প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে। সাম্প্রতিক বিশ্ব সংকট করোনাভাইরাস মোকাবিলায় অনেক বড় বড় দেশ হিমশিম খাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে বিশ্বের মধ্যে ২০তম স্থানে রয়েছে।
কল্যাণমুখী সরকার করোনা মোকাবিলায় সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা নিয়েছে বলেই এ সাফল্য এসেছে। আগামী জুনের মধ্যেই দেশের প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ করোনাভাইরাস প্রতিরোধক ভ্যাকসিন বা টিকা পাবে। সবাইকে বিনা মূল্যে দুই ডোজ করে এই টিকা দেবে সরকার। ওদিকে দৃশ্যমান হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু, দেশের মানুষের জন্য যা সত্যিকার অর্থেই দুঃসাহসী এক স্বপ্ন।
পরাক্রমশালী বিশ্বব্যাংককে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘নিজেদের টাকায়ই আমরা পদ্মা সেতু গড়ব।’ স্বল্পন্নোত একটি দেশের জন্য বিদেশি কোনো সাহায্য ছাড়াই ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা খরচ করে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা তো একটি দুঃসাহসিক পদক্ষেপই ছিল।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) প্রকাশিত মানব উন্নয়ন সূচক প্রতিবেদন-২০২০-এ বলা হয়েছে, করোনার সময়েও বিশ্বের মানব উন্নয়ন সূচকে এগিয়ে যাওয়ার ধারাবাহিকতায় গত ৩০ বছরে বাংলাদেশ এগিয়েছে ৬০ শতাংশ।
দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। পরিবেশের প্রভাবজনিত সমন্বিত মানব উন্নয়ন সূচকে আরও ৯ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ আরও দুই ধাপ এগিয়েছে। বর্তমানে এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৩তম। এ ছাড়া মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু বেড়েছে ১৪.৪ বছর। এসব অর্জনের পেছনে যে মানুষটির নিরলস শ্রম ও অধ্যবসায়, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার দৃঢ় ও দার্ঢ্য নেতৃত্বেই বাংলাদেশ আজ সব সংকট মোকাবিলা করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা, উন্নয়ন সূচকে ঊর্ধ্বগতি একশ্রেণির মানুষের একেবারেই ভালো লাগে না। বাংলায় ঈর্ষা বলে একটি শব্দ আছে। এর সঙ্গে ‘কাতর’ ও ‘পরায়ণ’ অনুসর্গ যোগ করলে ‘ঈর্ষাকাতর’ ও ‘ঈর্ষাপরায়ণ’। এসব শব্দের অর্থ তো আর নতুন করে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ঈর্ষাকাতর বা ঈর্ষাপরায়ণ গোষ্ঠী মিডিয়া ভাড়া করে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। এ যাত্রায় নতুন করে আবার ভাড়া করা হয়েছে আল জাজিরা টেলিভিশনকে।
গত ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সময় রাত ২টায় এই ভাড়াটিয়া টেলিভিশনটি All The Prime Minister’s Men শিরোনামে একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করেছে। মূল অনুষ্ঠান সম্প্রচারের আগে একটি বিশেষ চিহ্নিত গোষ্ঠী এই অনুষ্ঠানের বিষয়ে প্রচারে নামে। যে সময়ে এটি সম্প্রচার হওয়ার কথা, তার অনেক আগেই চলে আসে ইউটিউব চ্যানেলে। আর তখনই সচেতন পর্যবেক্ষকমহলের মাথায় নানা প্রশ্ন খেলা করে। তাহলে কি বাংলাদেশ সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মিডিয়ায় প্রোপাগান্ডা সৃষ্টির জন্য উদ্দেশ্যমূলক প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে আল-জাজিরা?
এমন প্রশ্ন মনে হওয়ার কারণটি হচ্ছে, আল জাজিরা বরাবরই বাংলাদেশবিরোধী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার যেদিন থেকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করে, সেদিন থেকেই এই বিচারকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্নভাবে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা চালিয়েছে এই সংবাদ মাধ্যমটি। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় জামায়াতের লবিস্ট গ্রুপগুলো। এমনকি তারা বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা ৩ থেকে ৫ লক্ষ বলে দাবি করল, যা বরাবরই বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিদের অপপ্রচারের একটি প্রয়াস।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পক্ষের লেখকদের ‘নাস্তিক ব্লগার’ বলে কুৎসা ছড়িয়ে এই মিডিয়াটি জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের কাজেও সক্রিয় ছিল। হেফাজতে ইসলামের জ্বালাও- পোড়াও কর্মসূচিতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ৫০ জনের অধিক নিহত হয়েছিল বলেও আল জাজিরা মিথ্যা সংবাদ প্রচার করে, যার সমর্থনে তারা আজ পর্যন্ত একটি দালিলিক বা অন্য কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেনি।
মুসলিম ব্রাদারহুডের পক্ষে কাজ করা, সন্ত্রাসবাদে মদদ দেয়া, উগ্র মতবাদ ও সহিংসতা উসকে দেয়া ও সরকার পতনের ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে সৌদি আরব, বাহরাইন, আরব আমিরাত, জর্ডান ও মিশরে আল জাজিরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মুসলিম ব্রাদারহুডের গভীর সম্পর্কের কারণেই রাজনৈতিকভাবে আল জাজিরা শুরু থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও আওয়ামী লীগ সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। আল-জাজিরা মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ও স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতি পক্ষপাতমূলক অনেক বনোয়াট সংবাদও অতীতে প্রকাশ করেছে। সাম্প্রতিক ভিডিও চিত্রটিও তারই ধারাবাহিকতা।
আল জাজিরার বাংলাদেশবিরোধিতার আরেকটি উদাহরণ তুলে ধরা যাক। অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন তার সাম্প্রতিক এক লেখায় প্রশ্ন করেছেন, ‘বাংলাদেশ লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে তাদের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা করেছে। বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র শরণার্থীদের তাদের দেশে প্রবেশে যেভাবে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করে, বাংলাদেশও যদি ওই সব রাষ্ট্রের মতো সীমান্ত উন্মুক্ত না করতো তাহলে রোহিঙ্গাদের পরিণতি কী হতো?’
তিনি লিখছেন, ‘ভাসানচরকে বাংলাদেশ সরকার থানা ঘোষণা করে এটি বাংলাদেশের প্রশাসনিক ইউনিটে পরিণত করেছে। ভাসানচরে কেবল রোহিঙ্গারাই নয়, রোহিঙ্গাদের দেখভাল করার জন্য পুলিশ, ডাক্তার, প্রকৌশলী, স্বাস্থ্যকর্মীসহ বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, নৌবাহিনীর সদস্য ও এনজিও কর্মীরা থাকবেন।’
তার প্রশ্ন, ‘বাংলাদেশি নাগরিক ভাসানচরে থাকতে পারলে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিয়ে কেন এমন কৃত্রিম দরদ?’ ভাসানচরে রোহিঙ্গারা যেতে আগ্রহী। কারণ সেখানে রয়েছে জীবনযাপনের উন্নত সুযোগ-সুবিধা। প্রথম ধাপে যাওয়া রোহিঙ্গারাই নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের সেখানে যেতে আহ্বান জানিয়েছেন। অথচ আল-জাজিরা কী সংবাদ পরিবেশন করল? তাদের সংবাদের শিরোনাম- ‘Bangladesh moves nearly 2,000 Rohingya refugees to remote island.’ সংবাদে বলা হয়, ‘Second group of 1,800 Rohingya refugees sent to Bhasan Char island amid concerns many of them have been coerced.’
সম্প্রতি ‘Unfairness of Al Jazeera’ শীর্ষক প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়েছে, ‘Al Jazeera, a Qatar-based television news channel, is allegedly serving the interests of middle-based Islamist extremists. It is also alleged that they are serving the interest of Iraq and Syria-based ISIS and Egypt-based Islamic Brotherhood. Due to their controversial role they had to close down their offices in the middle-east and other countries like India.’ প্রকাশিত খবরে খুব স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে, ‘Several reports say that Al Jazeera’s English language service has involved in a series of controversial activities, including giving media coverage to terrorist groups, organizations and individuals.’
২০১৭ সালের ৮ জুনে বিবিসি একটি খবরে উল্লেখ করে, ‘Al Jazeera’s broadcasting has caused controversy and drawn anger in various Arab states, not least in Egypt after the fall of Hosni Mubarak during the Arab Spring and the subsequent ousting of the elected president, Mohammed Morsi– a leader of the Muslim Brotherhood.’
ওদিকে ‘দেশমুক্তি বিপ্লব’ নামের এক কল্পিত সংগঠন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তোলার বৃথা চেষ্টা করেছে। বিশেষ তৎপর সংগঠনটির কথিত মুখপাত্র। এই ব্যক্তির নাম কর্নেল মো. শহীদ উদ্দীন খান পিএসসি (অব.)। তিনি ‘একটি সফল গণঅভ্যুত্থান’ ঘটিয়ে জনগণের ‘সংবিধান’ রচনা করে ‘প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার’ স্বপ্নে বিভোর।
এই ‘মহামানবে’র পরিচয় জানার আগ্রহ সবারই থাকতে পারে। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে বলা হচ্ছে, এই ব্যক্তি এক জন দণ্ডিত পলাতক আসামি। আয়কর ফাঁকির মামলায় তার নয় বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।
মামলার কাগজপত্রের তথ্য তুলে ধরে উক্ত জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ‘অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শহীদ উদ্দিন খান ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৭৪ লাখ ১৩ হাজার ৯৮৬ টাকার আয়ের তথ্য গোপন করে আয়কর ফাঁকির অপরাধ করেছেন।
আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে শহীদ উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে ৯ কোটি ২৫ লাখ ১২ হাজার ৬০০ টাকা আয়ের তথ্য গোপন করে আয়কর ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ আনা হয়। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শহীদ উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে ৭ কোটি ৭ লাখ ১৪ হাজার ২২১ টাকা আয়ের তথ্য গোপন করার অভিযোগ আনা হয়।
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এই মামলায় ১১ সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আসামি শহীদ উদ্দিন খান একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তার প্রকৃত আয়-ব্যয় এবং সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। তিনি আয়কর রিটার্ন দাখিলে মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রকৃত আয় ও সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তিনি আয়কর রিটার্ন দাখিল করেননি।
মামলার আরজিতে তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ অর্থবছরে আটটি ব্যাংক হিসাবে শহীদ উদ্দিন খানের ১ কোটি ৩০ লাখ ১৫ হাজার ১৩২ টাকা জমা ছিল। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আটটি ব্যাংক হিসাবে ৭৬ লাখ ২৪ হাজার ৪৬৮ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ১২টি হিসাবে ২৯ কোটি ৮৭ লাখ ৮৪ হাজার ২৬৪ টাকা এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে নয়টি ব্যাংক হিসাবে ৩৩ কোটি ২৪ লাখ ৬২ হাজার ৬৯৫ টাকা জমা ছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আটটি ব্যাংক হিসাবে জমা ছিল ৪০ কোটি ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৪৬৫ টাকা।
এর আগে অস্ত্র মামলায় অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শহীদ উদ্দিন খানসহ চার জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ঢাকার আরেকটি আদালত। মামলার কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী, ‘গত বছরের ১৭ জানুয়ারি রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত কর্নেলের বাসায় অভিযান চালিয়ে দুটি পিস্তল, ছয়টি গুলি ও দুটি শটগান উদ্ধার করা হয়। মামলায় বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সরকার ও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি ও জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।’
তাহলে বিষয়টা দাঁড়াচ্ছে কী? জামায়াত-সংশ্লিষ্ট মিডিয়া আল জাজিরা বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচারে লিপ্ত। আর সেই অপপ্রচারে ভর করে কিছু মানুষ দিবাস্বপ্নে বিভোর। পলাতক দণ্ডিতরা অন্ধকারের প্রাণীদের মতো আচরণ করবে কিন্তু আল জাজিরার আসল উদ্দেশ্য কী? ধারাবাহিক মিথ্যাচারের মাধ্যমে শুধুই অর্থ উপার্জন, নাকি অন্য কিছু?
লেখক: এম. নজরুল ইসলাম, সভাপতি, সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগ, অস্ট্রিয়া প্রবাসী লেখক-সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী