সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের পাগড়াতলী খালে গত ২০ ডিসেম্বর কাঁকড়া সংগ্রহে যান সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের মজিবুর রহমান ও ইসমাইল হোসেন।
সেখানে বাঘের শিকার হন মজিবুর। প্রাণ বাঁচিয়ে এলাকায় ফিরে সে খবর জানান ইসমাইল। পরদিনই মজিবুরকে উদ্ধার অভিযানে যায় সাত সদস্যের একটি দল। মজিবুরের ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ বাঘের কাছ থেকে উদ্ধার করে তারা এনে দেন পরিবারের কাছে। দলটির এই অভিযান ফেসবুকে ভাইরাল; প্রশংসিত হচ্ছে দলনেতা টাইগার গনির সাহসী নেতৃত্ব।
টাইগার গনির আসল নাম আব্দুল গনি গাজী। একসময় বন বিভাগের টাইগার রেসপন্স টিমের হয়ে কাজ করতেন তিনি। সে চাকরি শেষ হয় বছর দুয়েক আগে।
চাকরি গেলেও কাজ থেকে সরে দাঁড়াননি গনি। কোথাও কোনো খবর পেলেই তিনি ছুটে যান। কখনও মানুষের হাত থেকে প্রাণীকে উদ্ধার করে বনে ফিরিয়ে দেন, কখনও হিংস্র প্রাণীর কাছ থেকে ছিনিয়ে আনেন মানুষকে বা অন্তত নিথর দেহকে। প্রতিটি কাজই এখন করেন বিনা পরিশ্রমিকে।
টাইগার গনির সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। আব্দুল গনি গাজী থেকে টাইগার গনি হয়ে ওঠার গল্প তিনি শুনিয়েছেন।
গল্পের শুরুতেই টাইগার গনি জানালেন তার সবচেয়ে স্মরণীয় উদ্ধার অভিযানের কথা। ঘটনাটি ২০১০ সালের।
তিনি জানান, মধু সংগ্রহে গিয়ে বাঘের শিকার হন সাতক্ষীরার মজিদ সর্দার। তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই তা প্রায় নিশ্চিতই ছিল। তার পরও অন্তত মরদেহ যেন পরিবার ফিরে পায়, সে জন্য তিনি তার দল নিয়ে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে অভিযানে যান।
টাইগার গনি জানান, মুজিবকে ঠিক যেখান থেকে বাঘ তাড়া করতে শুরু করে, সেখান থেকে তারা খুঁজতে শুরু করেন। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর বাঘের পায়ের চিহ্ন ও গাছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রক্তের দাগ অনুসরণ করে দলটি মজিবের ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ খুঁজে পায়।
মরদেহের কাছে এগোতে গিয়ে তারা আশপাশের ঝোপঝাড়ে বাঘের অস্তিত্ব টের পান। টাইগার গনিরই প্রথম চোখে পড়ে বাঘটির ওপর। মাত্র ১২-১৩ হাত দূরে ছিল সেটি। মানুষ দেখে গর্জন শুরু করে বাঘ।
গনির নির্দেশে সবাই হাতে থাকা লাঠি দিয়ে গাছে আঘাত করে ও সমস্বরে চিৎকার করে শব্দ তৈরি করতে থাকেন। বাঘও বাড়িয়ে দেয় গর্জন।
এভাবে প্রায় ১০ থেকে ১২ মিনিট ধরে বাঘ-মানুষের ‘শব্দযুদ্ধ’ চলার পর হার মানে বাঘ, পালিয়ে যায় গহিনে। মজিদের মরদেহ গনির দল উদ্ধার করে ফিরে আসে এলাকায়।
এই কাজে কীভাবে আসা?
গনি জানান, তার বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কালিঞ্চি গ্রামে। ৪৫ বছরের গনির সংসারে আছে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। অভাবে ছেলের লেখাপড়া এখন বন্ধ।
তিনি বলেন, ‘আমি জেলে ছিলাম। সুন্দরবনের বিভিন্ন খালে আমি মাছ ধরতাম, কাঁকড়া ধরতাম। এরই মধ্যে ২০০৭ সালে ৯ জনের মধু সংগ্রহকারী একটি দলের ওপর বাঘ আক্রমণ করে। দুজনকে বাঘ ধরে নিয়ে যায়, যার মধ্যে একজন মারা যান।
‘পরে বন বিভাগ অভিজ্ঞদের নিয়ে মৃতদেহ উদ্ধার করে। সেই ঘটনা আমি সামনে দেখি এবং আমার মনে গেঁথে যায়। আমার ইচ্ছে জাগে তাদের সঙ্গে কাজ করার। এর পর পরই ফরেস্ট টাইগার রেসপন্স টিমের বোটে মাঝি হিসেবে কাজ শুরু করার সুযোগ পাই।’
গনি বলেন, ‘এর পর থেকে বাঘ আক্রমণের যত ঘটনা ঘটেছে, আমি সবগুলোয় নিজেকে যুক্ত করার চেষ্টা করেছি। আমি লেখাপড়া করিনি, কোনো দিন স্কুলে যাইনি, কিন্তু টাইগার রেসপন্স টিম ও ওয়াইল্ড টিমের সঙ্গে থেকে থেকে আমি শিখে গেছি। কিছু আমি লিখতে পারি এখন।
‘আমি একটা ডায়েরিতে সব লিখে রাখতাম। আমার ডায়েরির তথ্য অনুসারে ২০০৭ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১০০ মরদেহ উদ্ধার করেছি।’
প্রাণের মায়া হয় না?
গনি হেসে বলেন, ‘এই কাজে তৃপ্তি পাই। আমার ভালো লাগে। যখন কারও মরদেহ নিয়ে ফিরি, সেই পরিবারের মানুষ তখন নিথর দেহ রেখে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। তারা আমাকে বলে মৃত্যু হয়েছে সেখানে আর কিছু করার নাই, কিন্তু তোমার কারণে আমাদের স্বজনকে শেষবার দেখতে পারছি। আমি লাশের গোসল থেকে দাফন পর্যন্ত সব নিজেই করি। এটাই আমার সুখ।’
তিনি জানান, এলাকার লোকজনই ভালোবেসে তাকে টাইগান গনি উপাধি দিয়েছে। এখন সাতক্ষীরা রেঞ্জে তিনি এ নামেই পরিচিত।
গনি বলেন, ‘আমি ২০০৭ সালে যোগ দিয়ে ২০০৮-তে টাইগার রেসপন্স টিমের লিডার হই এবং ২০১৯ সালে এই প্রজেক্টটা শেষ হয়, চলে যায় আমার চাকরিও। এরপর বন বিভাগের এক স্যারের সহযোগিতায় ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে কাজ করি ১ বছর ৩ মাস।
‘পরে পরিবারের জন্য চলে আসি। এরপর বন বিভাগের একটি বোটে ড্রাইভার হিসেবে কাজ পেলেও আমার ভালো লাগার কাজ করতে পারছিলাম না। খবর পেলেও চাকরি ফেলে কোথাও বন্যপ্রাণী বা আক্রান্ত মানুষকে উদ্ধারে যেতে পারতাম না। তাই আট দিনের মাথায় চাকরি ছেড়ে দিই।
‘এরপর এলাকায় এসে কাজ করতে চাইলে দিনমজুরের কাজ আর কেউ দিতে চায় না। সবাই ভাবে আমি বড় অফিসার বা স্যার। তারা কাজের কথা বললে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। এখন অভাবের সংসার চালানো কঠিন। কোনো কাজ নেই, তবুও যখনই খবর পাই বন্যপ্রাণীরা সুন্দরবন থেকে লোকালয়ে এসেছে আমি ছুটে যাই। উদ্ধার করে আবার সুন্দরবনে ফিরিয়ে দিই। লোকালয়ে বাঘ এলে তাতেও আমি যাই এবং এই রকম অনেক বাঘ ফিরিয়ে দিয়েছি সুন্দরবনে।’
গনি জানান, উপার্জন নেই জেনেও তিনি এ কাজ করে যাবেন। তিনি বলেন, ‘আমি মানুষের থেকে যে সম্মান আর ভালোবাসা পাই, সেটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। আমি লেখাপড়া করিনি। তবুও রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে মানুষ যেভাবে আমাকে সালাম দেয়, বুকে জড়িয়ে নেয় তাতে আমার এই জীবনে আর কিছুই লাগবে না।’
টাইগার গনি জানালেন, ছেলে শাহীনও তার মতোই বন্য প্রাণীপাগল। অভাবের কারণে লেখাপড়া বন্ধ হলেও ছেলেকে এখন ট্রেনিং দিচ্ছেন, তৈরি করছেন পরবর্তী টাইগার গনির হয়ে উঠতে।
টাইগার গনির বিষয়ে সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) এম এ হাসান বলেন, ‘ওই এলাকায় এখন কোনো প্রজেক্ট নেই। গনিকে খুলনা রেঞ্জে নেয়া হয়েছিল। তবে তিনি সাতক্ষীরা ছেড়ে সেখানে কাজ করতে রাজি হননি। এখন নিজ এলাকার আশপাশে কোনো ঘটনা ঘটলে তিনি নিজে থেকে উদ্ধারে যান।
‘তবে সামনে আরও প্রজেক্ট আসবে। তখন নিশ্চয়ই তাকে নেয়া হবে।’
বন সংরক্ষক (খুলনা অঞ্চল) মিহির কুমার দো জানান, ‘তিনি অনেক ভালো কাজ করছেন। আমরা তাকে একবার চাকরি দিয়েছিলাম। যেহেতু তার বয়স বা যোগ্যতা বিচারে সেভাবে চাকরিতে নেয়া সম্ভব না তাই আমরা তারে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে চাকরি দিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি কিছুদিন করার পর স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন। তবে আমাদের পক্ষ থেকে যতটা সহযোগিতা তাকে করা সম্ভব সব অব্যহত থাকবে।’