আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটবদ্ধ হয়ে লড়াইয়ে নামার উদ্যোগ রয়েছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিতে। সেইসঙ্গে ওই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয় পেলে একসঙ্গে নতুন সরকার গঠনেরও চিন্তাভাবনা করছে এ দুই রাজনৈতিক দল। অর্থাৎ একসঙ্গে নির্বাচন ও সরকার গঠনের প্রস্তুতি রয়েছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিতে।
এ দুই রাজনৈতিক দলের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা সমকালের সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছেন, বিএনপি শেষ পর্যন্ত আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। আর এ বিষয়টি মাথায় রেখেই দুই দলের নীতিনির্ধারক নেতারা একসঙ্গে আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং নতুন সরকার গঠনের বিষয়ে প্রাথমিকভাবে একমত হয়েছেন। এ নিয়ে দুই দলের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকও হয়েছে।
তবে এই মেরুকরণ সফল করতে হলে আওয়ামী লীগকে ১৪ দলের শরিক দলের সঙ্গেও নতুন করে সমঝোতায় আসতে হবে বলে অনেকে মনে করছেন। অবশ্য সংশ্নিষ্ট সূত্র জানাচ্ছে, আওয়ামী লীগ ১৪ দলের শরিকদের জন্য গত নির্বাচনে ছেড়ে দেওয়া আসনগুলো এবারও বহাল রাখবে। নতুন করে শুধু আসন ভাগাভাগি হবে জাপার সঙ্গে।
বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিতে ভিন্ন চিন্তাও রয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে না এলে আলাদাভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতিও রয়েছে দুই দলে। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হয়ে নতুন সরকার গঠনের সুযোগ পেলে জাতীয় পার্টি আবারও বিরোধী দলের আসনে বসবে। তবে বর্তমান মন্ত্রিসভার মতো নতুন মন্ত্রিসভায়ও স্থান পাবেন জাতীয় পার্টির একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতা।
আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির একাধিক নীতিনির্ধারক নেতা জানিয়েছেন, গত ৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বৈঠকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দশম জাতীয় সংসদে বিরোধী দলে থাকলেও জাতীয় পার্টির কোনো লাভ হয়নি। উল্টো গৃহপালিত বিরোধী দলের দুর্নাম জুটেছে। এ কারণে জাতীয় পার্টি আগামীতে সরাসরি সরকারে থাকতে চাইছে। বিরোধী দলের আসনে বসতে তাদের আগ্রহ নেই।
এ জন্য হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির জোটবদ্ধ নির্বাচন এবং নির্বাচনে জয় পেলে একসঙ্গে নতুন সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি আগামী নির্বাচনে জয়ী হলে নতুন সরকারে জাতীয় পার্টিকে বড় ধরনের অংশীদারিত্ব দেওয়ারও অনুরোধ করেন প্রধানমন্ত্রীকে। এ ক্ষেত্রে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে জাতীয় পার্টির জন্য ১০০ আসনে ছাড় প্রত্যাশা করেছেন। আর সরকার গঠনের সুযোগ পেলে ১০ জনের মন্ত্রিত্ব চেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানকে কিছু বলেননি।
তবে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা সমকালকে জানিয়েছেন, ১৪ দলের পাশাপাশি মহাজোট ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি রয়েছে আওয়ামী লীগে। একই সঙ্গে গণতন্ত্রে বিশ্বাসীদের নিয়ে একসঙ্গে সংকট মোকাবেলারও উদ্যোগ রয়েছে। এ কারণে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন এবং আগামী দিনে দেশ পরিচালনার বেলায় আওয়ামী লীগ সংকীর্ণ মানসিকতা দেখাবে না। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দল গত নির্বাচনের তুলনায় আগামী নির্বাচনে শরিকদের বেশি আসনে ছাড় দেবে। বিএনপি নির্বাচনে না এলে জাতীয় পার্টিকে আগের চেয়ে বেশি সংখ্যক আসনে ছাড় দেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ সমকালকে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রধান শরিক জাতীয় পার্টি। তারা মহাজোটে রয়েছে। আগামী দিনেও মহাজোটে থাকবে। সুতরাং গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে প্রার্থিতা নিয়ে সমঝোতা তৈরি হবে। আর আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনে জয় পেয়ে নতুন সরকার গঠনের সুযোগ পেলে বিরোধী দলে যাবে বিএনপি। তখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারে থাকবে জাতীয় পার্টি। তবে বিএনপি নির্বাচনে না এলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ওই বৈঠকে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ ওই বৈঠকে না থাকায় গুঞ্জন ছিল, জাতীয় পার্টিতে আবার বিবাদ সৃষ্টি হয়েছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও রওশন এরশাদ দুই শিবিরে আবারও বিভক্ত হয়ে পড়ছে জাতীয় পার্টি।
অবশ্য এ গুঞ্জনকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার। তিনি সমকালকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জাতীয় পার্টির বৈঠকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও রাজনৈতিক কলাকৌশল নিয়ে কথা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতির পাশাপাশি আগামী নির্বাচন নিয়েও কথা বলেছেন। কীভাবে ভোট করলে ভালো হয়, তার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। জাতীয় পার্টির মহাসচিব সমকালকে জানিয়েছেন, তাদের কৌশল স্পষ্ট ও পরিস্কার। বিএনপি ভোটে এলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচন করবে জাতীয় পার্টি। তারা একসঙ্গে নতুন সরকারও গঠন করবে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ৪৯ আসনে জাতীয় পার্টিকে ছাড় দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই সব আসনের ২০টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা কোনো না কোনোভাবে নির্বাচনে থেকে যান। আর সবক’টি আসনেই হেরে যান জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। ১৩টিতেই জামানত বাজেয়াপ্ত হয় জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থীদের। অতীতের এমন অভিজ্ঞতায় এবার আগেভাগেই দাবিনামা তৈরি করেছে জাতীয় পার্টি। তাদের প্রত্যাশা, জোটবদ্ধ নির্বাচনে লড়লে যেসব আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী থাকবে, সেসব আসনে কোনো অবস্থাতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী রাখা যাবে না।
এ নিয়ে গত মাসে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম ও সংসদীয় দলের যৌথ সভায় বিশদ আলোচনা হয়েছে। জাতীয় পার্টির দুই এমপি নুরুল ইসলাম মিলন ওং পীর ফজলুর রহমান ওই সভায় বলেছেন, আওয়ামী লীগ আসন ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেয়; কিন্তু প্রার্থী প্রত্যাহার করে না। তাই এবার আগেভাগেই নিশ্চিত করতে হবে, যেন অতীতের পুনরাবৃত্তি না হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ সমকালকে বলেছেন, জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী থাকতে পারবে না- এটাই তাদের প্রত্যাশা।
এদিকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৭০টি আসনে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে ছাড় দেওয়া হবে। কিন্তু জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ১০০ আসনে ছাড় প্রত্যাশা করছেন। তার দাবি, ১০০ আসনে জাতীয় পার্টির শক্ত অবস্থান রয়েছে। এ অবস্থায় আসন ভাগাভাগি নিয়ে দ্রুতই আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতারা বৈঠকে বসবেন বলে জানা গেছে।
তবে ক্ষণে ক্ষণে অবস্থান বদলের কারণে আলোচিত-সমালোচিত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ শেষ পর্যন্ত কী করবেন, তা নিয়ে কিছুটা সংশয় রয়েছে আওয়ামী লীগে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পাঁচ দিনের সফর শেষে গত শুক্রবার সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরেছেন। বিদেশ সফরেও তিনি আওয়ামী লীগের কড়া নজরে ছিলেন। বিএনপির দিকে যেন ভিড়তে না পারেন, তাই এমন সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছিল। তবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অনুজ ও জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের সমকালকে বলেছেন, এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গেই জাতীয় পার্টির জোটবদ্ধ নির্বাচনের সম্ভাবনা প্রবল।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে যোগ দিয়েও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। নানা নাটকীয়তার পর রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি ওই নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৩৪ আসন পেয়ে বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের নির্দেশ দিলেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ৮৫টি আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিল।