সকালের রোদ ঝলমলে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে একটি সামরিক জিপ ও পিকআপ এগিয়ে চলেছে। আগের রাতের বৃষ্টির প্রভাব লক্ষ্যনীয় সবুজ গাছপালায়। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ থেকে রওয়ানা হয়ে কাপ্তাই রোডের পাথরঘাটা এলাকায় পৌঁছতেই জীপে বসা মেজর মোজাফফর দেখতে পেলেন সামনে কিছুটা সমতল ভুমি। দুটি খেজুর গাছ দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে। চিহৃ হিসেবে গাছ দুটোকে পছন্দ হলো তার। ভাবলেন, ভবিষ্যতে এই গাছ দুটি স্বাক্ষী হয়ে থাকবে। অসুবিধা হবে না কবরের জায়গাটা চিনতে।
গাড়ি থেকে নেমে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে সিদ্বান্ত নিলেন এখানেই দাফন করবেন সাথে থাকা ৩ টি মরদেহ। পালন করবেন ধর্মীয় রীতিনীতি। স্থানীয় লোকজনের খোঁজে এগুতে থাকলেন অদূরে থাকা বসতির দিকে। এলাকাটি যদিও কিছুটা পুর্ব পরিচিত ছিলো তাও তাকে খুঁজতে হলো মসজিদ এবং ইমামকে। কিছু দূর যেতেই পেয়ে গেলেন স্থানীয় একটি মাদ্রাসা। সেখান থেকে নিয়ে এলেন একজন মৌলভী।
সাথে থাকা সৈনিকরা কবর খোড়ার কাজ শুরু করেছে আগেই। জানাজার ইমামতি করার জন্য নিয়ে আসা মৌলভীকে মেজর জানালেন, শান্তি বাহিনীর গুলিতে তাদের ৩ জন অফিসার নিহত হয়েছেন, দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। ইমামসহ স্থানীয় লোকজন ৩ টি মরদেহের গোসল পর্ব শেষ করলেন। বুলেটে ঝাঁজরা লাশগুলি দেখে কেউ চিনতেও পরালেন না ৩টি মরদেহের একটি যে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের। বড় করে খোড়া একটি কবরের মধ্যেই ৩ জনকে দাফন করা হলো, এক সঙ্গে। অনেকটা গণ কবরের মত করে।
মেজরের দায়িত্ব ছিলো চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ থেকে একটি মরদেহ নিয়ে যাওয়ার। সেটি অবশ্যই দাফনের জন্য নয়, গুম করে ফেলার জন্য। জেষ্ঠ কর্তা কর্ণেল মতিউরের নির্দেশ ছিলো, রাতে নিহত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মরদেহ রাঙ্গামাটির কাছে কোন পাহাড়ের নিচে ফেলে দিতে হবে যাতে কেউ খোঁজে না পায়। স্পষ্ট করেই নির্দেশ দিয়ে কর্ণেল আরো বলেছিলেন, জিয়াকে দাফন করে জাতীয় বীর বানানোর প্রয়োজন নেই। তবে মেজর নিয়ে গিয়েছিলেন আরো দু’জন সামরিক কর্মকর্তার মরদেহ, নিহত রাষ্ট্রপতির দেহের সাথে।
১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোর রাতে চট্রগ্রাম সার্কিট হাউজে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান খুন হন সামরিক বাহিনীর কয়েকজন বিদ্রোহী কর্মকর্তার হাতে। ৩ ভাগে ভাগ হয়ে প্রায় ১৬ জন কর্মকর্তা বৃষ্টি ভেজা রাতে অংশ নিয়েছিলেন অপারেশনে। হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযুক্ত মেজর মোজাফফর প্রথমে তার দাফনের ব্যবস্থা করেন, পাথরঘাটা নামক স্থানে। তার ৩ দিন পর সেখান থেকে তুলে এনে একটি মরদেহ ঢাকার সংসদ ভবনের চন্দ্রিমা উদ্যানে স্থানান্তর করা হয়। এ মরদেহটি আসলেই জিয়াউর রহমানের ছিলো কি না তা নিয়ে সন্দেহ ও বিতর্ক চলছে এখনো। যদিও ঢাকায় মরদেহটি পাঠানোর আগে চট্রগ্রাম সেনানিবাসে একজন মেজর শনাক্ত করেছিলেন বলে আলোচনা আছে, কিন্তু এর স্বপক্ষে জোরালো কোনো তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না।
জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে একমাত্র জীবিত আছেন মেজর মোজাফফর। ক্যু ব্যর্থ হওয়ার পর পালাতে গিয়ে পিঠে গুলিবিদ্ধের চিহৃ এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। আহত অবস্থায় কয়েকদিন পাহাড়ি এলাকায় কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হন দেশ থেকে। দীর্ঘদিন বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে বর্তমানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন উত্তর আমেরিকার একটি দেশে।
৯০ দশক এবং এক এগারোর পর মেজর মোজাফফর একাধিকবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। কথাও বলেছেন প্রোব বার্তা সংস্থার সাথে। ১৯৯৪ সালে প্রোবের সম্পাদক ইরতিজা নাসিম আলীর ‘রহস্যাবৃত জিয়া হত্যাকাণ্ড’ শিরোনামে ধারাবাহিক প্রতিবেদনেও মেজর মোজাফফরের সাক্ষাৎকার ছিলো। ওই দশকের উল্লেখযোগ্য সময় প্রোব’র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করার সুবাধে বেশ কয়েকবার মেজর মোজাফফরের সাথে আমার কথা হয়েছিলো। তার বক্তব্যে স্পষ্ট, তিনি জিয়াউর রহমানের লাশ চিনতে না পারলেও অনুমান করে নিয়ে গিয়েছিলেন।
মৃত্যুর প্রায় ৪ দশক পর জিয়াউর রহমানের মরদেহ আবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে। সূত্রপাত করেছিলেন সরকারী দলের কয়েকজন নেতা-মন্ত্রী। বিগত কয়েক বছর ধরেই এ বিষয়ে নানামুখি ও পরস্পর বিরোধী কথাবার্তা চলছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সম্প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন যে, চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের লাশ নেই। বিএনপির কাছে লাশের কোন ছবি থাকলে প্রকাশের দাবি জানিয়ে তিনি বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের পর লাশটি আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো।
জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি এ চ্যালেঞ্জের কোন জবাব দেয়নি। তবে সম্প্রতি বিএনপি নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেছেন, ‘জিয়াউর রহমানের লাশ গুম করতে চেয়েছিলেন এরশাদ। ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থেকে মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের লাশ নিয়ে এসেছিলেন চট্টগ্রাম সেনানিবাসে। মরহুম হান্নান শাহ’র স্মরন সভায় তার সাথে প্রথম পরিচয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে আব্দুল্লাহ আল নোমান এ কথা বলেছেন।’
৩০ মে সকালে জিয়াউর রহমানের লাশ সনাক্ত ও দাফন সম্পর্কিত বর্ণনা দিতে গিয়ে মেজর মোজাফফর বলেছিলেন, কর্ণেল মতিউরের নির্দেশে কয়েকজন সৈনিক নিয়ে সকাল ১০টার দিকে তিনি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে যান। দোতলায় ওঠার পথে দেখতে পান রক্তে ভেজা সিড়িতে পড়ে আছে কয়েকটি লাশ যাদের দেখে বোঝা যাচ্ছিলো তারা প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের সদস্য।
ধারণা করা হয়, আক্রমণের প্রথমেই এদের সবাই বুলেটবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন। দোতলায় গিয়ে দেখতে পান সিঁড়ির পাশের কক্ষের দরজা অর্ধেকটা খোলা অবস্থায়। সেখানে উপুর হয়ে পড়ে আছে একটি মরদেহ। রক্তে ভেসে যাওয়া কার্পেটের রং পাল্টে হয়ে গেছে কালো। দেহটিকে ঘুরিয়ে ধারণা করলেন মরদেহটি রাষ্ট্রপতিরই হবে। যদিও কক্ষটি রাষ্ট্রপতির জন্য বরাদ্দ ছিলো না।
চেহারা দেখে চেনার উপায় নেই। এসএমজির ম্যাগজিনে থাকা সমস্ত বুলেট জিয়াউর রহমানের চেহারা, মাথা ও বুক ঝাজরা করে দিয়েছে। একটু এগিয়ে বারান্দায় তাকিয়ে দেখতে পান অতি পরিচিত দুজন সামরিক কর্মকর্তার মরদেহ পড়ে আছে সেখানে। একজন লে. কর্নেল আহসান আর অন্যজন ক্যাপ্টেন হাফিজ।
মেজর মোজাফফর আবারো এগিয়ে গেলেন মরদেহের দিকে। মরদেহ আচ্ছাদনের কিছুই নেই হাতের কাছে। অগত্যা টান দিয়ে হাতে নিলেন বিছানার ছাদর। কয়েকজন সৈনিকের সহায়তায় ৩ টি মরদেহ চাদর দিয়ে জড়িয়ে, সেনাবাহিনীর গ্রাউন্ড সিট দিয়ে মুড়ে দিলেন। দোতলা থেকে ধরাধরি করে লাশগুলো নিচে নামিয়ে সৈনিকরা তুলে নিলো পিকআপে। সার্কিট হাউস থেকে বেড়িয়ে জিপ আর পিকআপ পৌছে গেলো পাথরঘাটার খেঁজুর গাছের তলে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, নিরাপত্তার কথা ভেবেই হয়তো রাষ্ট্রপতি তার জন্য বরাদ্দ কক্ষে না থেকে সিড়িঁর ডান দিকের কক্ষে রাত যাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আক্রমণ শুরুর পর প্রচণ্ড গুলাগুলির শব্দে দরজা ফাঁক করে বাইরে কি হচ্ছে দেখার চেষ্টা করেন তিনি। এতে অফিসারদের নজর পড়ে জিয়ার উপর। গর্জে উঠে হাতের আগ্নেয়াস্ত্র। মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন তিনি।
আব্দুল্লাহ আল নোমানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ জিয়াউর রহমানের মরদেহ রাঙ্গুনিয়া থেকে বহন করে নিয়ে এসেছেন চট্রগ্রাম সেনানিবাসে। প্রশ্ন হচ্ছে, হান্নান শাহ জীবদ্দশায় কখনো জোরালোভাবে এ দাবির স্বপক্ষে কিছু বলেছেন কি? তিনি কি আদৌ ৮১ সালের পহেলা জুলাই মরহুম রাষ্ট্রপতির লাশ দেখে চিনতে পেরেছিলেন? যদিও ২০১০ সাল থেকেই আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের লাশ নেই বলে দাবি করছিলেন। তাহলে হান্নান শাহ কেনো এ বিষয়েও স্পষ্ট কিছু বলেননি- এমন প্রশ্নও এখন আর করার সুযোগ নেই, তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
ওই সময়ে হান্নান শাহ’র ভুমিকা প্রসঙ্গে মেজর মোজাফফর জানান, বিএমএ কমান্ডেন্ট বিগ্রেডিয়ার হান্নান শাহ এবং বিগ্রেডিয়ার শাহজাহানসহ মোট ৪০ জন সামরিক অফিসার ৩০ মে সকালে চট্টগ্রাম ডিভিশনাল কমান্ডার মেজর জেনারেল মঞ্জুরের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সকলের সামনে দৃঢ় কণ্ঠে মঞ্জুর জানান, কিছু সেনা অফিসার প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যা করেছে। এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে অবশ্যই অফিসারদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ কাজ করেছে। সেনাবাহিনীর ভেতরে মুক্তিযোদ্ধা এবং অমুক্তিযোদ্ধাদের একটা দ্বন্দ্ব অনেকদিন থেকেই বিরাজ করছে। মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মাঝে জমে থাকা দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশই এ হত্যাকাণ্ডের অন্যতম প্রধান কারণ। ঘটনা যখন ঘটে গেছে তখন আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আপনারা আপনাদের মতামত নির্দ্বিধায় বলতে পারেন। উপস্থিত ৪০জন অফিসারই সমর্থন জানালেন হাত তুলে।
এ সময় হান্নান শাহ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন, আমাদের শুধু হাত তুলে সমর্থন জানালে চলবে না, শপথ নিতে হবে। নিজ উদ্যোগেই দপ্তরে রাখা কোরআন শরীফ নিয়ে এলেন তিনি। মেজর জেনারেল মঞ্জুরের সামনে পবিত্র কোরআন ছুঁয়ে শপথ নিলেন প্রথমে নিজে, তারপর করালেন একে একে সবাইকে। অথচ ক্যু প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর অন্যান্যদের পালানোর রোডম্যাপ গোপনে হান্নান শাহ জানিয়ে দেন ঢাকায়। তার দেয়া গোপন খবরের ভিত্তিতে পলাতকদের খোঁজে অভিযান পরিচালনা করেন মেজর মান্নান।
অন্যরকম আরেকটি তথ্য পাওয়া যায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বক্তব্যে। কয়েক বছর আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেছিলেন, এরশাদই জিয়ার লাশ নিজ কাঁধে বহন করেছেন। তিনিই পারেন এ বিতর্কের অবসান ঘটাতে। তবে এ বিষয়ে আরেক স্বৈরশাসক এরশাদ একেবারে চুপ। তিনি জীবদ্দশায় মুখ খুলেন না কখনো।
জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী হলেও তিনি দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা। তার মরদেহ নিয়ে এমন অস্বস্তিকর বিতর্কের অবসান সকলের কাম্য। এক্ষেত্রে করণীয় কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন কবর থেকে দেহাবশেষ নিয়ে ডিএনএ পরীক্ষাই এখন একমাত্র সামাধান। আর সরকারই এ উদ্যোগ নিতে পারে।
কবরে বা মাটির নিচে থাকা দেহাবশেষের ডিএনএ পরীক্ষায় ফল পাওয়া যায় হাজার বছর পরেও। ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড তৃতীয়’র দেহাবশেষের ডিএনএ’র ফল তা প্রমাণ করেছে। ২০১২ সালে লেস্টারশায়ারের একটি পার্কিং এলাকায় ৫৩০ বছরের পুরনো দেহাবশেষ পাওয়া গেলে পৃথিবী জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা ডিএনএ পরিক্ষা করে জানান, দেহাবশেষটি ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় রিচার্ডের, যিনি নিহত হয়েছিলেন ১৪৮৫ সালে যুদ্ধের ময়দানে। সৎকারের আগে ৩ দিন তার লাশ ঝুলিয়ে রেখেছিলো শত্রুরা। ২০১২ সালে পাওয়া দেহাবশেষের ডিএনএ পরিক্ষায় নিশ্চিত হওয়ার পর ২০১৫ সালের মার্চে রাজাকে পুনরায় রাজকীয়ভাবে সমাধিস্থ করা হয়।
লেখক: জসীম আহমেদ, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা