শেখ হাসিনাকে এখন পৃথিবীর যে কেউ ঈর্ষা করতে পারেন। কারণ, সত্তরেও শেখ হাসিনা ম্যান ইন দ্য মেকিং। তাঁর শেষ কোথায় এখনও কেউ বলতে পারেন না। সত্তর বছর বয়সে বেশির ভাগেরই জীবনে সীমারেখা টানা হয়ে যায়, শেখ হাসিনার তা ঘটেনি বরং এখনও কেউ বলতে পারে না কোথায় গিয়ে থামবে শেখ হাসিনার সাফল্য ও সৃষ্টি।
শেখ হাসিনার সাফল্য ও সৃষ্টির নানান দিক, যা কোন মতেই একটি কলামে লেখা সম্ভব নয়। যদিও এ লেখার শিরোনাম দিয়েছি লিডার অফ দ্য ইস্ট কিন্তু শেখ হাসিনা শুধু পুবেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি- পশ্চিমও তাঁকে ধীরে ধীরে নেতা মানতে শুরু করেছে। এ বছর যখন শেখ হাসিনার এই জন্মদিন পালিত হচ্ছে তখন পশ্চিম তাকে ‘মাদার অফ দি হিউম্যানিটি’ বলে উল্লেখ করতে শুরু করেছে। পূর্বে ও পশ্চিমে সবখানে কথা উঠেছে শেখ হাসিনাকে শান্তিতে নোবেল দেয়া হোক। পশ্চিমা বিশ্ব যে কারণ দেখিয়ে শেখ হাসিনাকে শান্তিতে নোবেল দিতে বলছে তাতে শেখ হাসিনাকে খ- ও ক্ষুদ্র করা হয়। তাঁদের কাছে এ বছর শেখ হাসিনার নোবেল দেবার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার কারণে। বাস্তবতা হলো এ কাজটি মানব শান্তির পক্ষে শেখ হাসিনার দীর্ঘ কর্মকা- ও সংগ্রামের একটি মাত্র। এ রকম একটি ঘটনা দিয়ে বিচার করলে শেখ হাসিনাকে কয়েকবার নোবেল দিতে হয়, তবে তার থেকে বড় নোবেল পুরস্কার সম্মানিত হবে শেখ হাসিনাকে পুরস্কৃত করে।
শেখ হাসিনা তাঁর দেশের নিপীড়িত মানুষের শান্তির জন্য যে সংগ্রাম করে চলেছেন ১৯৭৫ থেকে আজ অবধি সেই দীর্ঘ সংগ্রাম ও কর্মকা-ের একটি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ অবধি শেখ হাসিনা নিজ দেশে আসতে পারেননি। তিনি তখন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। ওই সময়ে তিনি তাঁর পরিবারের সকলকে হারিয়ে (তাঁর পিতা ও মাতা শুধু তার পরিবারের ও তাঁর নিজের ছিলেন না, ছিলেন গোটা দেশের, পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দেশ ও জাতির স্রষ্টা।) ওই দুঃসময়ে পৃথিবীর নানান দেশেÑ যেখানে যতটুকু পেরেছেন তিনি প্রায় এককভাবে সংগ্রাম করেছেন নিজের মানুষকে সামরিক শাসনের নিপীড়ন থেকে মুক্ত করার জন্য।
’৮১ সালে একমাত্র বোন ছাড়া পরিবারের সকলকে হারানো এক বুক শোক নিয়ে নিজ দেশে আসেন সামরিক শাসনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে। শেখ হাসিনা যখন দেশে ফেরেন তখনও এই দেশের হাজার হাজার তরুণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যার প্রতিশোধ নিতে ও স্বাধীনতার চেতনা প্রতিষ্ঠিত করতে সশস্ত্র যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল। শেখ হাসিনা তখন ইচ্ছে করলে নিমেষেই দেশকে গৃহযুদ্ধের ভেতর ঠেলে দিতে পারতেন। শেখ হাসিনা নিজের তারুণ্যের টগবগে রক্তকে চেপে রেখে, পিতৃ হত্যার রক্তাক্ত প্রতিশোধের ইচ্ছাকে দমিত করেÑ একজন শান্তিকামী বিচক্ষণ রাজনীতিকের মতো বলেন, ‘শোককে শক্তিতে পরিণত করুন’ এবং শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ভেতর দিয়ে দেশে গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠা করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার আইনের পথে করতে হবে।
শেখ হাসিনা যাতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে না পারেন, তিনি যাতে দেশকে কোন গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে বাধ্য হন, তিনি একজন উগ্রবাদী নেতা হিসেবে পরিণত হন- এ জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ফাঁদ বার বার পাতা হয়েছে। শেখ হাসিনা ভুলেও ওই ফাঁদে পা দেননি। শেখ হাসিনা যখন এ দেশে ফেরেন ওই সময়ে এই বাংলাদেশে শুধু সাধারণ নাগরিকের জীবন অনিশ্চিত ছিল না, সামরিক বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের জীবনও অনিশ্চিত ছিল। তাদের কার কখন মৃত্যু হয়, কোন মুহূর্তে দেশে সামরিক অভ্যুত্থান হয় এই নিয়ে তাদের শঙ্কিত থাকতে হতো। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ অবধি সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে ২১টি সামরিক অভ্যুত্থান হয়। তখন প্রায় প্রতি রাতে নিহত হতো সামরিক বাহিনীর কোন না কোন সদস্য, যা ওই সময়ের গার্ডিয়ানের রিপোর্টসহ অনেক রিপোর্ট সাক্ষী। শেখ হাসিনা সেই রক্ত ও মৃত্যু থেকে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মুক্ত করে আজ উন্নত একটি সামরিক বাহিনীতে পরিণত করেছেন। এখন তারা শুধু দেশেই প্রশংসিত নয়, বিদেশেও শান্তি রক্ষায় প্রশংসিত।
অন্যদিকে তিনি বার বার মৃত্যুর মুখে পড়েও প্রতিক্ষেত্রে ধৈর্য ধরেছেন। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের প্রতি পদে পদেও তাঁকে উস্কানি দেয়া হয়েছে। তার পরও তিনি সব ধরনের নির্যাতনকে মেনে নিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে গেছেন। পশ্চিমা বিশ্বে অনেকেই গণতান্ত্রিক আন্দোলন করার জন্যে শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন, হিসাব করলে দেখা যাবে তাদের গোটা আন্দোলন শেখ হাসিনার কোন একটি দিনের আন্দোলনের থেকে বেশি নয়। যেমন নূর হোসেন যেদিন ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ পিঠে এবং বুকে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ লিখে রাজপথে মিছিলে নেমে মারা যান ওই দিন শেখ হাসিনাকে নিয়ে যা করা হয়েছিলÑ এমন ঘটনা পশ্চিমা বিশ্বে কোন নেতার ক্ষেত্রে ঘটলে ওই বছরই তিনি নোবেল পেতেন। সেদিন জিরো পয়েন্টে টিয়ারশেল মেরে শেখ হাসিনার মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ করে ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে শেখ হাসিনার ড্রাইভারকে গাড়ি থেকে নামতে বাধ্য করে। তার আশপাশের অনেককে গ্রেফতার করে। তার পরে শেখ হাসিনার গাড়ি ক্রেন দিয়ে টেনে নিয়ে যায়। ওদিকে তখন আউটার স্টেডিয়ামের সামনে মিছিলে মানুষের বুক লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হচ্ছে। মারা যাচ্ছে তার একের পর এক কর্মী। মারা যাচ্ছে নূর হোসেন। শেখ হাসিনা ওই টিয়ার গ্যাস ও গুলির ভেতর এগুতে থাকলে তাকে ব্যারিকেড দিয়ে আটকানো হয়। শেখ হাসিনা তখন মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে একটি মিছিল নিয়ে প্রেসক্লাবে আসেন।
এ ছাড়া চট্টগ্রামে যেদিন শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছিল, এক শ্রমিক নেতা ঝাপ দিয়ে সামনে এসে নিজ জীবন দিয়ে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেন। তার পরেও সেদিন পাখির মতো গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয় চট্টগ্রামে। সরকার অনেক মৃতদেহ সেদিন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। সরকারের এই গুলির মুখে দাঁড়িয়েও শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের জন্য শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী দিয়ে গেছেন। এমনকি ২০০৪ সালে যেদিন গ্রেনেড মেরে তাঁকে হত্যা চেষ্টা করা হয়। এক ঝাঁক নেতাকর্মী সেদিন প্রাণ দিয়ে, পঙ্গুত্ববরণ করে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেন। শেখ হাসিনার একটি কান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই হামলার পরে ফুঁসে উঠেছিল দেশ। ইচ্ছে করলে শেখ হাসিনা সেদিন জ্বালাও পোড়াওয়ের আন্দোলন করতে পারতেন। তার বদলে শান্তিপূর্ণ হরতালের ভেতরই তিনি তাঁর কর্মসূচী সীমাবদ্ধ রাখেন। সেদিন শেখ হাসিনাকে কাছে থেকে দেখেছি, ওই মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরার পরেও তিনি ছিলেন শান্ত ও তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্ত ছিল অত্যন্ত পরিমিত। এর একমাত্র কারণ, তিনি তাঁর নিজের জীবনের থেকে সব সময়ই সাধারণ মানুষের মুক্তির কথা ভেবেছেন। সর্বোপরি ২০১২, ১৩, ১৪ এমনিক ১৫তেও খালেদা জিয়া ও জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলামী যেভাবে পেট্রোল বোমা ও অন্যান্য রাসায়নিক বোমা মেরে ৫শ’র বেশি হত্যা করে, আহত ও পঙ্গু করে কয়েক হাজার মানুষ। দিনের পর দিন দেশের মানুষকে জিম্মি করে, যানবাহন শুধু নয়, সরকারী ও বেসরকারী স্থাপনা ধ্বংস করেÑ যা ছিল পৃথিবীর অন্যতম নৈরাজ্যকর ঘটনার একটি। এই নৈরাজ্যকেও শেখ হাসিনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দেশের শান্তিকামী মানুষকে এক করে মোকাবেলা করেছেন। এর পরেও এই নৈরাজ্যকারী নেত্রী খালেদা জিয়ার সন্তান বিয়োগের পর তিনি তাঁকে সমবেদনা জানাতে গেছেন। একজন প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি অপমানিত হয়ে ফিরেছেন। তার পরেও বলেছেন, আমিও একজন মা।
দেশের ভেতর এই রাজনৈতিক সংগ্রামে শুধু সফল হননি শেখ হাসিনা- এই নৈরাজ্যকর দেশকে শান্তিপূর্ণ দেশে পরিণত করে একটি মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করেছেন। নিজের দেশের অর্থনীতিকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছেন যার কারণে এখন তার দেশ গোটা বিশ্বের কাছে একটি বিস্ময়। দেশের অর্থনীতিকে ভাল করতে পেরেছেন বলেই শেখ হাসিনা আজ আশ্রয় দিতে পেরেছেন তার প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের নির্যাতিত অসহায় মানুষগুলোকে। শুধু যে মিয়ানমারের এই রোহিঙ্গাদের শেখ হাসিনা আশ্রয় দিয়েছেন তা নয়, এ মুহূর্তে এই এলাকার নেতৃত্বও শেখ হাসিনার কাঁধে চলে এসেছে স্বাভাবিকভাবে। কারণ, মিয়ানমারের এই নির্যাতিত মানুষদের সমস্যার সমাধান করতে হবে। সে সমাধানের ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখতে পারবেন একমাত্র শেখ হাসিনা, জাতিসংঘকে তাঁর মাধ্যমেই এগুতে হবে এশিয়ার এই এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায়। তাই বাংলাদেশের ভেতর আর সীমাবদ্ধ নেই শেখ হাসিনার নেতৃত্ব। এর মাত্র কয়েক মাস আগে ভারতের প্রবীণ নেতা এল কে আদভানি শেখ হাসিনাকে সার্কের মূল নেত্রী হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। এখন ঘটনা প্রবাহ যেখানে দাঁড়িয়েছে তাতে চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভারতকে সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনাকেই মিয়ানমারের এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। সে দায়িত্ব ইতিহাসই শেখ হাসিনার কাঁধে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সারা পৃথিবী এও স্বীকার করে নিয়েছে শেখ হাসিনা এখন লিডার অফ দি ইস্ট। আর সত্তরে এসে লিডার অফ দি ইস্ট হিসেবে শুরু হলো শেখ হাসিনার জীবনের আরেক বাঁক।
swadeshroy@gmail.com