সন্ধ্যার পর কাজের মেয়ে চা নুডলস পাকৌড়া বানিয়ে ডাইনিং টেবিলে ডাকে সৈয়দ মাহবুবুর রহমানকে। রহমান সাহেব নাশতা নেয়ার মধ্য পর্যায়ে ছিলেন। হঠাৎ বড় মেয়ের চিৎকারে তার হাত থেকে চায়ের কাপ মেঝের উপর ছিটকে পড়ল। কাজের মেয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘খালু ও খালু আফারে বাঁচান। উনি আফারে শ্যাষ কইরা ফালাইতাছে। আফারে মাইরা ফালাইবো…….’!!
রহমান সাহেব দেখলেন, পিশাচ লোকটা তার মেয়েকে প্রায় বিবস্ত্র করে কোমরের বেল্ট দিয়ে পেটাচ্ছে। পেটাতে পেটাতে বেডরুম থেকে ড্রয়িংরুমে এনে ফেলেছে। কাজের মেয়ে দৌড়ে একটা ওড়না নিয়ে ঢেকে দেয় মেয়েটির শরীর।
এতক্ষণ যে বর্ণনা দিয়েছি, যে হতভাগ্য পিতার কথা বলেছি তিনি এককালের গ্ল্যামারগার্ল মডেল অভিনেত্রী সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নির বাবা। তিন্নিকে প্রহার করে পৈশাচিকতা প্রদর্শন করা ব্যক্তিটি ছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা ও জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ গোলাম ফারুক অভি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অভি-নীরু এক কলঙ্কিত অধ্যায়ের নাম। নীরু ছাত্রদলের শীর্ষ নেতা ছিলেন। অস্ত্রবাজিতে সুদক্ষ অভি ছিলেন মূলত ক্যাডার নেতা। এরশাদবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ছাত্রদল প্রকাশ্যে থাকলেও অভি-নীরু গোপনে এরশাদের সঙ্গে আঁতাত করেন।
এরমধ্যে ১৯৮৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হল থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন অভি। এতে তার ভাগ্য খুলে যায়। জেলে এরশাদের লোকজন তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরশাদের পক্ষে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন অভি-নীরু। ১৯৯০-এর ২৭ নভেম্বর এরশাদের পক্ষে অস্ত্রবাজি করেন অভি। সেই সংঘর্ষে ডা. মিলন নিহত হন।
বিশেষ সূত্রমতে, অভি নীরুকে এরশাদ সরকার এক কোটি টাকা করে দিয়েছিল। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অভি-নীরুর বিশ্বাসঘাতকতার জন্য এতই ক্ষুব্ধ ছিলেন যে তাদের নামও শুনতে চাইতেন না।
একদিন একটি পাঁচতারকা হোটেলের পার্টিতে এসে তিন্নির সঙ্গে পরিচয় হয় গোলাম ফারুক অভির। অভির প্রেমে পড়ে যান তিন্নি। তখন অভি থাকতেন নিউ ইস্কাটনের প্রোপার্টি এনক্লেভের একটি ফ্ল্যাটে। সেখানে নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন তিন্নি। অভির সঙ্গে কয়েকবার বিদেশেও যান। নতুন সম্পর্ক নিয়ে স্বামী শাফকাত হোসেন পিয়ালের সঙ্গে বিরোধ বাধে তিন্নির।
ওদিকে তিন্নিও একটা ক্ষমতাধর সিঁড়ি পেয়ে গেলেন। তার চোখে ছিল তুমুল যশ খ্যাতি পাবার বেপরোয়া স্বপ্ন। অভির সাথে তিন্নির উদ্দাম মেলামেশার কারণে পিয়ালের সাথে তিন্নির দাম্পত্য সম্পর্কের অবনতি ঘটতে শুরু করে। ২০০২ সালের ৬ নভেম্বর অভি নিজে তিন্নি ও পিয়ালের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটান। এমনকি তিন্নির দেড় বছরের শিশুকন্যা আনুশকাকে পিয়ালের হেফাজতে দিয়ে পিয়ালকে বাসা থেকে বের করে দেন অভি। স্থায়ীভাবে ওই বাসায়ই অবস্থান নেন নারীলিপ্সুক অভি।
বিরতিহীনভাবে গোলাম ফারুক অভি নামক দানবের পাশবিক লালসা মিটিয়েও নিস্তার পায়নি তিন্নি। সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত অভি গোপনে তিন্নির সঙ্গে অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক নিয়েই আগ্রহী ছিলেন। তিন্নিকে বিয়ে করে সামাজিকভাবে স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়ার ইচ্ছা তার ছিল না। অভির জীবন ছিল বেপরোয়া। বহু অভিনেত্রী, মডেল ও চিত্রনায়িকা তার লালসার শিকার হয়েছে। একবার ব্যক্তিগত ছবি ফাঁস করার অভিযোগে এক অভিনেত্রী অভির মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। নারীলিপ্সুক অভির সর্বশেষ শিকার ছিলেন মডেল তিন্নি।
বিয়ের জন্য তিন্নি অভির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। কিন্তু অভি বিয়েতে অস্বীকৃতি জানান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তিন্নি হুমকি দেন, সবকিছু ফাঁস করে দেবেন। ঠিক ওই মুহূর্তে তিন্নিকে খুন করার পরিকল্পনা করেন অভি। ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর তিন্নিকে মাথায় উপুর্যুপরি আঘাত করে খুন করেন অভি। লাশ গুম করার জন্য গাড়িতে করে নিয়ে কেরানীগঞ্জের বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর (বুড়িগঙ্গা সেতু) নিচে। সেতুর ১১ নম্বর পিলারের ফাউন্ডেশনের উপরে পাওয়া যায় তিন্নির মরদেহ। শরীরের বিভিন্ন অংশে ছিল থেঁতলানো জখম। মাথার খুলিতে ভোঁতা অস্ত্রের আঘাত। চেনাই যায়নি এই নিথর দেহটি শোবিজের মোস্ট গ্ল্যামারাস মডেল ও অভিনেত্রী সৈয়দা তানিয়া মাহবুব ওরফে তিন্নির। কী মর্মান্তিক!!
লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ চিনতে পারেনি এটা মডেল তিন্নি। বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে চার দিন লাশঘরে পড়েছিল তিন্নির মরদেহ। পত্রিকায় ছবি ছাপা হলে তিন্নির আত্মীয়স্বজন শনাক্ত করেন মরদেহটি তিন্নির। তার আগেই ময়নাতদন্ত শেষে দাবিদার না থাকায় বেওয়ারিশ হিসেবে লাশটি আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম কর্তৃক জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। পরিবার এসে লাশ দাবি করার কারণে কবর থেকে লাশ উত্তোলন করা হয়।
অভির বিরুদ্ধে মামলা হলেও লাভ হয়নি। তিনি কানাডার টরেন্টোতে পালিয়ে আছেন। অভিনেত্রী তমালিকা কর্মকার, অভিনেতা শাহরিয়ার নাজিম জয় ও নাট্যকার এজাজ খান এই মামলার সাক্ষী ছিলেন। আরেক সাক্ষী ছিলেন শীর্ষসন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন।
লেখক : মিলি সুলতানা – প্রবাসী সাংবাদিক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট