রাখাইন সংকট সমাধানে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে মায়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। গত শুক্রবার ভারতের নয়া দিল্লিতে ১৪ তম ভারত-ইইউ সামিট শেষে এক যৌথ বিবৃতিতে এই আহ্বান জানানো হয়। রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ করে অবিলম্বে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা উচিত। মায়ানমার কর্তৃপক্ষকে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয় এই যৌথ ঘোষণায়। তবে বিবৃতিতে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। যৌথ ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের সভাপতি ডোনাল্ড টাস্ক এবং ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রধান জিন ক্লাউড জাঙ্কার। এদিকে সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনযজ্ঞের শিকার রাখাইন প্রদেশে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের প্রবেশাধিকার না দেওয়াকে মায়ানমারের ‘অগ্রহণযোগ্য’ পদক্ষেপ আখ্যা দিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির মানবিক সহায়তা-বিষয়ক দফতরের প্রধান মার্ক লোকক জানিয়েছেন, কয়েকদিনের মধ্যে তাদের একজন প্রতিনিধি রাখাইন সফর করতে পারবেন বলে আশাবাদী তারা। তবে রাখাইনে প্রবেশ করতে পারলেও জাতিসংঘ স্বাধীনভাবে কর্মকাণ্ড চালাতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়ের কথা উল্লেখ করেছে ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসি।
যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, মায়ানমারের রাখাইনে সহিংসতায় দেশটি থেকে বিশাল সংখ্যক মানুষের পালিয়ে যাওয়ার সাম্প্রতিক ঘটনায় ভারত ও ইইউ উদ্বেগ প্রকাশ করছে। পালিয়ে যাওয়া এসব মানুষের বেশির ভাগ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা উভয় পক্ষ মনে করি যে, এই সহিংসতা শুরু হয়েছে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) জঙ্গিদের কয়েকটি হামলার পর। এই হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। রাখাইন রাজ্যে বাস্তুচ্যুত মানুষ ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে মায়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ভারত ও ইইউ এই সংকটে মানুষকে প্রয়োজনীয় মানবিক সহযোগিতা প্রদান করায় বাংলাদেশের ভূমিকাকেও স্বীকৃতি দিচ্ছে বলে যৌথ ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনযজ্ঞের শিকার রাখাইন প্রদেশে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের প্রবেশাধিকার না দেওয়াকে মায়ানমারের ‘অগ্রহণযোগ্য’ পদক্ষেপ আখ্যা দিয়েছে জাতিসংঘ। গত ২৫ আগস্ট নিরাপত্তা বাহিনীর চেকপোস্টে বিদ্রোহীদের হামলার পর ক্লিয়ারেন্স অপারেশন জোরদার করে মায়ানমারের সেনাবাহিনী। ওই সহিংসতায় এ পর্যন্ত ৫ লাখ ১৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। চলমান সংঘাত শুরুর পর থেকেই রাখাইনে নিষিদ্ধ রয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। জাতিসংঘসহ মানবিক সহায়তা দানের প্রায় ২০টি সংগঠন তাদের কার্যক্রম বন্ধে বাধ্য হয়। সরকারের বিরুদ্ধে স্পষ্টত ত্রাণ কার্যক্রমে অসহযোগিতা ও বাধাদানের অভিযোগ তোলে ওই সংস্থাগুলো। সেখানে প্রবেশাধিকার নেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অন্যান্য অংশেরও। সম্প্রতি ২০ জন কূটনীতিককে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে প্রবেশ করতে দিতে বাধ্য হয় মায়ানমার। সরকারি তত্ত্বাবধানে সেখানে গিয়েও মানবিক বিপর্যয়ের ভয়াবহতা দেখে আসেন কূটনীতিকরা। বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা গ্রাম এরই মধ্যে পুড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
মার্ক লোকক গত শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমার প্রত্যাশা, জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই অঞ্চলটি সফর করে আসতে পারবেন। রাখাইনে সাহায্যকর্মীদের অবাধ ও স্বাধীন চলাচলের সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়ে আগেও বক্তব্য দিয়েছে জাতিসংঘ। মার্ক লোককের বক্তব্যেও সে আহ্বানের পুনরাবৃত্তি ছিল। তবে জেনেভা থেকে বিবিসির সংবাদদাতা বলছেন, ওই কর্মকর্তাকে রাখাইনে নিয়ে যাওয়া হলেও তাকে কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া হবে সেটা পরিষ্কার নয়।
ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি বৃহস্পতিবারের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এখনও রাখাইন থেকে যাওয়া রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিতে নতুন করে দ্বিগুণ শক্তিতে অভিযান শুরু করেছে মায়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। এই বাস্তবতায় রাখাইন প্রদেশে অবাধ প্রবেশাধিকার চাইছে জাতিসংঘ। সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জেনেভায় গত শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা-বিষয়ক দফতরের প্রধান মার্ক লোকক সহিংসতাকবলিত অঞ্চলটিতে মায়ানমার সরকারের কোনো ধরনের মানবিক সহায়তার প্রবেশাধিকার না দেয়ার বিষয়টিকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে মন্তব্য করেন।
মায়ানমার সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ঘোষণা দিলেও পালিয়ে আসা শরণার্থীরা বলছেন, পশ্চিম রাখাইনে থেকে যাওয়া অবশিষ্ট রোহিঙ্গাকে দেশছাড়া করতে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান দ্বিগুণ জোরদার করা হয়েছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, প্রতিদিন বাংলাদেশের সীমান্তে ছুটছে হাজার হাজার মানুষ। বহু গ্রাম এখন একেবারেই জনমানবশূন্য। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বাংলাদেশি কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে মায়ানমারের অভ্যন্তরে নিরাপদ অঞ্চল (সেফ জোন) প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। তবে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পর্যবেক্ষণকারী জেনেভাভিত্তিক অলাভজনক সংবাদমাধ্যম আইআরআইএন (ইনসাইড স্টোরি অফ ইমার্জেন্সিস)-এর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুযায়ী এখনও রাখাইনে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে কাউকে ফিরিয়ে নিলে তাদেরও ওই ক্যাম্পে রাখবে মায়ানমার। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আশঙ্কা, নতুন শরণার্থী শিবিরগুলোও রোহিঙ্গাদের উন্মুক্ত কারাগার হতে যাচ্ছে।