আবার পদ্মা সেতুর ১০ নম্বর পিলারে ফেরির ধাক্কা লেগেছে! এ নিয়ে একই পিলারে একাধিকবার ধাক্কার ঘটনা ঘটল। অন্যান্য পিলারেও এরূপ ধাক্কার ঘটনা আছে। সব মিলিয়ে ইতোমধ্যে কম হলেও পদ্মা সেতুর চারটি ধাক্কা খাওয়া শেষ শেষ!। কিছুদিন আগে ১৭ নম্বর পিলারে অন্য একটি ফেরির ধাক্কায় আহত হয়েছিল ফেরির অর্ধশত যাত্রী। এবার টেলিভিশনে দেখা গেল ১০ নম্বর পিলারের সামান্য কিছু অংশ ভেঙেও গেছে। সার্বিকভাবে এ ধাক্কায় সেতুর কোনো ক্ষতি হয়নি বলে সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। কিন্তু প্রকৌশলীদের আশ্বাসে আমরা আশ্বস্ত হতে গেলেও মনের গভীরে কোথাও এক ধরনের খোঁচা লাগে! আসলে পদ্মা সেতুর পিলারে ধাক্কা লাগলে পিলারের চেয়ে আমরাও কম আহত বোধ করি না। ধাক্কার ঘটনায় আমরা উপর্যুপরি কেবল আহত হয়েই চলেছি!
এরূপ ঘটনায় আহত হতেই হয়। কেননা, পদ্মা সেতু তো কেবল একটি সেতু মাত্র নয়! এটি আমাদের স্বপ্নের সেতু। এটি শেখ হাসিনার সম্মানের সেতু, বাঙালির সম্মানের সেতু! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের ফসল আমাদের পদ্মা সেতু। বিশ্ব ব্যাংকের গভীর ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও সমুন্নত রাখার সেতু পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু আমাদের আবেগ, অহংকার এবং গৌরব। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিতব্য পদ্মা সেতুর প্রতি তাই আমাদের অনুভবজাত মমতাও অতলস্পর্শী।
যখন শুনি পদ্মা সেতুর পিলারে কোনো ফেরির ধাক্কা লেগেছে তখন সে ধাক্কাটি আসলে যেন আমাদের গায়ে এসে লাগে, হৃদয়েও এসে লাগে। আমরা ব্যথিত, বিমর্ষ ও চিন্তিত হয়ে পড়ি! প্রকৌশলীরা যদিও বলেন অনেক ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা শক্তি পদ্মা সেতুর পিলারগুলোর রয়েছে তবু ধাক্কা মানেই ধাক্কা! আর ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা থাকলেই কি বারবার অহেতুক ও অযাচিত ধাক্কা খেয়ে খেয়ে উদ্বোধনের আগেই ক্ষতবিক্ষত হবে আমাদের সকলের স্বপ্নের এই সেতুকে? ধাক্কা খাওয়াই সেতুটির বিধিলিপি হয়ে দাঁড়াবে তা আমরা কখনো কোনোভাবেই সমর্থন করি না।
একের পর এক এমন অযাচিত ধাক্কা খেতে খেতে পদ্মা সেতুর যেন নাজেহাল অবস্থা না হয় সেজন্য সেতুর নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কঠোর হবেন এটাই জাতির আপামর মানুষের প্রত্যাশা এবং দাবি। আগস্ট মাস চলছে। এ মাস শোকের মাস। অন্তহীন শোক বাঙালির হৃদয় জুড়ে। এমন শোকের মধ্যে পদ্মা সেতুর পিলারে কোনো ফেরির ধাক্কা লাগার খবরে আমরা শংকিত ও আতকিংত হয়ে পড়ি।
পদ্মা সেতুতে ফেরির ধাক্কার মতোই আমাদেরকে সামাজিক নানা রকমের ধাক্কা খেতে খেতে জীবনযাপন করতে হচ্ছে! প্রাত্যহিক জীবনে এমন সব ঘটনা চারিদিকে ঘটছে যার মধ্যে প্রথমত হাস্যরস থাকলেও পরিণতিতে করুণ রসের আধারে আমাদেরকে নিমজ্জিত করে- আমরা ভীষণভাবে ধাক্কা খাই! তাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মাঝেমধ্যে ভাবি এসব নৈমিত্তিক ঘটনা দেখে হাসবো না কাঁদবো! নিজের কাছে কোনো সদুত্তর নেই। মহামারিকালে সাধারণের স্বাস্থ্য-সচেতনতা নিয়ে হাসি-কান্নার এমন দোলাচল সর্বক্ষণই আমাদের ব্যস্ত রাখে। টেলিভিশন কিংবা অনলাইন পত্রপত্রিকাসহ যে কোনো গণমাধ্যমে চোখ পড়লেই আমরা নিত্যদিন একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই।
স্বাস্থ্যবিধি ভঙের বিচিত্র কৌশল ও অজুহাত দেখে মানুষের অদ্ভুত সৃজনশীলতার পরিচয় পেয়েও আমরা অনেক সময় হতভম্ব হয়ে পড়ি! আবার, স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনার চিত্র দেখেও নতুন কোনো আশাব্যঞ্জক উদ্দীপনা আমরা লাভ করতে পারি না। সেখানেও তথৈবচ অবস্থা দেখে মাঝেমাঝে হাসবো না কাঁদবো সেই এক নাটকীয় দ্বন্দ্বে পড়ে যাই। সাম্প্রতিককালের সর্বাধিক আলোচিত বিষয় করোনার ভ্যাকসিন বা টিকা। করোনার টিকা প্রদান ব্যবস্থাপনার চিত্রেও আমরা হ-য-ব-র-ল অবস্থাই দেখি।
একই ব্যক্তিকে একই টিকা দান কেন্দ্রে পাঁচ থেকে দশ মিনিটের ব্যবধানে একাধিক ভ্যাকসিন প্রদানের খবর আমাদের চমকে দেয়, আমাদের অন্তরে ধাক্কা লাগে! এরূপ ঘটনায়ও আমরা হাসবো না কাঁদবো ভেবে পাই না। ভেবে যে পাই না তা নয়- কিন্তু কী ভাববো! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভ্যাকসিন প্রটোকল এ বিষয়টি মোটেই অনুমোদন করে না। তবু আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের বে-খেয়াল মনোভাব কিংবা সাধারণ মানুষের বোঝার ভুলে এরূপ ঘটনা ঘটছে বলে মেন নিই ঠিকই কিন্তু ‘মনে’ নিতে পারি না! কোনো একটি টিকাদান কেন্দ্রে এরূপ একটি দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু এই খবর গণমাধ্যমে আসার পরবর্তী একাধিক দিন একাধিক টিকাদান কেন্দ্রে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কি তাহলে গণমাধ্যমের প্রভাব? ‘খবর’ হওয়ার বাসনা না অন্য কিছু তাও ভেবে পাই না। কারণ, এরূপ একটি দুর্ঘটনা ঘটার পর বিভিন্ন স্থানে একের পর এক অনুরূপ ঘটনাই ঘটেই চলে! ঘটনার প্রকৃতি ও কার্যকারণ সর্বত্রই একই রকমের।
কুষ্টিয়ায় সর্বপ্রথম দেখা গেছে একজন নারী এক হাতে ভ্যাকসিন গ্রহণের পর অন্য হাত দিয়ে ভ্যাকসিনের স্থানটি ধরে আছেন এমন সময় আরেক স্বাস্থ্যকর্মী তার অন্য হাতে আরেকটি টিকা ঢুকিয়ে ফেলেন! আমাদের জানা মতে কুষ্টিয়ায় এ ঘটনার সূত্রপাত হলো গণটিকা কর্মসূচি চলাকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী পুরুষ নির্বিশেষে বেশ কয়েক জনকে একই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হয়েছে। এক সপ্তাহে দেশের অন্তত চার থেকে পাঁচটি স্থানে এরূপ ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত ১২ আগস্ট গোপালগঞ্জে এরূপ একটি ঘটনা ঘটেছে বলে গণমাধ্যম সূত্রে আমরা অবগত হয়েছি।
‘ডাবল ডোজ’ ফেনোমেনার পর আরেকটি মারাত্মক ইস্যুও আমরা গণমাধ্যমের বরাতে অবগত হয়েছি। সেখানে ভ্যাকসিন ছাড়াই কেবল শূন্য সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে টিকা কার্যক্রম সম্পন্ন করার দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যকর্মী। টাঙ্গাইলে এ ঘটনার সূত্রপাত এবং গণমাধ্যমে চাওর হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে এরূপ ঘটনারও পুনরাবৃত্তি শুরু হতে থাকে। টাঙ্গাইলে তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন হলে ঘটনার সত্যতা জানা গেছে। কিন্তু অল্প দিনের ব্যবধানে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা পাবনাতেও লক্ষ করি! তাই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে একি মিডিয়ার প্রভাব না কি স্বাস্থ্যকর্মীদের অবহেলা, ক্লান্তি, বিরক্তি না অন্য কিছু? এসব দুর্ঘটনা আমাদেরকে সত্যিই কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয়! আমরা হাসবো না কাঁদবো ভেবে পাই না। এমন ধাক্কা সামলানো সত্যি কঠিন!
ভ্যাকসিন প্রদান বিষয়ক ঘটনার নাটকীয়তা দেখা যায় চট্টগ্রামে। সেখানে জনৈক ব্যক্তি বাড়িতে বসে ভ্যাকসিন গ্রহণ শেষে ফেইসবুকে ছবি আপলোড করলে তা ব্যাপক ভাইরাল ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়। কী করে তিনি বাসায় বসে ভ্যাকসিন গ্রহণ করলেন সমগ্র জাতির কাছে তা বিস্ময়ের বিষয়ে পরিণত হয়! এতে সাধারণ মানুষের মনেও ধাক্কা লাগে! পরবর্তী সময়ে এ ঘটনার সাথে জড়িতদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অধীনে আনা হয়। এরূপ খবর শেষ হতে না হতেই রাজশাহীর তানোর উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেবও অনুরূপ ঘটনার জন্ম দিয়েছেন এবং গণমাধ্যমে বিখ্যাতও হয়েছেন।
সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে নির্দিষ্ট কেন্দ্রে গিয়ে ভ্যাকসিন গ্রহণের কথা- এটাই নিয়ম। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে আমরা বিভিন্ন মন্ত্রী এমপিসহ বড় বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং সরকারি আমলাদেরকে ভ্যাকসিন গ্রহণ করতে দেখেছি। কিন্তু দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এক শ্রেণির নেতা বা চেয়ারম্যানরা স্থানীয় দাপট দেখিয়ে নিজের বাসায় বসে টিকা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে আসলে সরকারের ভাবমূর্তিকে ভূলুণ্ঠিত করেছেন। তাদের এ আচরণ দৃষ্টে গ্রামীণ সেই প্রবাদের কথা মনে পড়ে যায়- ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়’।
এরূপ ঘটনা সর্বসাধারণের মধ্যে মনস্ত্বাত্তিক বিপর্যস্ততাও তৈরি করে, মানুষকে হতাশ করে। ঘটনা ‘বিচ্ছিন্ন’ হলেও এক শ্রেণির নেতাকর্মীর রাজনৈতিক ক্ষমতার এরূপ দাপট প্রদর্শন সরকারকেও বিব্রত করে। করোনার টিকা নিয়ে এসব ‘টিকাকৃতি’র দ্রুত অবসান হওয়া উচিৎ। আবার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকেও টিকা নিয়ে অহেতুক কৃতিত্ব দেখানোর বদলে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণে মনোযোগ বাড়াতে হবে। গণটিকার নামে গণদুর্ভোগ ও গণভোগান্তি নিরসনে মনোযোগ নিবদ্ধ করতে হবে। আমাদের দেশের লোকসংখ্যা, লোকচাহিদা এবং তার বিপরীতে টিকার মজুদ প্রভৃতি বিষয় সূক্ষভাবে বিবেচনায় নিয়ে গণটিকার জন্য ‘টার্গেট পিপল’ নির্ধারণের মাধ্যমে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। ২০০ টিকা প্রদানের জন্য দুই হাজারের বেশি মানুষকে ভিড়ের মধ্যে ঠেলে দেওয়া কোভিড নিয়ন্ত্রণে বিজ্ঞান সম্মত পদক্ষেপ নয়। বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাপ্রসূত উদ্যোগ নিয়ে গণভোগান্তি সৃষ্টি না করে সুশৃঙ্খলভাবে ভ্যাকসিন প্রদানও কোভিড সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়- বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তার আলোকেই গাদাগাদি ও গণজমায়েত প্রতিহত করতে হবে। ধাক্কা-ধাক্কি করে করোনার ভ্যাকসিন প্রদান ও গ্রহণ উভয়ই অবৈজ্ঞানিক উপরন্তু তা স্বাস্থ্যবিধিকেও ‘ধাক্কা’ মেরে দূরে ঠেলে দেয়। স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যবিধির সুরক্ষা দেখতে চাই।
লেখক : ড. আহমেদ আমিনুল ইসলাম, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।