জি এম আরিফুজ্জামান: আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা); উত্তর রাখাইন রাজ্যে সক্রিয় একটি রোহিঙ্গা বিদ্রোহী দল, যা কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধ্যে আল ইয়াকিন নামেও পরিচিত। যারা দাবি করে- রোহিঙ্গাদের অধিকার সুরক্ষা আন্দোলনে কাজ করে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে বিতাড়িত হয়ে আসার আগে এই ধারণা ছিল, তারা যা-ই করুক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য ক্ষতির কারণ হবে না। আরসার নেতৃত্বে কে বা কারা ছিল, তার সঠিক তথ্য খুব বেশি সামনে আসেনি। তবে, ২০১৬ সালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মাধ্যমে ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে দলটির নেতৃত্ব দেন আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনি, যিনি পাকিস্তানের করাচিতে জন্ম নিয়েছেন; বড় হয়েছেন মক্কায়। আরও জানা যায়, ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর ২০১৩ সালে হারাকাহ আল-ইয়াকিন নামে গঠিত হয় এই আরসা।
বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, আরসা মূলত মিয়ানমারে ‘রোহিঙ্গাদের জন্য একটি গণতান্ত্রিক মুসলিম রাজ্য’ প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে। প্রথম থেকে মিয়ানমার জান্তা সরকারের সঙ্গে আরসার একটা স্পষ্টত বিরোধী মনোভাব বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায়। আরসার প্রতি সরকারের কঠোর নীতির চরম বহিঃপ্রকাশ পায় ২০১৭ সালের ২ আগস্ট। এই দিনে মিয়ানমারের অ্যান্টি-টেররিজম সেন্ট্রাল কমিটি কাউন্টার টেররিজম আইনের আলোকে আরসাকে একটি সন্ত্রাসী দল হিসেবে আখ্যা দেয়। ২০১৭ সালের ২২ জুন মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী আরসার ক্যাম্পে হানা দেয় এবং এতে আরসার তিন সদস্য নিহত হয়। এর পর ২০১৭ সালের জুলাই মাসে সরকার ৩৪-৪৪ জন বেসামরিক ব্যক্তিকে অপহরণের অভিযোগে অভিযুক্ত করে আরসাকে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট আরসার পক্ষ থেকে ২৫টি এলাকায় হামলার দায় স্বীকার করা হয়, যার মধ্যে আছে পুলিশ ফাঁড়ি ও সেনাঘাঁটি। সরকার এবং আরসার মধ্যকার রেষারেষিতে নির্মমতা চরম রূপ ধারণ করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর। মিয়ানমার সেনাবাহিনী আরসা ও সন্ত্রাসী দমনের নামে বেসামরিক রোহিঙ্গা জনগণের ওপর গণহত্যা চালায়। জীবন বাঁচাতে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নেয়।
এই বর্ণনা থেকে এটা বলা যায়, রোহিঙ্গাদের অধিকার এবং সুরক্ষায় আরসা কাজ করে যাচ্ছে একটি সশস্ত্র স্বাধীনতাকামী সংগঠন হিসেবে। তবে, সব সময় একটা সন্দেহ ছিল তাদের দলের কার্যক্রম এবং দলীয় সদস্যদের পরিচয় নিয়ে। কে বা কারা এই আরসার সঙ্গে যুক্ত, তার পরিসংখ্যান ছিল না সরকার বা সাধারণ মানুষের কাছে। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প স্থাপিত হওয়ার পর বিভিন্ন সময় আলোচনায় ছিল আরসার নাম। তবে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের উপস্থিতি অস্বীকার করা হয়। দৃশ্যত ২০১৭ সালের আগস্টের পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী বা সরকারের বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রতিরোধের বার্তা দিতে পারেনি আরসা। আরসার দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম পাওয়া যায় না মিয়ানমার সেনাবাহিনী বা সরকারের বিরুদ্ধে। পক্ষান্তরে, আল ইয়াকিন নামক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর খোলসে রূপ নেয় আরসা। তবে, এই আরসা এবং ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের আরসার মধ্যে বিরাট পার্থক্য।
রোহিঙ্গাদের অধিকারের নামে যে আরসা পরিচিত হয়েছে, সেই আরসা এখন রোহিঙ্গা নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক বিশ্নেষকের মনে এমন প্রশ্নের উদয় হয়েছে- আসলেই কি তারা রোহিঙ্গাদের অধিকারের জন্য কাজ করছে, নাকি রোহিঙ্গাবিরোধী শক্তির পক্ষাবলম্বন করছে? নানা সময়ে ক্যাম্পের মধ্যে হত্যা, নির্যাতন, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, অপহরণ- এমনকি অগ্নি-সন্ত্রাসের মতো মর্মান্তিক ঘটনায়ও জড়িয়ে পড়ে আরসা বা আল ইয়াকিনের নাম। যে সংগঠনের মূল প্রতিপাদ্য রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা, সেই সংগঠন এখন রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার গলায় বিঁধে আছে কাঁটা হয়ে। সংগঠনটির বিভিন্ন কর্মকাণ্ড প্রকাশ পেয়েছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিরোধী হিসেবে।
‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ)’ ব্যানারে রোহিঙ্গাদের অধিকার বিষয়ে বিশেষত রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন বিষয়ে সব সময় সরব ছিলেন মুহিবুল্লাহ। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যকার চুক্তি বাস্তবায়ন, আন্তর্জাতিক আদালতে শুনানি, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন বিষয়ে সরব কণ্ঠস্বর তাকে সারাবিশ্বের কাছে পরিচিত করেছে রোহিঙ্গা নেতা হিসেবে। সেই মুহিবুল্লাহ গত ২৯ সেপ্টেম্বর লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প ইস্ট-ওয়েস্ট ১ নম্বর ব্লকে বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন এবং নাম আসে আরসার। শুধু মুহিবুল্লাহ হত্যায় নয়, তার মাত্র এক মাসের ব্যবধানে ২২ অক্টোবর কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থিত ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ’ মাদ্রাসায় সন্ত্রাসীদের হামলায় ছয়জন নিহতের ঘটনায়ও নাম আসে আরসার। এ ছাড়াও গত ১ নভেম্বর ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্প ব্রেকিং নিউজ’ নামক ফেসবুক পেজ থেকে প্রকাশিত একটি ভিডিও এক যুবকের বয়ানে আগামী শীত মৌসুমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশ আসে আরসার পক্ষ থেকে। যদি সেই যুবক কাজ করতে ব্যর্থ হয়, তবে তাকে মেরে ফেলা হবে- এ ধরনের বার্তাও পাওয়া যায় তার বয়ানে।
রোহিঙ্গাদের অধিকার সুরক্ষার নামে আলোচনায় আসা আরসা ক্রমেই হয়ে উঠছে রোহিঙ্গাদের অধিকার হরণের কারিগর হিসেবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সার্বিক নিরাপত্তা বজায় রাখা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। সে জায়গায় আরসার ভূমিকার গোলকধাঁধা নতুনভাবে ভাবাচ্ছে ক্যাম্পে অবস্থিত রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা এবং ক্যাম্পের নিরাপত্তার বিষয়কে।
রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
gmarif.cgs@du.ac.bd