জানুয়ারির ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা থেকে বুদাপেস্ট পাঠানোর জন্য এরকম কোনো পার্সেল দেওয়া হয়নি ডিএইচএল-এ।
প্রকৃত সত্য হলো, এটি একটি ভুয়া ডকুমেন্ট বানানো হয়েছে। যার মাধ্যমে তারা দেখাতে চেয়েছে যে, আহমেদ পরিবার হলো প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এবং তারা টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত ও সেনাবাহিনীর খাত থেকেও তারা অবৈধভাবে টাকা সংগ্রহ করে।
তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই, বার্গম্যান যে ডকুমেন্ট দেখিয়েছে সেই ফটোকপিটা সে ‘ডিএইচএল এক্সপ্রেস সার্ভিস’ থেকেই সংগ্রহ করেছিল; তবুও কী এতে প্রমাণ হয় যে- মিস্টার হারিস এর মাধ্যমে অর্থ পাচার করেছেন। একারণে এসব ভুয়া তথ্য সংযোজনের মাধ্যমে যে একটা অপচেষ্টা চলছে, সেটাই আমাদের ভাবার বিষয়। এখানে কোথাও কী টাকা-পয়সা লেনদেনের কোনো তথ্য আছে? শেখ হাসিনা যে হারিসকে সুরক্ষা দেন সে ব্যাপারে কী কোনো তথ্য আছে, শেখ হাসিনার সঙ্গে কী এসবের কোনো সম্পর্ক আছে? রাষ্ট্রীয় কোনো ব্যক্তির সঙ্গে হারিসের কোনোরকম যোগাযোগ আছে, এরকম কোনো তথ্য কী আল জাজিরা দেখাতে পেরেছে? আসলে তারা এরকম কোনো তথ্যই দেখাতে পারেনি। তারা বানোয়াট ডকুমেন্ট বানিয়ে রঙ চঙ মেখে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে।
এই ডকুড্রামাটিতে দেখা যায়, আলজাজিরা একজন নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ হিসেবে গ্রাহাম ব্যারনকে উপস্থাপন করেছে। তাকে অর্থনৈতিক অপরাধ সম্পর্কিত একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। তার কাছে মিস্টার হারিসের বিনিয়োগের ধরণ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। তিনিও এটিকে সরাসরি অপরাধ বলে মন্তব্য করেননি। তিনি বলেছেন, এই বিনিয়োগের ধরণটি আর্থিক অপরাধের সঙ্গে বেমানান নয়। কিন্তু তিনি স্পষ্ট করে বলেননি যে, এর সঙ্গে অর্থ পাচারের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এমনিক আল জাজিরাও কোনোখানে প্রমাণ করতে পারেনি যে, এখানে কোনো আর্থিক অপরাধ হয়েছে। বরং এটাই সত্য যে- যেসব ডকুমেন্টকে টুইস্ট করে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে, একটি নতুন দেশে একজন নতুন উদ্যোক্তার জন্য এসব তথ্য ও ডকুমেন্ট খুবই স্বাভাবিক। আমরা ইউরোপের অনেক বাংলাদেশির কাছেও এরকম অনেক উদ্যোগ ও ব্যর্থতার গল্প শুনেছি। তবে তাদের সবাইকে কী এভাবে অর্থ পাচারকারী বা অপরাধীর মতো নিন্দনীয় তকমা দেওয়া ঠিক হবে?
৩. আর্মি ও বিজিবির জন্য হাঙ্গেরির তৈরি বুলেট এবং বাঙ্ক বেড সংগ্রহের সঙ্গে হারিসের সম্পৃক্ততা
আল জাজিরার ডকুড্রামায় দাবি করা হয়েছে যে, হাঙ্গেরি থেকে বাংলাদেশ আর্মির জন্য গুলি এবং বিজিবির জন্য বাঙ্ক বেড ক্রয় করার ক্ষেত্র মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছে মিস্টার হারিস। প্রথম বিষয়টি হলো হাঙ্গেরি থেকে বাংলাদেশ আর্মির গুলি ক্রয় করা। একটি গোপন ভিডিও দেখিয়ে বলা হয় (১৩ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড) যে, মিস্টার হারিস মিস্টার সামির সঙ্গে গুলি কেনার চুক্তির ব্যাপারে কথা বলছেন। এবং আরও বলা হয়, তার কনসার্ন ছাড়া যখন এই চুক্তি হতে যাচ্ছিলো তখন মিস্টার হারিস বুদাপেস্ট থেকে কোনো একজনকে ফোন করে সেই চুক্তি থামাতে বলেন। আল জাজিরার সেই ডকুড্রামায় আরও দাবি করা হয়, সেই ফোনে মিস্টার হারিস বাংলাদেশ আর্মির গোয়েন্দা সংস্থার এক ব্যক্তিকে ফোন দিয়ে সহযোগিতা করতে অনুরোধ করেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে হারিসকে বলতে শোনা যায়, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- হারিস যদি কিছু করতে চায়, তাকে তা করতে দাও। আমরা সাহায্য করবো।’
যাই হোক, এটা ছিল একটা দুর্দান্ত ধাপ্পাবাজি। আলজাজিরা ইতোপূর্বে এই হারিসকে সাইকোপ্যাথ হিসেবে অভিহিত করেছে। একজন মানসিক রোগী বা সাইকোপ্যাথের এরকম ধাপ্পাবাজি কী আসলেই গ্রহণযোগ্য কোনো তথ্য? উপরন্তু, মিস্টার হারিস আসলেই এই চুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন কিনা তা আসলে তার পরিষ্কার করে বলেনি আল জাজিরা। হারেসের এসব কথার মাধ্যমে আসরেই কোনো কাজ হয়েছে কিনা সে ব্যাপারেও আল জাজিরা ও বার্গম্যান গং কোনো ধরনের তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি।
৪. বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক এবং বিভিন্ন চুক্তিতে মিস্টার হারিসের ভূমিকা
আল জাজিরার ডকুড্রামায় দেখানো হয়েছে, মিস্টার হারিস একটি আন্তর্জাতিক হোটেল কিনে নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেছেন, যেখানে একজন বাংলাদেশি-আইরিশ নাগরিক তাকে ব্যবসার বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। ওই বৈঠকে তারা দাবি করেন যে, হারিসের ভাইয়েরাই আসলে বাংলাদেশ চালাচ্ছেন। ভিডিওটির আরেকটি অংশে দেখা যায় যে, মিস্টার হারিস দাবি করছেন যে, তিনি তার ইচ্ছামতো বাংলাদেশের মন্ত্রীদের ব্যবহার করেন। এছাড়াও বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তাদের পোস্টিং এবং প্রমোশনের বিষয়গুলোও ঠিক করে দেন হারিস। কিন্তু হারিসের কথামতো একজন ব্যক্তিরও প্রমোশন বা পোস্টিং হয়েছে কিনা এ বিষয়ে আল জাজিরা আমাদের ছোট্ট একটি প্রমাণও দেখাতে পারেনি। এটি একজন সাধারণ মানুষের কাছেও বোধগম্য নয় যে, আল জাজিরা কীভাবে একজন ব্যক্তির মুখের কথাকে কেন্দ্র করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করলো, যখন তারা নিজেই নিজেই সেই ব্যক্তিকে সাইকোপ্যাথ হিসেবে অভিহিত করেছে।
৫. আর্মি কর্তৃক গোয়েন্দা সরঞ্জামাদি কেনা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার
মিস্টার সামির কথার ওপর ভিত্তি করে আল জাজিরা জানিয়েছে যে (৪৪ মিনিটে), সেনা গোয়েন্দা সংস্থার চার জন ব্যক্তি হাঙ্গেরিতে গিয়েছিল, যাদের সঙ্গে সামির কোনো র্পূর্ব পরিচয় ছিল না। এরপর সামি তাদের রাতের খাবারের দাওয়াত দেয়। সেই অপরিচিত ব্যক্তিরা সামিকে জানিয়েছিল, তারা আরো তিন জন অতিথি সঙ্গে নিয়ে আসবেন। আল জাজিজার দাবি, এই তিন জন অতিথির মধ্যে দুজন ছিল ইসরায়েলের কর্মকর্মা এবং আরেকজন ছিল আয়ারল্যান্ডের তথা আইরিশ। তবে আল জাজিরা এই দাবির পক্ষে কোনো যক্তি বা প্রমাণ দেখাতে পারেনি। বরং তাদের ভাষ্যমতে, সেই দুজন ইসরায়েলি কর্মকর্তা পরবর্তীতে ডিনারে যোগ দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। এরপর আল জাজিরা একটি ছবি দেখিয়ে বিভ্রম সৃষ্টি করে, তারা বলতে চায় যে সেখানেই সেই ব্যক্তিরা আছেন। কিন্তু ছবিতে তারা কোনো ইসরায়েলি অফিসারকে শনাক্ত করে দেখায়নি।
মিস্টার সামি এসময় দাবি করেন, আইরিশ ওই ব্যক্তি কিছু নজরদারি সরঞ্জাম বিপণন সংস্থার ঠিকাদার ছিলেন। সামির আরও দাবি, কিছু গোয়েন্দা সরঞ্জামাদি কেনার ব্যাপারে তিনি ওই ব্যক্তিদের আলোচনা করতে শুনেছেন এবং সেই কথোপকথোনের ভিডিও ধারণ করেছেন। তবে বাস্তব অর্থে, সেই ভিডিওতে কোনো ব্যক্তির মুখ দেখা যায়নি বরং শুধু একটি কণ্ঠ শোনা যায়, যেখানে একজন ব্যক্তি কিছু গোয়েন্দা সরঞ্জাম কেনার সুযোগের ব্যাপারে কথা বলেছে। কিন্তু এটি আসলে কার কণ্ঠ তা জানা নিশ্চিত করে বলা হয়নি এবং আমরাও আসলে এ বিষয়ে সন্দিহান। যে কেউ আসলে ডকুমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করার জন্য পরিচয় ছাড়া এভাবে কথা বলতে পারে এবং যে কারো নামে তা দিয়ে প্রোপাগান্ডা করা সম্ভব, তবে এরকম প্রমাণ ছাড়া উড়ো কণ্ঠ দিয়ে আসলে কোনো সংবাদ হয় না। এর কোনো বিশ্বাসযোগ্যতাও নেই।
এমনকি মিস্টার সামির যে দাবি করেছেন, সেখানে সেনা গোয়েন্দা সংস্থার চার জন ব্যক্তি ছিলেন; তাদের কারো নাম-পরিচয় বা ছবিও দেখাতে পারেননি সামি। এমনি কোনো ইসরায়েলির অস্তিত্বর প্রমাণও দেখাতে পারেননি তিনি।
আল জাজিরার ভিডিওতে সামি নিজেই বলেছেন যে, ওই ব্যক্তিরা তার পরিচিত নন। তাহলে এটি কী বিশ্বাসযোগ্য যে, সেনা গোয়েন্দা সংস্থার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা তাদের অপরিচিত কোনো ব্যক্তির সামনে গোয়েন্দা সরঞ্জাম কেনার বিষয়ে আলোচনা করবেন?
আবার মিস্টার হারিসের একটি ফোনকল রেকর্ড শুনিয়েছেন মিস্টার সামি, তবে এখানো কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। মিস্টার হারিস আসলে কার সঙ্গে কথা বলছিলেন এবং আসলেই তার কোনো কথা পরবর্তীতে বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা সে ব্যাপারেও কিছু জানায়নি আল জাজিরা।
অপরদিকে, আইএসপিআর এর প্রতিবাদে শক্তভাবে এর প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। ইসরায়েল থেকে মোবাইল ইন্টারসেপ্টর ডিভাইস কেনার ব্যাপারটিকে মিথ্যাচার বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি সেনাবাহিনীর জন্য হাঙ্গেরিতে উৎপাদিত গোয়েন্দা সরঞ্জামাদির ব্যাপারে আল জাজিরা যে চুক্তি দেখিয়েছে সেটার প্রতিবাদ জানিয়েছে। আইএসপিআর স্পষ্টভাবে আরও জানিয়েছে যে, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের জন্য হাঙ্গেরি থেকে ওই সরঞ্জামগুলো কেনা হয়েছিলো।
এদিকে বিশ্বব্যাপী এটা সবাই জানে যে, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর জন্য নিয়মিতই উৎপাদিত পণ্যের রফতানিকারক দেশ পরিবর্তন করে ইসরায়েল। এছাড়াও কূটনৈতিক স্বীকৃতির না থাকা মানে এই নয় যে, কোনো দেশ একটা ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারবে না। এর একটি ছোট্ট উদাহরণ হলো, তাইওয়ান। বাংলাদেশ তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু এই দুই দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ব্যবসা চলমান রয়েছে।
এছাড়াও, এটি পরিষ্কার করে বলা হয়নি যে নজরদারি সরঞ্জাম কেনার সঙ্গে মিস্টার হারিসের আসলেই কোনো সম্পৃক্ততা ছিল কিনা। জাজিরার প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, এই হারিস একজন মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি এবং তিনি দাবি করেছেন যে, তিনি পুরো বাংলাদেশ চালান। বাস্তবতা হলো হারিস বাংলাদেশের আদালতে সাজাপ্রাপ্ত একজন ব্যক্তি, তিনি কী বললেন না বললেন তার সঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তবতার কোনো সম্পর্কই নাই। আল জাজিরার এই ভিডিও দেখে মনে হয় যে, তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রেমিকাকে ঘুষ দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করেছেন। এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এসে এটা পুরোই হাস্যকর একটা বিষয়।
৬. পলাতক আসামি হয়েও ঢাকায় ভাতিজার বিয়েতে হারিসের উপস্থিতি
এক ঘণ্টার এই ভিডিও থ্রিলারের অন্যতম একটি অংশ হলো, পলাতক আসামি হয়েও হারিস তার ভাতিজার বিয়েতে উপস্থিত হয়েছিলেন ঢাকায়। সেই অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকেও দেখা গেছে। তবে শুধু এই নির্দিষ্ট একটি ব্যাপারে এখন পর্যন্ত সরকার বা কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি। আশা করা যাচ্ছে, সরকার এই বিষয়টি নিয়ে দ্রুত তদন্ত করবে।
আল জাজিরার সাংবাদিকতা নৈতিকতা কোথায়?
সামি (ছদ্মনাম), প্রকৃত নাম হলো জুলকারনাইন সায়ের, তিনি একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত হাঙ্গেরির নাগরিক। তিনি এই ডকু-ড্রামার মূল বর্ণনাকারী। বিভিন্ন গোপন ক্যামেরার মাধ্যমে মিস্টার হারিসের বক্তব্যের রেকর্ড ধারণ করেছেন এই সামি। এই ছোট ভিডিওগুলোতে কিন্তু এটা স্পষ্ট হয়নি যে, হারিস আসলে কার সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন। হারিস কী আসলেই কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন, নাকি অন্য কারো সঙ্গে; তা প্রমাণিত নয়। এমনকি বিজিবির জন্য কিছু সরঞ্জাম কেনার কথা উল্লেখ করলেও আল জাজিরা কোনো প্রমাণ বা কাগজপত্র পর্যন্ত দেখাতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে সংবাদ হওয়ার জন্য যেসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রমাণ প্রয়োজন, তার কোনোটাই নাই আল জাজিরার এই ডকু-ড্রামায়। সিনেমার স্টাইলে দেখানো হয়েছে যে, হারিস মাফিয়াদের মতো সবাইকে হুকুম করে। পুরোটাই সিনেম্যাটিক। এই ডকু-ড্রামার অনেক তথ্যই সঠিক নয় বলে মনে হয়েছে।
এমনকি বাংলাদেশের একজন শীর্ষ জেনারেলের পাঠানো কিছু ইমেইলের ভাষা দেখানো হয়েছে, দাবি করা হয়েছে মেইলগুলো জেনারেলই পাঠিয়েছেন। তবে আল সামি ও আল জাজিরার দাবি করা সেই সব ইমেইলের কোনো স্ক্রিনশট বা প্রেরক হিসেবে দাবি করা জেনারেল আজিজের ইমেইল অ্যাড্রেসও দেখানো হয়নি। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সামান্যতম কোনো প্রমাণ ছাড়া তথ্য পরিবেশন করা সাংবাদিকতার নৈতিকতার পরিপন্থী।
সাংবাদিকতার নৈতিকতা পরিপন্থী কাজ করার ক্ষেত্রে আল জাজিরা এরকম ভূমিকা এবারই প্রথম নয়। বাংলাদেশ বিষয়ে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে এর আগেও তারা একই ধরনের কাজ করেছে। এর আগে, তারা যুদ্ধাপরাধীদের ‘বিরোধীদলীয় নেতা’ বলে অভিহিত করেছে, এমনকি গণহত্যায় দোষী সাব্যস্ত একজন যুদ্ধাপরাধীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং তাকে নিজের মতো করে গল্প বলার সুযোগ দিয়েছে।
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নাকি পূর্বনির্ধারিত এজেন্ডা বাস্তবায়ন
এক বসায় পুরো ডকু-ড্রামাটি দেখে শেষ করার পর, এর হেডলাইন এবং শিরোনামের মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টার বিষয়টি যেকোনো দ্বায়িত্বশীল ব্যক্তির কাছে স্পষ্ট হয়ে পড়ে। হেডলাইন এমনভাবে লেখা হয়েছে, যাতে মনে হয় পুরো ঘটনার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী জড়িত। তবে পুরোটা দেখার পর কোনোখানেই হারিস বা তার ভাই জোসেফের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বিন্দুমাত্র সম্পৃক্ততা দেখাতে পারেনি তারা। এমনকি শুধু একটি জায়গায় পুরনো এক সাদাকালো ছবি দেখিয়ে হারিসকে প্রধানমন্ত্রীর বডিগার্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যেটাও সত্যের অপলাপ মাত্র। এছাড়া পুরো একঘণ্টার এই থ্রিলারে আর কোথাও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কারো কোনো সম্পৃক্ততা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে আল জাজিরা। এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে বা পরে কখনোই শেখ হাসিনার কোনো বডিগার্ড ছিল না। আল জাজিরা কোনো তথ্য বা প্রমান ছাড়াই এই দাবি করেছে, যার সঙ্গে বাস্তবের কোনো সম্পর্ক নাই। মঞ্চে শেখ হাসিনার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় হারিসের নব্বইয়ের দশকের এক ছবি দেখিয়ে দাবি করা হলো- তিনি প্রধানমন্ত্রীর দেহরক্ষী ছিলেন। অথচ এরকম একজন নেতার সঙ্গে মঞ্চে হাজার হাজার মানুষের এরকম দাঁড়িয়ে থাকা ছবি পাওয়া যাবে।
পরিশেষে, আল জাজিরার কাছে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, তা হলো: ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ শিরোনামের এই ডকু-ড্রামায় প্রধানমন্ত্রী আসলে কোথায়?
লেখকঃ মো. আজহার উদ্দিন ভূঁইয়া, (শিক্ষক, আইন বিভাগ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি) এবং সৌরভ দাস রনি (ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)