বিশেষ প্রতিবেদন: ‘মুমিন হতে চাই’ শিরোনামে একটি ইসলামিক গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তার ভক্তিমূলক গান ‘দমে দমে থাকো মাস্ত কালান্দার’। এ গান বাজানোর কারণে গত রবিবার একজন বাংলাদেশীকে গ্রেফতার করেছে সৌদি পুলিশ।
জানা গেছে, মদিনার হিল্টন হোটেলে কর্মরত বাংলাদেশী নাগরিক মোঃ মোবারক তাঁর বাসায় ইউটিউবে আসিফ আকবরের “মাস্ত কালান্দার” গান শুনছিলেন। গানে পাকিস্তানের কথিত সাধক লাল শাহবাজ কালান্দরের নাম ও অসংলগ্ন আরবী শব্দ থাকায় এক সৌদি নাগরিক পুলিশকে অবগত করে। পুলিশ মোবারককে তলব করে সৌদি কালচারাল সেন্টারে কর্মরত বাংলাদেশী আলেম শায়খ হাফিজুর রহমান মাদানীর কাছে গানের অর্থ জানতে চায়। গানে কালান্দারের কাছে অনুগ্রহ কামনা করা হয়েছে জেনে মোবারককে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়।
সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, তওবা ও ভুল স্বীকার করে এফিডেবিট দেয়া হয়েছে। আজ মঙ্গলবার মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে তার।
উল্লেখ্য, কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবরের পিতা এডভোকেট আলী আকবর ছিলেন কুমিল্লার শীর্ষ রাজাকারদের একজন। ১৯৭১ এ মুক্তিযোদ্ধারা মেজয় হায়দারের নেতৃত্বে কুমিল্লার যে ১০টি স্থানকে পাকবাহিনীর আড্ডাস্থল হিসেবে চিহ্নিত করে বম্বিং করে তার একটি আসিফদের বাসা।
কী আছে মাস্ত কালান্দার গানে?
রাজীব হোসাইনের কথা ও সুরে গানটি প্রকাশের পর আসিফ আকবর সাংবাদিকদের বলেন, “গানে বার বার মহান রাব্বুল আলামীনকে স্মরণ করা হয়েছে। বার বার আল্লাহপাকের গুনগান গাওয়া হয়েছে। কলবের জিকিরের কথা বলা হয়েছে।”
গানের কথাঃ
‘‘দমে দমে থাকো মাস্ত কালান্দার
দমে দমে তোল শোর
আল্লাহু আল্লাহু কলবে জিকির
ইয়া আলী দাও জোর
রাহমানুর রাহিম নাকাব
ফিরভি খোদা তু লা জাওয়াব
রাব্বি জিদনি এলমা এলমা
মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহ
মাস্ত কালান্দার মাস্ত কর পার
মাস্ত কালান্দার মাস্ত মাস্ত কর পার
গফুরুসালামু সাদা হক
তবু রুহ করে ধক ধক
তার নামে শুরু করি বিসমিল্লাহ…..’’
এ গান সম্পর্কে প্রদত্ত সাক্ষাতকারে আসিফ দমে দমে অর্থাৎ প্রতি নিঃশ্বাসে আল্লাহর নাম নেয়ার কথা বললেও আহবান করা হয়েছে লাল শাহবাজ কালান্দারকে। এ গানে ‘পার করার’ অর্থাৎ ইহকাল ও পরকালে মুক্তির জন্য শাহবাজ কালান্দরের কাছে মিনতি করা হয়েছে।
গানে কয়েকটি আরবী শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যার সাথে পূর্ববর্তী বা পরবর্তী শব্দের কোনো অর্থগত কোনো সামঞ্জস্য নেই। সম্পূর্ণ গানটিই এমন। কয়েকটি উল্লেখ করা হলোঃ
১. রাহমানুর রাহিম নাকাব, ফিরভি খোদা তু লা জাওয়াব।
উর্দুতে লাকাব/লকব অর্থ সমার্থক বা অপর নাম। সুফি গানে লাকাব ব্যবহৃত হয়। কিন্তু তার গানে নাকাব বা পর্দা বলা হয়েছে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক এখানে কি বলা হয়েছে। আবার ‘ফিরভি’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় নেতিবাচক কিছু বোঝানোর পর ইতিবাচক কিছু বোঝাতে। যেমন: একটি হিন্দি গানের কথা এমন: ‘‘আমরা প্রতারণা করলেও ‘ফিরভি’ মন হিন্দুস্তানী’’। বাংলায় ‘তবু’ এবং হিন্দি/উর্দু ‘ফিরভি’ একই ধরণের হলেও ‘ফিরভি’ শব্দটি সুনির্দিষ্টভাবেই নেতিবাচকের পর ইতিবাচক বাক্যে ব্যবহার হয়। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কোনটি নেতিবাচক?
২. পরবর্তি লাইনে বলা হয়েছে, রাব্বি জিদনি এলমা এলমা, মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহ।
রাব্বি জিদনি এলমা এলমা অর্থ: জ্ঞান আহরণ করো কারণ আল্লাহর জন্য জ্ঞান আহরণ করা ইবাদত। এ বাক্যের পর মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহ লিখে কোনো অর্থবোধক বাক্য তৈরি হয়েছে?
৩. গানের কথা: গফুরুসালামু সাদা হক, তবু রুহ করে ধক ধক
এর অর্থ কি গীতিকার জানে? ভারত ও পাকিস্তানে সামাজিক অধিকার আদায়ের জন্য যে শব্দটি ব্যবহৃত হয় সেটি পাঞ্জাবী শব্দ ‘সাড্ডা হক’ যার অর্থ আমাদের অধিকার। তাহলে ‘সাদা হক’ কি? গীতিকার রাজীব হোসাইন সম্ভবত কুখ্যাত প্রতারক হিসেবে পরিচিত মনসুর হাল্লাজের ‘আনাল হক’ তত্ত্ব এবং কবি ইরশাদ কামিলের ‘সাড্ডা হক’ এর মধ্যে কোনটি কি অর্থে ব্যবহৃত হয় তা না জানায় বিভ্রান্ত!
ইসলামের দৃষ্টিকোন থেকে মাস্ত কালান্দার
এ গান প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মুফতি আবদুল্লাহ বলেন, “শরীয়তের দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনা করলে, ‘দমে দমে মাস্ত কালান্দার’ গানটি সম্পূর্ণ কুফুরী একটি গান যেখানে শিরক সুস্পষ্ট। এ জাতীয় গান মানুষ অজ্ঞতার কারণে শুনে থাকে। কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে মানুষের মৃত্যুর পর বারযাখী জীবনের সাথে ইহকালের জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই। মৃতদের কাছে কোনো আহবান করা ইসলামে নিষিদ্ধ।”
মুফতি আরও বলেন, “জনাব শাহবাজ কেমন ছিলেন তা আমরা জানিনা। তিনি অলি হলেও আমাদের জন্য তাঁর করার কিছু নেই। তাই তার কাছে আহবানের প্রসঙ্গই অবান্তর। অনেকের মতে তিনি শিয়া মতাবলম্বী ছিলেন। শাহবাজ কালান্দারের মাজারে হজ্জ করার প্রথা চালু রয়েছে। এছাড়া বছরে একবার ‘মেহেদী রসম’ নামে একটি অনুষ্ঠান হয় যেখানে ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির জন্য পুরুষ ভক্তরা শাহবাজকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে। উক্ত মাজারে কাওয়ালরা কালান্দরকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে তার গুণকীর্তন করে গান তৈরি করে। তবে আসিফ আকবর মেহেদী রসম সম্পন্ন করুক বা না করুক এ গানের মাধ্যমে তিনি মুরতাদ হয়ে গেছেন।”
মুফতি বলেন, শিরক ও কুফুরির পরিণাম ‘দমা দম মাস্ত কালান্দার’ গানের সুরকার পাকিস্তানের আশিক হোসেন থেকে নেয়া যায়। সে এখন বিদ্যুৎহীন এক বস্তিতে বাস করেন এবং দুবেলা খাদ্যের সংস্থান হয় না তার।
ইসলামী শরীয়তগত বিষয় ছাড়া স্বাভাবিকভাবে বিবেচনা করলেই দেখা যায় সম্পূর্ণ গানটিতেই শব্দের অর্থ না জেনে একের পর এক শব্দ বসানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে একজন প্রখ্যাত গীতিকার বলেন, আসিফ বা রাজীবের শিক্ষাগত যোগ্যতা তেমন নেই। ছাত্রজীবনেও তারা শেষের কাতারের ছিল। তাই অশিক্ষার কারণে এমন উদ্ভট গান লিখছেন ও গেয়েছেন।
দমে দমে মাস্ত কালান্দারের নাম জপে এবং জোরে আলী বলে, তারপর যদি রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর নাম আসে তাহলে কাকে বেশি মহিমাময় হিসেবে উপস্থাপন করা হলো এ প্রশ্ন অমীমাংসিত রয়ে গেছে!