তৌফিক মারুফ
নারীশিক্ষার প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমেই বেশি ইতিবাচক হচ্ছে। সামাজিকভাবে বিয়ে করানোর ক্ষেত্রে অভিভাবকদের কাছে শিক্ষিত মেয়েরা প্রাধান্য পাচ্ছে। অশিক্ষিত বা কম লেখাপড়া জানা অনেক ছেলেও নিজের চেয়ে বেশি শিক্ষিত মেয়েদের স্ত্রী হিসেবে পেতে এখন বেশি আগ্রহী। ‘বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা জরিপ ২০১৬’-এর ফলাফলের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এমনই অভিমত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারি এই জরিপে বিবাহিত নারীদের মধ্যে শিক্ষার হার ১৬ বছরের ব্যবধানে তিন গুণ এবং ছয় বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ হওয়ার প্রমাণ উঠে এসেছে। সরকারের জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট) উদ্যোগে মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে জরিপটি চালানো হয়।
ঢাকায় নিম্ন আয়ের পেশায় জীবন চলে এমন কিছু ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জরিপের ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া যায়। ‘মোর দুইটাই মাইয়া সন্তান, দুইটারেই নেখাপড়া করবার চাও, নেখাপড়া না করিবো তো আগত ভালো কোনো বেটা ছাওয়াল বিয়া করিবো না।’ রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোডের ফ্লাইওভারের নিচে রিকশার ওপর বিশ্রামরত অবস্থায় কালের কণ্ঠকে বলছিলেন চালক মোন্তাজ আলী। কঠোর জীবনসংগ্রামের মধ্যেও নিজের দুই কন্যাসন্তানকে শিক্ষিত করার স্বপ্ন মনে পোষণ করেন।
নীলফামারী জেলার জলঢাকা এলাকার মানুষ মোন্তাজ। তাঁর পাশের আরেক রিকশায় বসেছিলেন ওই জেলা থেকে আরেক রিকশাচালক রবিউল। তিনি বলেন, ‘মোর এলাকাত যে অশিক্ষিত মাইয়া ছাওয়াল বিয়া হইছে, হেরা কেউ ভালো নাইগ্যা; গরিব হইবার নাগছে। একেকজনের বেশি বেশি ছাওয়াল-পাওয়াল হইবার নাগছে, খালি অসুখে ভুগবার থাকিল আর মরণ লাগিল।’ পড়ালেখার গুরুত্ব পরে উপলব্ধি করতে পেরেছেন উল্লেখ করে রবিউল বলেন, ‘মুই নিজে তো পড়ানেখা করবার পারিনু, কিন্তু মোর একটা মাইয়াক শিক্ষিত করিবার নাগি এই ঢাকাত রিকশা চালাবার নাগছি। মুইও শিক্ষিত করিবো। শিক্ষা না জানিবো তো বিয়ার পর জামাইগুলা মাইয়া ছাওয়ালগোরে ঘর ছাড়ান করিবো।’
গত বুধবার প্রকাশিত নিপোর্টের জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ১৫-৪৯ বছর বয়সের বিবাহিত নারীদের মধ্যে পুরোপুরি অশিক্ষিতের হার ২০০১ সালের ৪৭ শতাংশ থেকে ২০১০ সালে ৩৪ শতাংশে নেমে আসে এবং ২০১৬ সালে তা ছিল মাত্র ২১ শতাংশে। একই বয়সের নারীদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত নারীদের হারও দেখা গেছে ক্রমবর্ধমান। এই হার ২০০১ সালে ছিল ২৮ শতাংশ, ২০১০ সালে ৩০ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ৩২ শতাংশ। বাড়ছে ন্যূনতম মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় শিক্ষিত নারীদের হারও। ১৫-৪৯ বছর বয়সের বিবাহিত নারীদের মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রাপ্ত নারীদের হার ২০০১ সালে ছিল ২৫ শতাংশ। ২০১০ সালে তা উঠে আসে ৩৬ শতাংশে এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালে হারটি আরো ওপরে উঠে দাঁড়ায় ৪৭ শতাংশে।
এই জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০১ সালে একেবারেই অশিক্ষিত বিবাহিত নারীর যে হার ছিল ২০১৬ সালে এসে তা ২৬ শতাংশ কমেছে। এর মধ্যে গত ছয় বছরে হারটি হ্রাস পেয়েছে আগের ১০ বছরের সমান (১৩ শতাংশ)। একইভাবে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের মধ্যে ন্যূনতম মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় শিক্ষিতের যে হার ছিল তা গত ১৬ বছরে বেড়েছে ২২ শতাংশ। এর মধ্যে প্রথম ১০ বছর ধরে ১১ শতাংশ বাড়লেও পরে মাত্র ছয় বছরে আরো ১১ শতাংশ বেড়েছে। এদিকে শুধু প্রাথমিক পর্যায়ের হার ১৬ বছরে মাত্র ৪ শতাংশ বেড়েছে। এখানেও হার প্রথম ১০ বছরে বাড়ে ২ শতাংশ এবং বাকি ২ শতাংশ বেড়েছে শেষের মাত্র ছয় বছরে।
জরিপের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘গণসাক্ষরতা অভিযান’-এর কর্ণধার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, এই অগ্রগতিকে শুধু স্বাস্থ্যের জায়গা থেকে দেখলেই হবে না, এটা দেশে নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে বড় অর্জনের প্রতিফলন। সেই সঙ্গে নারী-পুরুষের সম্মিলিত সচেতনতা বোধেরও বহিঃপ্রকাশ। ছেলেরা বুঝতে পারছে স্ত্রী শিক্ষিত না হলে সংসারজীবনে নানা সমস্যায় পড়তে হবে। এ ছাড়া নিম্ন আয়ের অশিক্ষিত পর্যায়ের ব্যক্তিটিও এখন চায় তার সন্তানটি শিক্ষার ছোঁয়া পাক। আর্থিক সমস্যা থাকলেও তাদের মধ্যে সন্তানকে শিক্ষিত করার চাহিদা বলিষ্ঠভাবেই তৈরি হয়েছে। সন্তানকে শিক্ষিত করার চাহিদা কিন্তু পুরুষ বা বাবাদের মধ্যেও প্রবল। এই ধারাবাহিকতায় এখন ছেলেরা বিয়ের জন্য যতটা সম্ভব শিক্ষিত মেয়েকে বেছে নিতে চায় বলে মনে করছেন রাশেদা চৌধুরী।
মোহাম্মদপুর বসিলা এলাকার তরুণ আসাদুলের পড়াশোনা ক্লাস সেভেন পর্যন্ত। এবার শীতে বিয়ের প্রস্তুতি আছে তার। পেশায় গার্মেন্টকর্মী। প্রসঙ্গটি তুললে আসাদ বলেন, ‘আগে আমার গ্রামের বাড়ির প্রতিবেশী একটা মেয়ের সঙ্গে আমার ভালোবাসা ছিল। কিন্তু মেয়েটি মোটেই পড়াশোনা করেনি। তাই আমার পরিবার ওই মেয়েকে মেনে নিতে রাজি হয়নি। আমিও পড়ে পিছপা দিলাম। আমিও চাই আমার বউ কমবেশি পড়াশোনা করা হবে। নইলে এখন কোথাও কোনো কাজকর্ম পাইবে না, মানুষের বাসায় ঝিয়ের কাজ করতে গেলেও তো এখন পড়াশোনার কথা জানতে চায়। এ ছাড়া ভবিষ্যতে সন্তানের ভাগ্যও ভালো হয় না।’
জরিপটি স্বাস্থ্য খাতকেন্দ্রিক হলেও এর ভেতরে বিশেষজ্ঞরা বিষয়টিকে সরকারের তরফ থেকে নারীর শিক্ষা ও ক্ষমতায়নে ব্যাপক অগ্রগতি এবং বাল্যবিয়েবিরোধী পদক্ষেপের বড় সুফল বলে মূল্যায়ন করছেন। তাঁরা আরো বলছেন, শিক্ষিত নারীরা নিজেদের ও সন্তানের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকেন, ফলে কম বয়সে বিয়ে, কম বয়সে সন্তান ধারণের বিপদ সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে পারেন। আর শিক্ষিত মায়ের সন্তানরাও সহজে শিক্ষার আলোতে আলোকিত হতে পারে।
দেশের শিক্ষা খাতের সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক রাশেদা কে চৌধুরী মনে করেন, আজকের এ অবস্থায় আসার পেছনে অবশ্যই দীর্ঘ সময়ের নানা পদক্ষেপের ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে সরকারের তরফ থেকে ধাপে ধাপে নারীশিক্ষাকে অবৈতনিক করা, বৃত্তির প্রবর্তন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রসার, নিরাপত্তা নিশ্চিত, উৎসাহ ও সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি গ্রহণ, সরকারপ্রধানের আন্তরিকতামূলক নানা উদ্যোগ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নীতিমালা প্রণয়ন, বেসরকারি পর্যায়ের কার্যক্রম, কুসংস্কার দূর করাসহ আরো অনেক বিষয়ের ইতিবাচক প্রভাব হিসেবেই দেখতে হবে। তিনি বলেন, ‘এত কিছুর মধ্য দিয়ে একটি মেয়ে যখন শিক্ষার আলো পাবে তখন স্বাভাবিকভাবেই তার একটি ভালো ছেলের সঙ্গে বিয়ের সম্ভাবনা থাকবে, নিজের পায়ে নিজে দাঁড়ানোর সক্ষমতা তৈরি হবে, আত্মমর্যাদা বোধ নিয়ে নিজের জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখতে পারবে এবং সর্বোপরি নিজের ও সন্তানের স্বাস্থ্য সুস্থ রাখতে পারবে; বেঁচে থাকতে পারবে নিরাপদে।’
বাংলাদেশ অবস অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্ট সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা সমীক্ষার মাধ্যমেই দেখতে পেয়েছি শিক্ষিত মেয়েদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা ভালো। তারা সময়মতো নিজের স্বাস্থ্যগত সমস্যা অনেকাংশে বুঝতে পারে। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য-পরামর্শ সহজে পড়তে পারে। প্রয়োজনমতো চিকিৎসকের কাছে এসে নিজের সমস্যাটুকু ভালোভাবে বোঝাতেও পারে। বিশেষ করে প্রসূতি স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে শিক্ষার অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষিত নারীরা নিয়মিত চেকআপ করাতে আসে, কম বয়সে সন্তান নিতেও তাদের মধ্যে অনীহা থাকে। এমনকি শিক্ষিত নারীরা পরিবারের অন্যদেরও যেকোনো সমস্যার বিষয়ে বোঝাতে পারে। সব মিলিয়ে শিক্ষিতদের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকিও কম থাকে।’
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মা ও শিশু স্বাস্থ্য) ডা. মোহাম্মদ শরীফ বলেন, ‘আমরা পর্যবেক্ষণ থেকে দেখছি—শিক্ষিত মেয়েরাই আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে বেশি আসে। অন্যদিকে অল্প বয়সে বা শিশুকালে মা হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায় অশিক্ষিতদের মধ্যে। তারাই বেশি নানা সমস্যার শিকার হয়। এসব দেখে দেখে এখন মেয়েরা নিজেরাই বিয়ের আগে নিজেকে শিক্ষিত করার তাগিদ অনুভব করছে।’
দীর্ঘদিন ধরে জেন্ডার ইস্যু নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা স্টেপ টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক রঞ্জন কর্মকার বলেন, এখন সব পর্যায়ের মেয়েদের মধ্যেই শিক্ষার গুরুত্ব বাড়ছে এবং শিক্ষা ছেড়ে বিয়ে না করার মতো মানসিক প্রত্যয় তৈরি হয়েছে। এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে—বিভিন্ন এলাকায় অনেক সাহসী স্কুলে পড়া মেয়ে নিজেরাই নিজেদের বাল্যবিয়ে রোধে পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ ছাড়া ছেলেদের মধ্যেও এক ধরনের বোধ বা চাহিদা তৈরি হয়েছে—নিজের স্ত্রীর শিক্ষার পক্ষে। অর্থাৎ মেয়েদের বিয়ের আগে শিক্ষার ব্যাপারে নারী-পুরুষের সমন্বিত এক ধরনের জাগরণ দেখা যায়।