আড়াই মাস পর বিএনপি অফিস খুলল, তালা ভেঙে ৭৪ দিন পর কার্যালয়ে বিএনপি নেতা-কর্মীরা, বিএনপি অফিসে তালা দেন নিরাপত্তা কর্মী সোহাগ- ১২ জানুয়ারি এ সব শিরোনাম ছিল বিভিন্ন দৈনিকে। পত্রিকাগুলো একটি ছবি দিয়েছে এভাবে- রুহুল কবির রিজভী একটি হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কলাপসিবল গেটের তালা ভাঙছেন। টেলিভিশনেও এ চিত্র দেখা গেছে।
সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে আরেকটি খবরও ১২ জানুয়ারি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ-প্রচার হয়েছে- হাসপাতাল থেকে ৫ মাস পর বাসায় খালেদা জিয়া। প্রায় ৬ বছর আগে ২০১৮ সালের ১৬ এপ্রিল ডেইলি স্টারের একটি খবর ছিল এভাবে-“Our chairperson’s health condition has worsened further. The pain in her hands, legs and waist has increased. She needs better treatment on an emergency basis,” Ruhul Kabir Rizvi, senior joint secretary general of the party, made the call at a press conference at the party’s Nayapaltan central office.২৮ এপ্রিল (২০১৮) ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস জানায়- বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম খালেদা জিয়াকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তির দাবি জানিয়েছেন। তিনি দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতাসহ কারাগারে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখার পর এ দাবি জানান।
২০১৮ সালের ১৭ জুন কালের কণ্ঠ জানায়, খালেদা জিয়াকে সিএমএইচ-এ রেখে চিকিৎসার যে প্রস্তাব সরকার দিয়েছে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম তা প্রত্যাখান করে বলেছেন- কেবল ইউনাইটেড হাসপাতালেই খালেদা জিয়া চিকিৎসা সম্ভব এবং সেটাই করতে হবে। পরে বিভিন্ন সময়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার দাবি জানিয়ে বলা হয়- যে কোনো মুহূর্তে তাঁর স্বাস্থ্যের চরম অবনতি ঘটতে পারে এবং এ জন্য সরকার দায়ী থাকবে।
২০২৪ সালের ১১ জানুয়ারি খালেদা জিয়া ইউনাইটেড হাসপাতাল নয়, এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছেন। একটি প্রভাবশালী জাতীয় দৈনিক ১২ জানুয়ারি লিখেছে- শারীরিক কিছু জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দীর্ঘ ১৫৬ দিন চিকিৎসা গ্রহণ শেষে তিনি বাসায় ফিরেছেন। শত শত মোটর সাইকেলে হাজারো নেতা-কর্মী তাকে বাসায় পৌঁছে দেয়ার সময় সড়কে থেমে থেমে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া হয়। এ সময়ে বসুন্ধরা থেকে গুলশানের সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়।
এটা স্বস্তির খবর যে প্রায় ছয় বছর ধরে বিএনপির নেতৃত্ব খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য বিষয়ে যে শঙ্কা প্রকাশ করে আসছে, সেটা সঠিক প্রমাণিত হয়নি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যেদিন (১৫৬ দিন পর) গৃহপ্রবেশ করেন, সে দিনেই বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তালা ভাঙা হয়। একইদিনে শেখ হাসিনা ও তাঁর মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে। এ মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য অপরিহার্য শর্ত ছিল ৭ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা। আর বিএনপি এবং তাদের ডান-বামের মিত্ররা চেয়েছে এ নির্বাচন যেন কোনোভাবেই সম্পন্ন হতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করা। সেজন্য তারা চার ধরণের কর্মসূচি নিয়েছিল- হরতাল, অবরোধ, অসহযোগ ও গণকারফিউ জারি। বাংলাদেশে একসঙ্গে এ ধরনের সর্বাত্মক আন্দোলনের কর্মসূচি অতীতে দেখা যায়নি। স্পষ্টতই বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচি ব্যর্থ হওয়ায় শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করতে পেরেছেন। কেউ প্রশ্ন করতেই পারে- শেখ হাসিনার সরকার শপথ গ্রহণ করার কারণেই কি খালেদা জিয়ার নিজগৃহে ফিরে যাওয়া এবং বিএনপির নিজেদের অফিসে প্রবেশের পথ খুলে গেল?
২৮ অক্টোবর বিএনপি ও তাদের মিত্ররা শেখ হাসিনার সরকারকে শক্তিপ্রয়োগে উৎখাতের অভিলাষ নিয়েই পল্টন-নয়াপল্টন ও আশপাশের এলাকায় সমবেত হয়েছিল। সে দিনের সমাবেশ শুরু হতে না হতেই সহিংসতা শুরু হয়। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম পরদিন ২৯ অক্টোবর সর্বাত্মক হরতালের ডাক দেন। কিছুক্ষণ পর বিএনপির তরুণ নেতা ইশরাক হোসেন ও সাবেক সেনা অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল হাসান সোহরাওয়ার্দী বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করেন Mian Zahidul Islam Arefy নামের এক ব্যক্তিকে নিয়ে, যিনি নিজের পরিচয় দেন adviser to US President Joe Biden হিসেবে। টিভিতে এ খবর দেখে বিএনপির সমর্থক-কর্মী-নেতাদের সে কী উৎসাহ-উল্লাস- এই বুঝি পাকা আপেল-আমের মতো রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে এসে গেল!
এরপর কত ইতিহাস- কত হরতাল, অবরোধ-অসহযোগ শেষে গণকারফিউ। গায়েবী ঘোষণায় একের পর এক কর্মসূচি প্রচার করতে থাকেন রুহুল কবির রিজভী। অতীতে আমরা কমিউনিস্ট নেতাদের ডিপ আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকার কথা শুনেছি। বিএনপির এই নেতা কখনো ডিপ আন্ডারগ্রাউন্ডে, কখনো বা ঝটিকা মিছিলে, কখনো বা লিফলেট হাতে রাজপথে।
পুলিশ-র্যাব তাকে খুঁজে ফিরছে গ্রেফতারের জন্য। তাঁর নামে শত মামলা। কিন্তু ১১ জানুয়ারি সকালে তিনি যখন প্রবল বিক্রমে হাতুড়ি দিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিসের তালা ভেঙে ‘প্রিয় কার্যালয়ে’ প্রবেশ করেন এবং কয়েক ঘণ্টা পর কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কয়েকজন নেতা সেখানে সংবাদ সম্মেলন করেন, তখন তাদের গ্রেফতারে পুলিশ তৎপর হলো না কেন? খালেদা জিয়াকে বাসায় পৌঁছে দিতে গিয়ে মোটর সাইকেল ও কার নিয়ে যারা রাজপথ দাপিয়ে বেড়াল, তাদের মধ্যেও নিশ্চয়ই মামলার আসামী ছিল। তাদের কাউকেই গ্রেফতারের কোনো আয়োজন দেখা গেল না। তাহলে কি আওয়ামী লীগের শীর্ষ মহল ধরে নিয়েছে- পরাজিত প্রতিপক্ষের ওপর নতুন করে বলপ্রয়োগ অপ্রয়োজনীয়?
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ধুলার আস্তর জমেছিল। পুলিশ এতদিন বলছিল- তারা বিএনপির অফিসে তালা দেয়নি। বিএনপির অফিসের নিরাপত্তাকর্মীই তালা দিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় অফিস খোলার দিনেই কাছাকাছি অবস্থিত উত্তর ও দক্ষিণ নগর কমিটির অফিসও খুলে যায় আড়াই মাস পর। সেখানে কে তালা দিয়েছিল?
সর্বত্রই নেতা-কর্মীদের সরব উপস্থিতি, যেখান থেকে স্লোগান উঠেছে থেমে থেমে- রাজপথ ছাড়ি নাই, খালেদা জিয়া ভয় নাই। খালেদা জিয়া এবং তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের গৃহপ্রবেশ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছে। যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির করার চেষ্টা না করে তাহলে তারা স্বস্তিদায়ক পরিবেশে থাকতে পারবে, এটা ধরে নিতে পারি। এ সময়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরা ভেবে দেখতে পারেন- কোথায় ভুল হয়েছিল। কোথায় গলদ ছিল? কেন হরতাল-অবরোধ-অসহযোগ-গণকারফিউ ব্যর্থ হলো?
যারা বাংলাদেশের জনগণের ওপর ভরসা না রেখে, কল্পজগতে বিচরণ করে অপরিণামদর্শী আচরণ করেছে, তাদের কি নেতৃত্বে রাখা উচিত? চার দশকেরও বেশি আগে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির যাত্রালগ্নে তাদের গঠনতন্ত্রে একটি ধারা ছিল- দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত কাউকে দলের নেতৃত্বের কোনো পদে রাখা যাবে না এবং তাদের জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সরকারের কোনো স্তরের নির্বাচনে দলের পক্ষ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়ন প্রদান করা হবে না। বিএনপির নেতৃত্ব যারা ইচ্ছেমতো কুক্ষিগত করে রয়েছে, তারা অতি গোপনে এই ধারা বাতিল করে দিয়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা দলকে কুক্ষিগত করে রাখা ব্যক্তিদের সরিয়ে দিতে তৎপর হবে কি?
লেখক: অজয় দাশগুপ্ত – সাংবাদিক, কলামিস্ট।