শামীম আজাদ: ছোটবেলা দৌড়ের উপর থাকতাম অথচ স্পোর্টস এর মাঠে গিয়ে হিটেও টিকতাম না। নাচতাম, নাটক দল পারাপার করতাম, আবৃত্তি করতাম কিন্তু খেলার মাঠে হাই জাম্প দিলে সেটাই হতো সবার চেয়ে ল। বর্শা ছুড়লে কোদাল কোপানোর দূরত্বে গিয়ে পড়তো। এই বেদনার ফোকড় গলে আমি আমার যে যে বন্ধুরা খুব স্পোর্টি ছিল হয়ে উঠলাম তাদের আঠা, তাদের পার্সোনাল এ্যসিস্ট্যান্ট, তাদের চিয়ার গার্ল। বাংলার সহপাঠিনী সালমা, পরে সালমা রফিক, ও ক্রীড়া বিচিত্রার সম্পাদক হয়েছিল। অত্যন্ত পেটা দেহী, শ্যামলা ও সতেজ। আমাদের ক্লাশে সেই একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাথলিট। ওর কাছে আমি আর বাবলি শান্তিনিকেতনী ব্যাগ ঝুলানো শুধুই কবিতা। মাঠের কাজে তাই আমরা তারই টেন্ডল। ওদের খেলা থাকলেই বাংলা একাডেমির লাইব্রেরী বাদ দিয়ে সোজা টিএসসির মাঠে হাজির হয়ে যাই। রিলে রেইসে সালমা-খুকী পার্টনার।
খুকীর অন্যনাম সুলতানা। খুকী মাঠে নামলে সূর্যের সোনালী আলো হয়ে যায় ছুরি। আমি এর আগে এমন শর্টস পরা স্পোর্টস তারকা দেখিনি। ওর সুস্বাস্থ্য যেন সুপক্ক যব। সে সঙ্গে হাশেম খানের আঁকা চারকোল চোখ, চলায় শাহাবুদ্দিনের তুলির বেগ ও মাঠে অলিম্পিকের ফুলকি দেখে আমি একেবারে ব্যা ব্যা ব্ল্যাকশিপ। খুকীর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে ফিরলে বুকে সাহসের উৎসমুখ খুলে যেত। এমনকি এই ব্যা ও রোকেয়া হলের সামনে অকারনে দাঁড়ানো এবং মেয়েদের নিয়ে মন্তব্য করা এক রিক্সাওলাকে হা হা করে তেড়ে গেল একাই। বুঝুন খুকীর উঞ্জিবনী স্পিরিট! মনে পড়ে রোকেয়া হলের র্যাগ ডে’তে কোথা থেকে এক ডাস্টবিন জোগাড় করে, মাথায় গামছা বেঁধে, সারাগায়ে রঙ ছোপ্ ছোপ্ অবস্থায় এমন পিটালো যে কি আর বলবো। টিম লিডার জানুও তাকে থামাতে পারলো না।
সে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষিপ্র নারী স্প্রিন্টার। সব মিলে সে এক অসীম তারকালোক। মাঠে নেমে ওয়ার্মিং আপ থেকেই তাবৎ ছেলেদের চোখ তারদিকে গাঁথা থাকতো। এ অসামান্যার জন্য যেখানে দেবতা মানুষ হয়ে যায় সেখানে তখনো বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট পুত্র না হওয়া সহপাঠী শেখ কামালতো কোন ব্যাপারই না।
ওর সঙ্গে জিমনেসিয়ামের স্কেটিং রুমে ফ্লোর থেকে আছাড় খেয়ে উঠে দাঁড়াবার সময় এর কৌশলের কথায় আমার আলাপ। পরে দেখি সে আমার বন্ধু বাবলীর স্কুলের সাথী। আর রুমমেট শ্রাবনীর সাবসিডিয়ারী রাষ্ট্র বিজ্ঞানের বন্ধু। আমার যেমন বাবলি, খুকীর তেমনি ফনু, ঝোরা। কামাল, খুকী, ফনু সবাই স্যোসিওলজিতে অনার্স করছে। আমি আর বাবলি বাংলায়। কিন্তু আমাদের দুজনের ইংরাজী সাবসিডিয়ারী বিধায় ওখানে ওদের অনেক বন্ধুদের সঙ্গে পড়া, সবাই মিলে আড্ডা-এসব আরকি। খেলা হলেই আমাদের সবকটা মিলে একাকার।
আমাদের দিনগুলো চলে যেতে লাগলো যেন ওরাংওটাং। সন্ধ্যার আগে অবধি প্রভোস্ট বেগম আখতার ইমামের গাড়ির হর্ণ শোনার আগে পর্যন্ত রোকেয়া হলের বাইরে আর সন্ধ্যার পর হলের ভেতর মেইন বিল্ডিং এর খোলা নিচ তলায় পাবলিক টেলিফোনের কিনারে। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলের বাইরে থাকলেও কোন না কোন আবাসিক হলের সঙ্গে যুক্ত হতে হত। খুকীর ছিল রোকেয়া হল। আমাদের ২য় বর্ষের পরীক্ষার আগেই মাঠে ওর উজ্জ্বল উপস্থিতি ও অর্জনের জন্য সে হয়ে গেল ইউনিভার্সিটি ব্লু। সে এক ময়ূরকন্ঠী নীল। ওর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ কোন এমন প্রতিভাময়ী পায়নি।
এসময় আমাদের দেশের ওপর চেপে পড়ল ‘দারুন একাত্তর’। আমাদের ছাত্রজীবনের সুখ ছানামাথা ময়দা করে দিয়ে নাই নিস্তিগার করে দিল। যুদ্ধের পর কেউ ফিরে এল আর কেউ এলোনা। যারা এই ভয়াবহ যুদ্ধ থেকে ফিরে এলো কেউ আর স্বাভাবিক ছিল না। থাকার কথাও না। আর আমাদের দেশে যুদ্ধফেরতদের জন্য ছিল না কোন কাউন্সেলিং কোন মানসিক সাপোর্ট। তাই যে যার মত ডাকু, বেকুব, উন্মাদ হয়ে গেল। কেউ কেউ পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে আর এক টেবিলে বসে রুটি-আলুভাজি খেতে বসতে না পেরে আত্মহত্যা করলো।
সেই এলোমেলো অবস্থায় ভরা কলসী কন্যা নিয়ে দিশেহারা অভিভাবকের মধ্যে আমার বাবা-মাও ছিলেন। বিয়ের আলাপ ও প্রলাপের ভয়াবহ চাপে দ্রুত বিলেত ফেরত এক ‘ভালো ছেলে’র সঙ্গে আমার বিয়ে দিলেন। এ সময় শুধু আমার না একে একে দেউটি নিবে যেতে লাগলো। সবাই জোড়া হতে থাকলো। ঈশিতাকে পেটে নিয়ে কোনক্রমে সাবসিডিয়ারী দিলাম। যারা ছিল একা তারা ক্লাশের বন্ধুদের সঙ্গে প্রেমে সিরিয়াস হয়ে উঠলো। ডলি-ইউসুফ, বেবী-ববির, তান্না-তাবাসসুম, ডেইজী-শামিম… শ্রাবণী গেল আরেকটু পা বাড়িয়ে বুয়েটের দিকে আর ওর কাছেই শুনলাম খুকী-কামাল জুটে যাচ্ছে। কারণ, অনেকটা পরিবারের চাপ, অনেকটা বন্ধুবিহীন বাঁচেনা পরানের কারণে। অনার্সের পর এরা অনেকেই স্বামী-স্ত্রী হয়ে গেল।
আমি কিভাবে যেন ঘষ্টাতে ঘষ্টাতে অনার্স শেষে ছোট্ট পুটলী ঈশিতামনিকে নিয়েই মাস্টার্সে টিকে আছি। থাকি ধানমন্ডি স্পোর্টস কমপ্লেক্সের একেবারে কাছে। সোবানবাগে এখন মা’দের ২/সি ফ্ল্যাটের নিচে। আমার সন্তপ্রায় মেঝ মামা আলী মেহেদী খানও থাকেন ওখানে। প্রায়ই বত্রিশ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাড়ি পেরিয়ে যাই। হায়রে বাংলার হায়নাদেরই তাঁর আজীবন বিশ্বাস। যেভাবে তাজুদ্দিনকে রেখে বিশ্বাস রেখেছিলেন সাধারণ মিরজাফর মুশতাকে- তেমনি বিশ্বাস রেখেছিলেন দেশের প্রতিটি মানুষে, বাতাসে, ধূলোকনায়। কে তাকে বলবে যে “আমি ভালবাসি যারে সেকি কভূ আমা হতে দূরে যেতে পারে”এসব জাতীয় ব্যাপার বাঙালির না।
আজব, একটা প্রেসিডেন্টের বাড়ি অথচ যে কেউ সামনে দিয়ে চলে যেতে পারে। মেঝ মামা আলী মেহেদী খান তিনি ডিএসপি এবং দিনের বেলার পুলিশ বিভাগের সাদা পুলিশ। বঙ্গন্ধুর গাড়ির সামনে ড্রাইভারের সামনে বসে থাকেন। দিন শেষে সোবানবাগ ফিরে গ্যারাজের পেছনে সব্জি করেন, তেলাওয়াত করেন, ঘুমের আগে তার কাঠের চৌকির একদিকে পা উপরে দিয়ে বই পড়েন। শুনেছি বঙ্গবন্ধু তাকে ‘আপনি’ ও খান সাহেব ছাড়া কথা বলতেন না।
যাক যা বলছিলাম। বন্ধুদের কান কথার মধ্যেই ঠিক পরীক্ষার আগে পাবলিক লাইব্রেরীর শ্যাওলা মাখা সাইকেল স্ট্যান্ড দেখি খুকীর হাতে বেগম ফজিলুতুন্নেসার দেয়া গল্পশোনা সেই মহা ওজনদার চকচকে বালাজোড়া। বোধকরি হরিণীর পা আটকা পড়েছে বলে নিজেকে শাড়িতেই পেঁচিয়ে নিয়েছে। শ্রাবনীর ধারনা খুকী চাইছে বিয়েটা যেন পরীক্ষার পর হয়। তার ম্লান মুখ আর নখ খোটা দেখেছিলাম। ধারনা হল কথাটা সত্যি হবে।
কামালের সঙ্গে এক ব্যাচের জন্য যতনা তারচে বেশি মজার সময় গেল পঁচাত্তর সালের একুশের ফেব্রুয়ারীর আয়োজনের সময়। বঙ্গবন্ধুর বিশেষ নির্দেশনায় সেবারই প্রথম ও শেষবারের মত বাংলাদেশে প্রায় আড়াই শতাধিক ছেলেমেয়ে প্রমেনেইড স্টাইলে একযোগে একুশের গান গাইলাম। বারোটা এক মিনিটে গাফফার ভাইর লেখা ও শহীদ আলতাব মাহমুদের সুরে ‘আমার ভায়ের রক্তে একযোগে রেডিও, টেলিভিশন ও লাইভ সব স্থান থেকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। তার পর পরই ফুল রাখা শুরু হয়েছিলো সেবার। এই অনন্য নন্দন ধ্বনি সব জায়গায় আগে রেকর্ড করা হয়েছে সময়মত বাজানো হবে বলে। লাইভ হল ফ্লাড লাইটে শহীদ মিনারে সাদা শাড়ি লাল পাড়ে সাদা পোশাকে। এই আড়াই’শ পৌনে তিন’শ তরুন তরুনী ও মিউজিশিয়ানদের পাঁচ’ছ ঘন্টা অব্যাহত লাইনে রাখা, খাওয়ানো দাওয়ানো, প্র্যাকক্টিস, প্রক্ষালন ও তালিম দেয়ানোর ব্যবস্থা করানোর মত কঠিন কাজের অন্যতম কর্মী ছিল কামাল।
না খুকীর বিবাহ পেছানো যায়নি। তখন মিয়াবিবির হাত থেকে সামাজিকতার হাতে দড়ি। তারপর হল সে যুগান্তকারী বিবাহ। সঙ্গে হল আমাদের কলোনীর মেয়ে কামালদেরই ফার্স্ট কাজিনের সঙ্গে শেখ জামালের। ততদিনে মুশতাক বাহিনীর অপপ্রচারে ও প্রচারে দেশ সত্যি বিভ্রান্ত।
৩২ নম্বরের সে বাড়ি পেরিয়ে যেতে চারতলার ব্যালকনির দিকে তাকাই আর মনে পড়ে খুকীর সঙ্গে এম এ পরীক্ষার হলেই আমার শেষ কথপোকথন, শামীম আসিস না কেনরে- এত কাছে থাকিস। বলতে পারিনা আমার ভয় করে। সেতো এখন আর শুধু আমাদের বন্ধু খুকী না রাজকুমারী। বলি, দোস্ত বলে কি করবি তুই যেখানে ওখানে আমি যাই ক্যামনে আর তুই ইবা আমাদের কাছে আসবি কি ভাবে! সে ম্লান হেসেছিল।
এদিকে ধানমন্ডি উইম্যান কমপ্লেক্স সেজেছে পরদিন সুলতানা কমপ্লেক্স হবে বলে। আগের দিনও মর্নিং ওয়াক করে দেখে এসেছি। পরদিন আমিও যাবো, করতালি দেবো , বন্ধুকে দূর থেকে দেখবো। কি করবে সে আমাকে দেখে। শাড়ি জামা সব ঠিক করে ঘুমিয়েছি। পাশের ঘরে কাঠের কটে শিশু ঈশিতা ঘুমে কাই। আজাদ আমি রাতের শেষ প্রহরে প্রচুর গুলির শব্দে হুড়মুড় করে উঠে প্রথমেই ঈশিতাকে পোটলা করে মেঝেতে শুইয়ে দেই। দিশা করে দেখি গুলির শব্দ আসছে লেকের ওপাড় থেকে। আমার বাথরুমের সঙ্গে লাগোয়া ড্রেসিং রুমটা ওদিকেই। দুজন গড়াতে গড়াতে যাই। জানালার পর্দা সরিয়ে অন্ধকারে ডুবে নেট দিয়ে কিছুই দেখি না বুঝিনা। আশে পাশের প্রতিবেশীরা জেগে কেবল ফিসফাস করছে। গুলির শব্দ ক্রমশঃ যেন আরো দূরে গেল বা দূর থেকে এলো আরো কিছু। আমি ডানা ভাঙা কইতরের মত আমার শিশুকন্যা কোলে পরে রেডিও না মানুষের মুখে সে খবর শুনেছিলাম রে খুকী আমি আজ তার কিছুই মনে করতে পারিনা।
একটা কথা ভাবি, ভাবলে ঘুম আসে না এই এত বছরে জীবনের গোধূলি বেলায়ও যে এমন এক জাতির উত্তরাধিকারী আমি যারা জন্মদাতা পিতাকেই হত্যা করে। নিজ কানে শুনেছি সে পিতৃহন্তার গুলির শব্দ। খুকী, নিষ্পাপ তোকে যে গুলি কেড়ে নিয়েছে তারও। আমাদের ভালবাসার আঠা তোকে বেঁধে রাখতে পারলো না।