বিএনপি জামায়াত এবং সমমনাদের সবকিছুতেই ইস্যু খোঁজা বা নেতিবাচক দিক মনোভাব প্রকাশ করা নতুন কোনো বিষয় নয়। জন্মগতভাবেই তারা কিছু ভালো লাগে না রোগে আক্রান্ত। চীনে যখন করোনা বিস্তার হয়েছিল তখন বলা হয়েছে, দেশে করোনা আছে কিন্তু মুজিব বর্ষ পালনের জন্য এ তথ্য লুকানো হচ্ছে। করোনা রোগী পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে যখন মুজিব বর্ষের অনুষ্ঠান বন্ধ করা হলো, তখন বলা হয়েছে, দেশে করোনা নাই, মোল্লারা মোদি বিরোধী কর্মসূচি ঘোষণা করায় সরকার করোনা নাটক করছে। এমন যাদের মানসিকতা তাদের কাছ থেকে কি আশা করতে পারেন?
করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় শেখ হাসিনা সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছেন, বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় থেকে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাতেগোনা যে কয়েকটি দেশে করোনার কারণে অর্থনৈতিক ধ্বস নামে নি তার একটি বাংলাদেশ। শেখ হাসিনা ৩১ দফা কর্মসূচি দিয়ে প্রণোদনা ও আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। তারপরও সাধুবাদ জানানোর মত কোনো বিবেকসম্পন্ন মানুষের সন্ধান আমরা পাই নি।
ভ্যাকসিন আসার আগে টকশোতে শাখাওয়াত সায়ন্তনীরা সমালোচনা করেছে – সরকার ভ্যাকসিন পাওয়ার কোনো চেষ্টাই করছে না, কবে ভ্যাকসিন আসবে সরকার তার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। ভ্যাকসিন এলেও শুধু আওয়ামী লীগের লোকজনই পাবে।
ভ্যাকসিন আসার পর শুরু হলো নতুন অপপ্রচার। প্রথম ট্রায়ালে থাকা ভারতের বায়োটেকের টিকা নিয়ে প্রচারিত সংবাদগুলোকে এস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের প্রভাব বলে অপপ্রচার করা হলো। কেউ টিকার মধ্যে মাইক্রোচিপ আবিষ্কার করেছে, কেউ বলছে ভ্যাকসিন দিয়ে চেহারা পেঁচার মতো হয়ে যাচ্ছে, কেউ বলছে ভ্যাকসিন দিলে পুরুষাঙ্গ ছোট হয়ে যাবে। অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে জবাব দেয়ার মতো সমালোচনাও তারা করছে না। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও রোহিঙ্গারা যাদের সমর্থক, যারা সাঈদীর জাল জঈফ হাদিস ও মনগড়া ওয়াজ শুনে তাকে চাঁদে দেখে, ইসলাম সম্পর্কে যথাযথ এলেম না থাকা আজহারীর টেলি সামাদ মার্কা বাংলিশ শুনে ভালো আলেম হিসেবে গণ্য করে, তাদের বুদ্ধি থাকে হাঁটুতে। তাদের জন্য কিছু বলার নেই। তবে সচেতন জনগণের জন্য কিছু বিষয়ে বলতে চাই।
১. এ ভ্যাকসিন কি ভারতের?
কোভিশিল্ড যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আবিস্কৃত করোনা ভ্যাকসিন। এটি গবেষণায় অর্থায়ন করেছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এ্যাস্ট্রোজেনেকা। এই টিকা উৎপাদনের জন্য নির্ধারিত সক্ষমতা প্রয়োজন এবং উৎপাদনের জন্য এ্যাস্ট্রোজেনেকার সঙ্গে এই মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয় ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট।
২. দাম এত কম কেন?
একটি শ্রেণী এই টিকার দাম কম কেন তা নিয়েও দ্বিধায় ভোগেন।
কোভিড-১৯ এর যতগুলো টিকা উৎপাদন হচ্ছে অর্থাৎ চীনের সিনোভ্যাক্স, ফাইজার বা মডার্নার টিকার তুলনায় এটির দাম সবচেয়ে কম। কিন্তু কার্যকারিতা একই। দাম কম হওয়ার কারণ অন্যান্য টিকার মত এর কোনো রয়ালটি ধরা হয় নি। অক্সফোর্ড তাদের আবিষ্কারকে মানবসেবা হিসেবে উৎসর্গ করেছে।
৩. দাম ১ ডলার বেশি কেন?
সেরাম ইনস্টিটিউট ভারতীয় প্রতিষ্ঠান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে অনুমোদন পাওয়ার আগে ভারতীয়দের উপর এর প্রথম ও দ্বিতীয় ট্রায়াল করা হয়েছে যার আর্থিক মূল্য কম নয়। সুতরাং তাদের সরকার তুলনামূলকভাবে কম দামে পাবে এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া তাদের জনসংখ্যা আমাদের তুলনায় অনেক বেশি। বাজার বড় হলে দামে প্রভাব পড়াই অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। তবে সেরাম থেকে যতগুলো দেশে ভ্যাকসিন যাবে তার মধ্যে আমরাই সবচেয়ে কম দামে ক্রয় করছি। সৌদি আরব ক্রয় করছে সোয়া পাঁচ ডলারে। প্রাইভেট এগ্রিমেন্টে সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকার মূল্য ৮ থেকে ১৩ ডলার। প্রথম আলো এ্যাস্ট্রোজেনেকার মূল্যকে সেরাম ইনস্টিটিউটের মূল্য হিসেবে দেখিয়ে, তথ্য বিকৃত করে এবং চাহিদা ও যোগান বিবেচনা না করে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল তা অত্যন্ত নিন্দনীয়।
৪. শেখ হাসিনার কূটনৈতিক সাফল্য:
বাংলাদেশ দৃশ্যত অপ্রত্যাশিতভাবে ভ্যাকসিন পেয়েছে। কিন্তু এর নেপথ্যে ছিল শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত তৎপরতা। এটি জননেত্রীর অসামান্য কূটনৈতিক সাফল্য। ভারত বা উন্নত কয়েকটি দেশের কথা বাদ দিলে বাংলাদেশ ছাড়া অন্য একটি দেশের দৃষ্টান্ত খুঁজে পাবেন না যারা করোনা ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য এত আন্তরিকতার সাথে চেষ্টা করেছে।
৫. চীনের সিনোভ্যাক্স:
আমরা প্রথমে চীনের তৈরি সিনোভ্যাক্স আনতে চেয়েছিলাম। এর মূল্য ৩০ ডলার নির্ধারণ হলেও আমাদের জন্য বিনামূল্যে দেয়ার চুক্তি হয়েছিল। তবে শর্ত ছিল প্রাথমিক ট্রায়ালে অংশগ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ অনুমোদনের আগেই জনগণের উপর পরীক্ষা করা হতো। পরবর্তীতে চীন অর্থ দাবি করে, উপরন্তু প্রথম ট্রায়ালের শর্তও রাখে। পিনাকির মতো যারা এ নিয়ে অপপ্রচার ও মিথ্যাচার করেন তাদেরকে বলবো দেশের মিডিয়াকে বিশ্বাস না করলে রয়টার্সের প্রকাশিত সংবাদগুলো অন্তত পড়ুন।
৬. কেন বেক্সিমকো?
বেক্সিমকো সেরাম ইনস্টিটিউটের বাংলাদেশ প্রতিনিধি। বাংলাদেশের ঔষধ শিল্প গড়ে উঠেছে এভাবেই। ফাইজার বা মডার্নার টিকা আনলেও কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আনতে হতো। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান আছে এমন কেউ সরকারকে সরাসরি আনার কথা বলবে না। এক সময় বিদেশি সকল সাহায্য সরকারের মাধ্যমে দেয়া হতো। পরবর্তীতে এনজিওর মাধ্যমে দেয়া শুরু হয় কারণ সরকারের তুলনায় বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেয়া হলে তুলনামূলকভাবে খরচ কম হয়। সরকার টিকা আনতে হলে আমদানি থেকে শুরু করে বাজার ব্যবস্থাপনা ও সরবরাহের জন্য জনবল নিয়োগ দিতে হতো। প্রশাসনের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হতো। কেউ কেউ দুর্নীতির আশ্রয় নিতো না, এমন হলফ করে বলা সম্ভব নয়। অর্থাৎ সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে বেক্সিমকোর মাধ্যমে আমদানি ও সরবরাহ করার বহু টাকার সাশ্রয় হয়েছে। অযাচিত অনেক বিতর্কের পথও বন্ধ হয়েছে।
৭. পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গ:
একটি টিকা থার্ড ফেইজে থাকা মানে তার কার্যকারিতা আছে এবং এতে মৃত্যু বা বিরূপ কোনো প্রতিক্রিয়া হবে না। অতএব কোভিশিল্ড নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। কিন্তু যেহেতু এটি ঔষধ তাই সতর্ক বার্তা থাকাই স্বাভাবিক। সাধারণ একটি প্যারাসিটামল ঔষধেও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কথা লেখা থাকে। টিকার ক্ষেত্রে অন্য প্রভাব পড়বে কিনা তা বোঝার কোনো উপায় নেই। পৃথিবীর সব টিকাই এভাবে আবিষ্কার হয়েছে। এমন বাস্তবতা মেনে নিতে না নিলে তার সকল ঔষধ বর্জন করা উচিত।
পরিশেষে বলতে চাই, সবকিছুতেই সমালোচনা বা সবকিছুর নেতিবাচক দিক খোঁজাকে দেশপ্রেম হিসেবে গণ্য করার সুযোগ নেই। আমরা ভ্যাকসিনের সমালোচনা ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করতাম যদি তা যুক্তিযুক্ত হতো এবং আপনারা আপনাদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের মিনিমাম সমালোচনা করতেন। আসলে কিছু ভালো লাগে না রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সমালোচনা করার মতো কিছু না পেলেও বলবে, এত ভালো ভালো না।
লেখক: ইবার্তা সম্পাদনা পর্ষদ