কৃষক অনেক সময় ক্ষেত থেকে শাক-সবজি বাজারজাত করার আগে ডোবা, নালা অথবা পুকুরের পানিতে পরিষ্কার করে থাকেন। এসব জলাশয়ের পানি দূষিত থাকলে এই জীবাণু শাক-সবজির মাধ্যমে বাসস্থানে চলে আসতে পারে। কসাইখানার পরিত্যক্ত মাংসে জীবাণু থাকলে ও বিড়াল সেই মাংস খেলে আক্রান্ত হবে এবং পরবর্তী সময়ে জীবাণু ছড়াতে ভূমিকা রাখবে। টক্সোপ্লাজমার সংক্রমণের ফলে মস্তিষ্কের প্রদাহ, মানসিক বিকারগ্রস্ত, অটিজম শিশুর জন্ম হতে পারে।
ব্রুসেলা মানুষ ও পশুর গর্ভপাতের জন্য দায়ী এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া, যা গবাদি পশুর (গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও শূকর) মাধ্যমে মানুষে সংক্রমণ ঘটায়। আক্রান্ত প্রাণীর সরাসরি সংস্পর্শ, দূষিত বায়ু শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এবং মাংস খেলে এই ব্যাকটেরিয়া মানুষে সংক্রমিত হতে পারে। এ ছাড়া আক্রান্ত প্রাণীর যেকোনো নিঃসরণ; যেমন—দুধ, লালা, মলমূত্র এবং দূষিত খাদ্য ও পানির মাধ্যমে মানুষ ও অন্য প্রাণী আক্রান্ত হতে পারে।
অন্যদিকে লেপ্টোস্পাইরা নামক ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত প্রাণীর মূত্রের (প্রস্রাব) মাধ্যমে বের হয়ে পরিবেশ দূষিত করে। প্রাণী ও মানুষের সংক্রমণ সরাসরি ত্বকের সংস্পর্শে অথবা চোখ, নাক ও মুখের শ্লেষ্মার মাধ্যমে এবং পরোক্ষভাবে সংক্রমিত প্রাণীর মূত্র দ্বারা দূষিত মাটি, খাবার বা পানির মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। গবাদি পশুর সঙ্গে কাজ করার সময় প্রস্রাবের সংস্পর্শে এসে মানুষ সহজেই আক্রান্ত হতে পারে।
এ ছাড়া লিস্টারিয়া ও ক্যামফাইলোব্যাক্টার জীবাণু দ্বারাও গর্ভপাত হয়। গবাদি পশুর মলের সঙ্গে এসব ব্যাকটেরিয়া বেরিয়ে এসে খাদ্য ও পানিকে দূষিত করতে পারে। দূষিত মাংস, শাক-সবজি এবং দুধ বা দুগ্ধজাত দ্রব্য গ্রহণে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। মুরগির বিষ্ঠায় ক্যামফাইলোব্যাক্টার থাকে, যা থেকে মানুষ সহজেই আক্রান্ত হতে পারে।
গৃহপালিত বা পোষা ও বন্য পাখি, বিশেষ করে টিয়া, কবুতর, হাঁস জাতীয় পাখি থেকে ক্লামাইডিয়া নামক ব্যাকটেরিয়া পাখি ও মানুষে গর্ভপাত ঘটাতে পারে। ছত্রাকের মধ্যে অ্যাসপাজিলাস দ্বারা মানুষ ও পশুতে গর্ভপাত হতে পারে।
মানুষ ও পশুপাখির গর্ভপাত হলে তার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করে চিকিৎসা প্রদান খুবই গুরুত্বপর্ণ। গর্ভপাতকৃত ভ্রূণ, গর্ভফুল, শ্লেষ্মা, রক্ত ও মলমূত্র পরীক্ষা করে এসব জীবাণুর অনুসন্ধান জরুরি। পশুপাখি থেকে এসব জীবাণু সংক্রমিত হয়েছে কি না, তা জানাও জরুরি। এ ক্ষেত্রে আক্রান্ত মহিলার নমুনা সংগ্রহের পাশাপাশি তাদের গবাদি পশুর নমুনা সংগ্রহ করে সংক্রমণের পথ বা চক্র খুঁজে বের করা দরকার। তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে এসব গর্ভপাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
পশুপাখির খামার বা ফার্মের মধ্যে কুকুর, বিড়াল প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। দুধ দোহনের আগে ও পরে ওলান ও ফার্মের যন্ত্রপাতি পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। ফার্মের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো রাখতে হবে। মৃত ভ্রূণ ও গর্ভফুলকে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। আক্রান্ত ষাঁড়কে প্রজননকাজে ব্যবহার করা যাবে না। কসাইখানার পরিত্যক্ত মাংস যত্রতত্র না ফেলে সঠিক স্থানে ফেলতে হবে, যাতে কুকুর ও বিড়াল এসব মাংস খেতে না পারে।
গর্ভপাতের ফলে বেরিয়ে আসা ভ্রূণ ও গর্ভফুল এবং নিঃসরণ খালি হাতে স্পর্শ করা যাবে না। পোষা পাখি, বিড়াল ও কুকুরকে সাবধানে রাখতে হবে এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা (পায়খানা ও রক্ত), কৃমিনাশক ও টিকা প্রদান করতে হবে। কাঁচা মাংস, শাক-সবজি পরিষ্কার করার সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে মুখে না যায়। তবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে হাতে গ্লাভস ও মুখে মাস্ক পরে কাজ করা সবচেয়ে ভালো। মাংস ও দুধ ভালোভাবে সিদ্ধ করে খাওয়া আবশ্যক।
ভেটেরিনারিয়ান, কৃষক এবং কসাইখানার কর্মীরা সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকেন। কারণ তাঁরা সংক্রমিত প্রাণী এবং গর্ভপাত করা ভ্রূণ বা গর্ভফুলের সংস্পর্শে থাকেন। তাই ভেটেরিনারিয়ান ও চিকিৎসকদের অ্যাপ্রন, গ্লাভস এবং যথাযথ সতর্কতা নিয়ে এসব প্রাণী ও মানুষের চিকিৎসা করতে হবে। গবেষকদের নমুনা সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ কাজে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় টিকা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ জরুরি।
লেখক : ড. মো. সহিদুজ্জামান – গবেষক ও অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।