বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের নিজস্ব মোবাইল অ্যাপ উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর এটি উদ্বোধন করা হয়। অ্যাপটি ব্যবহার করে যাত্রীরা নিজ মোবাইলের মাধ্যমেই বিমানের সব গন্তব্যের টিকিট কিনতে পারতেন। বিমানের অনলাইন সার্ভিস বন্ধ ১০ আগস্ট থেকে। এতে বেড়ে গেছে যাত্রী ভোগান্তি। ফলে অন্য এয়ারলাইন্সের দিকে ঝুঁকছে। এখন চলছে একই প্রতিষ্ঠানকে তিনটি কাজ দেওয়ার চেষ্টা। অভিযোগ আছে, এতে বিমানের খরচ বাড়বে; কমতে পারে স্বচ্ছতাও।
বিমানের অনলাইনের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চেষ্টা করেও টিকিট ক্রয় ও ফেরতসংক্রান্ত সেবা থেকে বঞ্চিত যাত্রী ও ট্রাভেল এজেন্টরা। হঠাৎ করে এ রকম সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভোগান্তি প্রকট আকার ধারণ করেছে। তাই নতুন প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী বোর্ডসভায় নতুন প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করা হতে পারে।
বিমানের মার্কেটিং বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে বিমান মোবাইল অ্যাপসহ অনলাইন সেবায় পূর্ণাঙ্গরূপ দিতে পারবে। তার আগে আংশিক বা খণ্ডিত আকারে এ সেবা চালুর চিন্তা রয়েছে। সে অনুযায়ী কাজ করছে।
এর আগে বিমানের বকেয়া বিল পরিশোধ না করায় অ্যামাজন ওয়েব সার্ভার তাদের সার্ভার কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত করেছে। ফলে বন্ধ মোবাইল অ্যাপ। একই কারণে অনলাইন প্যাকেজ সেবা ‘বিমান হলিডেজ’ বন্ধ হয়ে গেছে। অনলাইন টিকিট বিক্রি সার্ভার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বিমান কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগে অনলাইন প্যাকেজ বন্ধ করে দিয়েছে। এতে বিমানের টিকিট বিক্রি যেমন কমেছে, তেমনি ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। এ ঘটনায় বিমান কর্তৃপক্ষ দুষছে অনলাইন প্ল্যাটফরমে টিকিট বিক্রি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রাভেল শপ লিমিটেডকে। অন্যদিকে ট্রাভেল শপের দাবি, সার্ভারের ভাড়া বিমান পরিশোধ না করায় বন্ধ হয়েছে সেবা।
বিমানসংশ্লিষ্টরা জানান, সার্ভারের নিয়ন্ত্রণ বিমানের হাতে নেই। তাই ভাড়া বকেয়াকে কেন্দ্র করে বিমানের অনলাইন সেবাসহ অ্যাপস সার্ভিস বন্ধ হয়ে গেছে। একাধিক কর্মকর্তা জানান, গত বছর ট্রাভেল শপ নামের প্রতিষ্ঠানটি সার্ভারের জন্য ভাড়ার বিল চেয়ে বিমানের কাছে চিঠি দিয়েছিল। সার্ভারের ভাড়াসংক্রান্ত বিষয় চুক্তিতে না থাকায় বিমান তাদের দাবি মানতে অপারগতা প্রকাশ করে। এখন ট্রাভেল শপের বিরুদ্ধে আইনগত কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় তা খতিয়ে দেখছে সংস্থাটি।
বলে রাখা ভালো, অনলাইন এবং অ্যাপের মাধ্যমে যাত্রীরা ফ্লাইট সম্পর্কিত সব তথ্য, ফ্লাইট স্ট্যাটাস, ফ্লাইট শিডিউল, সেলস সেন্টারগুলোর ঠিকানা, অনলাইন টিকিট ও রিফান্ড হেল্পডেস্ক এবং টিকিট বুকিং, সিট নির্ধারণসহ সব কিছু করতে ও জানতে পারতেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রায় ১০ বছর আগে বিমানের অনলাইন কার্যক্রম চালু করা হয় জ্যাপওয়েজ নামক একটি কোম্পানির হাত ধরে। সফটওয়্যারের ত্রুটির কারণে টিকিট ফেরত দেওয়া যেত না, চালানো যেত না মোবাইল অ্যাপস। ২০১৯ সালে মে মাসে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এ চুক্তিটি বাতিল করা হয়। এর পর কাজ পায় ট্রাভেল শপ। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৯ সালের অক্টোবরে বিমানের মোবাইল অ্যাপস বাজারজাত করে ও ২০২০ সালে ফেব্রুয়ারিতে জ্যাপওয়েজকে প্রতিস্থাপন করে। বলে রাখা ভালো, ২০২১ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত অনলাইনে বিক্রির পরিমাণ প্রায় ১২৫ কোটি টাকা এবং টিকিটের সংখ্যা এক লাখ ১২ হাজার ৪২৭। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে প্রায় নির্ভুলভাবে বিমানের সব অনলাইন পরিসেবা চালু হয়।
সূত্রমতে, বর্তমানে একই কোম্পানিকে প্যাসেঞ্জার সার্ভিস সিস্টেম (পিএসএস), গ্লোবাল ডিসট্রিবিউশন সিস্টেম (জিডিএস) এবং ই-কমার্সের দায়িত্ব দেওয়ার চেষ্টা চলছে। সাধারণত অন্যান্য এয়ারলাইন্স যে কোম্পানিকে জিডিএসের কাজ দেয় তাকে পিএসএস বা ই-কমার্সের কাজ দেয় না। এর কারণ মনোপলি ঠেকানো। তা ছাড়া করোনাকাল শুরুর পর থেকে এয়ারলাইন্সগুলো ই-কমার্সের প্রচার করছে। চেষ্টা করছে জিডিএস থেকে সরে আসার। অথচ বিমান জিডিএস কোম্পানিকে পিএসএস ও ই-কমার্স তৈরির কাজ দিচ্ছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, জিডিএস থেকে কোনো টিকিট ইস্যু হলে ওই কোম্পানি পাবে ২০ ডলার এবং ই-কমার্স থেকে টিকিট হলে সে ক্ষেত্রে পাবে ১.৫ ডলার। এ ক্ষেত্রে ওই কোম্পানিটি জিডিএস এরই প্রমোট করবে এমন আশঙ্কা থাকে।
অন্য একটি সূত্র বলছে, বিদ্যমান সার্ভিস প্রোভাইডার তাদের সফটওয়্যার বানাতে খরচ নেয়নি। বিমানের দুজন কর্মকর্তার মাধ্যমে এর খরচ ভাগাভাগি করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি রাজি না হওয়ায় ওই কর্মকর্তারা এখন বিকল্প চিন্তা করছে। এর জেরে ওয়েব সার্ভারের বিল না দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে একটি প্রতিষ্ঠান।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, অন্য এয়ারলাইন্স যেখানে বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যয় কমিয়ে আনতে জিডিএস নির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব প্রতিষ্ঠিত ওয়েবসাইটকে আরও উন্নতকরণ ও বিক্রি বাড়ানোর দিকে নজর দিয়েছে। সেখানে বিমান নতুন করে ই-কমার্স সাইট তৈরি করার চেষ্টা করছে। বিদ্যমান অনলাইন প্ল্যাটফরম থাকা সত্ত্বেও জিডিএসের প্রতি সেগমেন্টে ৭ থেকে ১৪ ডলার পাইয়ে দেওয়ার পেছনেও আছেন দুজন কর্মকর্তা। অথচ অনলাইনে বিক্রি বাড়ালে জিডিএসের খরচ সাশ্রয় হতো। এ ছাড়া বিমানের অনলাইন ই-কমার্স, লয়েলটি প্রোগ্রাম, ট্যাপ, অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি, করপোরেট এবং অন্যান্য ডিজিটাল ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেলের মাধ্যমে টিকিট ও অন্যান্য পরিসেবার কোনো প্রচার বা ডিজিটাল প্রমোশন না করে ম্যানুয়েল টিকিট ইস্যু এবং জিডিএসের মাধ্যমে টিকিট ইস্যু করার প্রতি জোর দেয় বিমান। এতে কিছু ব্যক্তির ব্যক্তিগত মুনাফা হলেও বিমানের লোকসানের পরিমাণ বাড়ে।
এদিকে দেশের বাজারে ট্রাভেল এজেন্সিকে সরাসরি অনলাইনে আকৃষ্ট করতে বিদেশি এয়ারলাইন্সসহ দেশি দুটি বেসরকারি এয়ারলাইন্স এপিআই, হোয়াইট লেভেল এবং হলিডের মাধ্যমে টিকিট বিক্রির প্রচার করছে এবং জিডিএসকে পরিত্যাগ করার লক্ষ্যে বাজারে ওটিএকে সরাসরি ১০ শতাংশ থেকে শুরু করে অতিরিক্ত ছাড় দিয়ে ইনসেনটিভ প্রোগ্রাম ঘোষণা করছে। অথচ বিমান ম্যানুয়াল টিকিট ইস্যু-রিইস্যু রিফান্ডের ব্যবস্থা বহাল রাখতে চায় কিছু ব্যক্তির অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনে সুযোগ দিতে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের উপ-মহাব্যবস্থাপক তাহেরা খন্দকার সম্প্রতি জানান, পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে সাময়িকভাবে অনলাইন প্ল্যাটফরমের টিকিট বিক্রির দায়িত্ব দেওয়া হয় একটি প্রতিষ্ঠানকে। প্রতিষ্ঠানটি বিমানের প্রত্যাশিত কার্যক্রম সম্পূর্ণ বাস্তবায়নে বিভিন্ন ধাপে বারবার ব্যর্থ হয়। অবশেষে ১০ আগস্ট থেকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অনৈতিকভাবে বিমানকে সংশ্লিষ্ট সেবা প্রদানে বিরত হয়। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বিশ্ব স্বীকৃত সার্ভিস প্রোভাইডারের মাধ্যমে শিগগিরই উন্নত অনলাইন সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে যাচ্ছে। দেশি-বিদেশি সেলস অফিস, অনুমোদিত ট্রাভেল এজেন্সি ও বিমান কল সেন্টারের মাধ্যমে সব রুটের টিকিট ক্রয়, পরিবর্তন ও ফেরত দিতে চলমান প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।
জানা গেছে, বিমানের স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অত্যাধুনিক অনলাইন টিকিট বুকিং ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে কাউন্টার থেকে টিকিট বিক্রির পুরনো ব্যবস্থা চালু রাখার সঙ্গে যুক্ত একটি চক্রের কারসাজিতে অনেকটা পরিকল্পিতভাবে অনলাইন ব্যবস্থাকে সাময়িকভাবে বন্ধের মতো জটিলতার মুখে ঠেলে দেওয়া হয়। আগের প্রতিষ্ঠান জ্যাপওয়েজকে প্রতিমাসে ব্যবস্থাপনা বাবদ প্রায় ২৩ লাখ টাকা এবং নতুন কোনো কিছু হালনাগাদ হলে আরও প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ করা হতো। এ সংস্থাটি বিমানের টিকিট বিক্রিসংক্রান্ত তথ্য এবং আর্থিক হিসাবও সঠিকভাবে রাখতে পারছিল না। এ যুক্তি দেখিয়ে ২০১৯ সালের মে মাসে জ্যাপওয়েজেরে সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে ট্রাভেল শপের সঙ্গে চুক্তি করেছিল বিমান।