পাড়া-মহল্লায়ও ছাত্রদল, যুবদল ও শিবির নেতাদের সিন্ডিকেট হয়েছে
কোরবানির চামড়াগুলো মূলত বিভিন্ন মাদ্রাসা ও এতিমখানার আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। বছরের এই সময়টির অপেক্ষায় থাকে এতিম ছাত্রছাত্রীরা। বাড়ি বাড়ি ঘুরে সংগ্রহ করা চামড়া বিক্রি করে মাদ্রাসা ও এতিমখানার তহবিল গঠন হয়। ফলে মানুষের উপর সাহায্যের নির্ভরতা অনেকাংশে কমে। কিন্তু মানবিক বিবেক বিবেচনাহীন সিন্ডিকেটের কারসাজিতে মাঠ পর্যায় থেকেই ঘটানো হয় চামড়ার এই দরপতন। মধ্যস্বত্ত্বভোগী ও ট্যানারি মালিকরা ক্ষতির সম্মুখীন না হলেও একদিকে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা যেমন ঝুঁকিতে পড়েছে অন্যদিকে মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং শ্রেণীর সাহায্য নির্ভর গোষ্ঠী বঞ্চিত হয়েছে কাঙ্খিত আর্থিক যোগান থেকে।
সারাদেশের কওমি মাদরাসাগুলোতে প্রায় ২০ লাখ শিক্ষক-শিক্ষার্থী রয়েছেন। এ সব মাদ্রাসার আয়ের অন্যতম প্রধান একটি উৎস হলো মানুষের দান করা কোরবানির পশুর চামড়া। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দর পতনের অবস্থা অব্যহত থাকলে মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টরা চামড়া সংগ্রহের কাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। তখন দেশের আনাচে কানাচে কোরবানির চামড়া সংগ্রহ করা ট্যানারি সিন্ডিকেটের পক্ষে সম্ভব হবে না। ফলে চামড়া শিল্পে নেমে আসবে কঠিন বিপর্যয়।
২০১৬ সালে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে লবণের বাজারকে অস্থিতিশীল করে চামড়ার দামে ধ্বস নামানো হয়েছিল। গত বছর প্রশাসনের নজরদারির কারণে সুবিধা করতে না পারলেও এবার একই সিন্ডিকেট পরিকল্পিতভাবে চামড়ার মূল্যে বিপর্যয় সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। চামড়ায় নজিরবিহীন এই দরপতনের কারণে গরুর চামড়া ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা এবং ছাগলের চামড়া ২০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
এবারই প্রথম দেশীয় ৯৩ ভাগ গরু কোরবানী হয়েছে। অন্য ৭ শতাংশ ইন্ডিয়ান এবং বার্মিজ গরু দিয়ে কোরবানী হয়েছে।
জানা গেছে পারটেক্স গ্রুপ কেন্দ্রিক সিন্ডিকেটটি আগেই কম দর নির্ধারণ করে দেওয়ায় চামড়ায় ব্যাপক দরপতন হয়েছে। একের পর এক হাত বদলের পর চামড়া আড়তে পৌঁছে। যুবদল, ছাত্রদল ও শিবিরের বিপুল সংখ্যক নেতাকে এবং মধ্যস্বত্বভোগীর ভূমিকায় দেখা গেছে যারা প্রতিটি ধাপ দাম কমানোর পেছনে কাজ করেছে। মাঠের দেড়শ টাকার চামড়া আড়তদারেরা ৫০০ থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত দরে কিনেছেন। সেখান থেকে চামড়া ট্যানারি মালিকদের কাছে যায়। অর্থাৎ মূলত ক্ষতির শিকার হয়েছে মসজিদ-মাদ্রাসা কেন্দ্রিক মাঠ পর্যায়ের চামড়া সংগ্রাহক ও বিক্রেতারা।
এদিকে, চামড়ার দাম নিয়ে ট্যানারি মালিকরা কোনো সিন্ডিকেট করেননি বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন। দামের অস্থিরতার জন্য ট্যানারি মালিকরা দুষছেন পাড়া-মহল্লার সিন্ডিকেটকে।
এলাকাভিত্তিক চামড়ার দাম পরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা। তবে দুপক্ষই মূল্য বিপর্যয়ের জন্য দায়ী বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী ও আড়ৎদার সমিতির একজন উপদেষ্টা বলেন, “অন্যান্য বছর এই সময় ২০ থেকে ৩০ হাজার চামড়া বেচা-কেনা হতো। এবার ট্যানারি মালিকেরা এখন পর্যন্ত যোগাযোগ করেনি।”
সাধারণ ব্যবসায়ীদের মতে, কতিপয় ট্যানারি মালিক তাদের কারসাজি আড়াল করতেই কৌশল হিসেবে চামড়া ক্রয়ে যোগাযোগ করা থেকে বিরত রয়েছে।
চামড়া খাতের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, চট্টগ্রামে এবার গরু, মহিষ ও ছাগলের পাঁচ লাখের মতো চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কোরবানের দ্বিতীয় দিন পর্যন্ত চট্টগ্রামের আড়তগুলোতে প্রায় আড়াই লাখ চামড়া এসেছে। চামড়া সংগ্রহের নানা ধাপে নজিরবিহীন নৈরাজ্য চলেছে। ট্যানারি মালিকদের নির্ধারিত দামের চেয়েও মাঠ পর্যায়ের ক্রেতারা নিজেদের মতো করে সিন্ডিকেট করে চামড়ার দর নিয়ন্ত্রণ করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন আড়তদার বলেন, আমরা ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে গেছি। চট্টগ্রামে বিদ্যমান দুটির পাশাপাশি আর দুই–চারটি ট্যানারি থাকলে এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে পড়তে হত না।
চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমিতির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমরা কম দামে চামড়া কিনতে পারিনি। মোটামুটি নির্ধারিত দামে এবং ক্ষেত্রবিশেষে বাড়তি দামে চামড়া কিনে আড়তে তুলেছি। এখন ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করার আগ পর্যন্ত বলতে পারছি না ভাগ্যে কী আছে।
মোহাম্মদ অলী উল্ল্যাহ নামে এক চামড়া ব্যবসায়ী জানান, চামড়া কিনেছি ঠিক আছে, কিন্তু ট্যানারি মালিকদের ভূমিকা কী হবে তা বুঝতে পারছি না। তারা যদি যথাযথভাবে টাকা পরিশোধ করে চামড়া নিয়ে যায়, তাহলে আমাদের শেষ রক্ষা হবে। অন্যথায় লোকসানের মুখে পড়তে হবে।
অপর একজন ব্যবসায়ী বলেন, দেশে ট্যানারি মালিকরা চামড়া নিয়ে যেভাবে কারসাজি শুরু করেছেন, তাতে বিপুল পরিমাণ চামড়া ভারতে পাচার হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।
এদিকে ট্যানারি মালিকরা বলছেন, বাংলাদেশি চামড়ার সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে চীন। চীনে চামড়ার চাহিদা অতীতের চেয়ে কমে গেছে। এতে করে ট্যানারি মালিকরা বাজার হারাচ্ছেন। অপরদিকে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের কেমিক্যালের দাম বেড়ে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কেমিক্যাল উৎপাদনকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করে উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। এতে করে সালফিউরিক এসিডসহ বিভিন্ন কেমিক্যালের দাম অনেক বেড়ে গেছে। ফলে ট্যানারি মালিকরা কম দামে চামড়া কিনে তা প্রক্রিয়াজাত করতে চান। আর এ লক্ষ্যে ট্যানারি মালিকরা একজোট হয়ে নিজেদের অনুকূলে দাম নির্ধারণ করে কম দামে চামড়া কেনার ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছেন। মাঠ পর্যায়ের মৌসুমী ক্রেতা থেকে শুরু করে ট্যানারি মালিক পর্যন্ত ধাপে ধাপে সক্রিয় ছিল সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের কারণে প্রতিটি ধাপে কম দামে চামড়া বিক্রি হয়েছে।
চামড়া শিল্ডের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সিন্ডিকেটদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সকলে। বিশেষত কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অর্থের উৎস হিসেবে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও সকলের বিবেচনা করা প্রয়োজন।