আমার লেখাটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিখতে চাই। অনেকে হয়তো বাঁকা দৃষ্টিতে দেখবেন, কেউ কারণটা বুঝে বা না বুঝেই নানান সমালোচনা করবেন। সেটা আমি জানি।
যাইহোক, জেনে নেই কেন আমি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। প্রধানমন্ত্রী এই মুহূর্তে জাতিসংঘের বিভিন্ন সভায় অংশ নিতে আমেরিকায় অবস্থান করছেন। এরই মধ্যে তিনি জাতিসংঘের সদর দফতরে ট্রাস্টিশিপ কাউন্সিলে সাধারণ পরিষদের সভাপতি কাসাবা কোরোসি আহূত ইউএনজিয়ে প্ল্যাটফর্ম অব উইমেন লিডার্সের উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে অংশ নিয়েছেন। সেই বৈঠকে তার বলা প্রতিটি কথা আমাদের দেশের নারীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সেই বৈঠকে ঘোষণা করেছেন– ‘আমরা ২০২১ সালের মধ্যে প্রতিটি সেক্টরে ৪০ শতাংশ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়েছি’।
ওই একই বৈঠকে তিনি আরও বলেন– ‘যথোপযুক্ত সমাধান খুঁজে বের করা এবং তাদের অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য নেতৃত্বের দলে নারীদের থাকা গুরুত্বপূর্ণ। সংকটের সময় নারীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই সংকটের কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীদের যুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ।’
শেখ হাসিনা মন্তব্য করেছেন নারীরা সব ধরনের গতানুগতিক ধারাকে ভেঙে অদম্য সাহস ও নেতৃত্বের দক্ষতা দেখিয়ে প্রতিটা জায়গায় নিজেদের অবস্থানকে উজ্জ্বল করেছে। গোটা দেশ যখন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের দক্ষিণ এশিয়া ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হওয়া উদযাপন করছে ঠিক সেই সময়েই বাংলাদেশের নারী সমাজের জন্য আরেকটি বড় সংবাদ এসেছে।
জাতিসংঘের এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘আজকের আন্তসংযুক্ত চ্যালেঞ্জে নারী নেতাদের দ্বারা রূপান্তরমূলক সমাধান।’ এই সম্মেলন গোটা বিশ্বের নারীদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ জানি না কিন্তু আমাদের দেশের নারীদের জন্য একটি অন্যতম মাইলফলক হয়ে থাকবে বলেই আমি মনে করি।
বর্তমান বাংলাদেশে যখন নারীদেরকে ঘরবন্দি করার একটি চক্রান্ত ধীরে ধীরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। যখন প্রতিনিয়ত আমাদের নারীদেরকে ঘরে বাইরে নিজের অবস্থানকে প্রকাশ করতে লড়াই করতে হচ্ছে, পোশাকের বাহানায় নারী নির্যাতন, নারী ধর্ষণকে জায়েজ করতে চাইছে একটি মহল ঠিক তখন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সামনে এমন দৃঢ় ঘোষণা কতটা সাহস জোগায় এটা বলে বুঝানো যাবে না।
এই সরকারের বিরুদ্ধে একটি অন্যতম অভিযোগ হচ্ছে তারা মৌলবাদের সাথে খানিকটা আপস করে চলতে চায়। মৌলবাদী রাজনীতিকে নানাভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে আসছে বলেও অভিযোগ আছে। নারী ইস্যুতে আমরা বারবার সরকারের শক্ত অবস্থান জানতে চাইছিলাম। এমন একটি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সময়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা সরকারের ওপর থাকা এই অভিযোগগুলোকে অনেকটাই হালকা করে দেবে বলে আমি মনে করছি। প্রায় সময়েই আমরা হতাশ হয়ে বলি এই দেশ আফগানিস্তান, পাকিস্তান হয়ে যাচ্ছে। হয়তো আমরা ভুলে যাই যে, সেই দেশগুলোর সরকার হচ্ছে মৌলবাদে বিশ্বাসী সরকার। তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে নারী স্বাধীনতায় অবিশ্বাসী। সেইসব দেশে এখনও ব্লাসফেমির মতো কালো আইন প্রচলিত। নারীদের প্রকাশ্যে চলাফেরা নিষিদ্ধ। কিন্তু আমাদের দেশে এসবের কোনোটাই প্রযোজ্য নয়। আমাদের বর্তমান সরকার প্রধান, রাষ্ট্রপ্রধানের মুখ দিয়ে কখনও এ ধরনের মানসিকতার ভাষা শুনিনি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বারবার নারী স্বাধীনতার প্রতি তার প্রতিজ্ঞার কথা বলে এসেছেন। তারপরও বিরাজমান বৈরী পরিবেশ আমাদেরকে বারবার অবিশ্বাসী করে তুলেছে।
জাতিসংঘের এবারের সম্মেলনের সময় উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে যখন একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন যে– তারা নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর সকল প্রকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অংশগ্রহণকে প্রাধান্য দিচ্ছেন বা দেবেন তখন বুকে সাহস পাই। প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যেই তার সরকারের নারীকেন্দ্রিক নানা কর্মসূচির বিবরণ তুলে ধরেছেন বৈঠকে; যার মধ্যে এসডিজি অর্জনের লক্ষমাত্রাও আছে।
একজন সরকার প্রধান যদি নিজে বিশ্বাস না করতেন তাহলে কেবল আন্তর্জাতিক লক্ষমাত্রা অর্জনের জন্য কোনও কাজ করতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রী কেবল নিজ দেশের নারীর জন্যই বলেননি। তিনি বিশ্বপরিমণ্ডলে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তিনটি প্রস্তাবও তুলে ধরেছেন। সেই তিনটি প্রস্তাব হচ্ছে লিঙ্গসমতা বিষয়ক উপদেষ্টা বোর্ডের স্থানীয়করণ, পর্যাপ্ত রাজনৈতিক ও আর্থিক উপায়ে নারী নেতৃত্বাধীন সুশীল সমাজ সংস্থাকে লালন ও সমর্থন এবং লিঙ্গসমতার জন্য সাধারণ এজেন্ডাকে শক্তিশালী করতে নেতাদের একটি শীর্ষ সম্মেলন আহ্বান। এ লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী নারী নেতৃত্বকে উৎসাহিত করার জন্য জাতিসংঘের যেকোনও প্রচেষ্টায় নিজ দেশের অংশগ্রহণের উন্মুখতার কথাও ব্যক্ত করেছেন তিনি।
একদম বাস্তব কথা যে এখন কোনও বিষয়েই আর সংরক্ষিত দৃষ্টিতে দেখার উপায় নেই। গোটা পৃথিবীই এখন একটি দেশ। আর মৌলবাদ বা সংরক্ষণবাদও এখন পৃথিবীময় একটি সমস্যা। তাই এই সমস্যার মোকাবিলায় কেবল একটি দেশ সক্রিয় হয়ে সমাধান আসবে না। এরজন্য দরকার সবার সমান অংশগ্রহণ ও প্রতিজ্ঞা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ার নারীদের সক্ষমতায় বিশ্বাসী একজন মানুষ। সেই লক্ষ্যেই তিনি একটি আন্তর্জাতিক ঐকমত্যের সম্মেলনের প্রস্তাব করেছেন। এই যে তিনি একটি সমস্যাকে অ্যাড্রেস করে এর একটি সমাধানযোগ্য প্রক্রিয়ার সুপারিশ করেছেন এটি একজন যোগ্য নেতার পরিচয়। যিনি নিজে বিশ্বাস করেন যে নারীদের কোনোদিক দিয়েই পিছিয়ে থাকার মতো উপায় নেই। যোগ্যতার ভিত্তিতে একটি সমতাভিত্তিক বিশ্ব গড়ার যে প্রত্যয় ও কর্মকৌশলের কথা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে প্রকাশ পেয়েছে সেটি নারীকেন্দ্রিক একটি বাংলাদেশেরই ইঙ্গিত বহন করে।
মৌলবাদীরা যতই আস্ফালন করুক না কেন, আমাদের রাষ্ট্র কখনই নারীবিদ্বেষী ছিল না এবং সামনের দিনেও হবে না। এই আশ্বাস ও বিশ্বাসটুকু প্রদানের জন্য আবারও ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
লেখক : লীনা পারভীন – কলামিস্ট ও সমাজকর্মী