প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৈরি পোশাক খাতের উন্নয়নে শ্রমিকদের কল্যাণে বিশেষ দৃষ্টি দিতে মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। পোশাক কারখানার মালিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনারা ব্যবসা করেন। আপনাদের মুনাফা অবশ্যই আপনারা নেবেন। শ্রমিকদের কল্যাণের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন; এটা অব্যাহত রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, এরাইতো (শ্রমিক) আপনাদের কারখানা চালায়। আপনারা আজ যা কিছু উপার্জন করেন, তা এই শ্রমিকদের শ্রমের বিনিময়ে। সেই কথাটা সব সময় মনে রাখবেন। এই কথাটা আমার অনুরোধ।
রবিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মক্ষেত্রে নিহত ও পঙ্গু শ্রমিকদের পরিবারের সদসদ্যদের মাঝে তৈরি পোশাক শিল্পের তহবিল থেকে ক্ষতিপূরনের চেক প্রদানকালে তিনি মালিকদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সময়ে গার্মেন্ট কারখানায় দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ২৩৪ জন শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের হাতে সহায়তার চেক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কর্মক্ষেত্রে নিহত ও আহত শ্রমিক পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতার জন্য সকল প্রস্তুতকারক এবং রপ্তানিকারক শিল্প প্রতিষ্ঠানকে শ্রম এবং কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় কল্যাণ তহবিলের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যেই সকল গার্মেন্টস শিল্প প্রতিষ্ঠানকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় তহবিলের আওতায় আনার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছি।
রপ্তানি মূল্যের ‘০’ দশমিক ‘০’ শুন্য ৩ শতাংশ হারে অর্থ বিজেএমইএ এবং বিকেএমইএর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা হচ্ছে। এজন্য প্রধানমন্ত্রী উদ্যাক্তাদের ধন্যবাদ জানান। একজন গার্মেন্টস শ্রমিক কোন দুর্ঘটনায় নিহত বা গুরুতর আহত হলে তার পরিবারকে ৩ লাখ টাকা করে এই তহবিল থেকে অনুদান পাবেন এবং কর্মক্ষেত্রের বাইরে যে কোন মৃত্যুর জন্য তার পরিবারের স্বজনরা ২ লাখ টাকা পাবেন।
শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়ে এবং কোনো রকম উসকানিতে প্ররোচিত না হতে শ্রমিকদের পরামর্শ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, শ্রমিক ভাই-বোনদের বলব, যে প্রতিষ্ঠান আপনাদের রুটি-রুজির ব্যবস্থা করে, আপনাদের আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করে, সেই প্রতিষ্ঠানটা যাতে ভালোভাবে চলে, সে দায়িত্বটাও কিন্তু আপনাদের শ্রমিকদের।
তিনি বলেন, এই প্রতিষ্ঠান থেকেই আপনি আপনার জীবন-জীবিকার সুযোগ পাচ্ছেন, আপনি অর্থ উপার্জন করছেন। সেটা যাতে ভালোভাবে চলতে পারে অন্য কারও, বাইরের উসকানিতে যেন কোনোরকম দুর্ঘটনা সেখানে না ঘটে, সেটা বিশেষভাবে দেখতে হবে সবাইকে।
শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টির জন্য কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাকে দায়ী করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শ্রমিক রাজনীতির নামে কিছু এনজিও করে, আবার তারা শ্রমিক নেতাও সেজে যায়। শ্রমিকরা কত টাকা বেতন, কি পেল, তাতে ভাগ খাওয়ার জন্য নানাভাবে ঘোট পাকায়। এদের হাত থেকে সব সময় দূরে থাকবেন। আপনাদের যা সমস্যা হবে আমরা তো দেখবই। শ্রমিকদের কল্যাণে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আমি রাজনীতি করি বড় লোককে বড় লোক বানানোর জন্য নয়। আমার রাজনীতি গরীব মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য। আমার রাজনীতি এদেশের কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের জন্য।
সম্প্রতি বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়িয়ে বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টির ঘটনা ঘটেছে বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
বিজিএমইএ ও বিকেএমইএয়ের সদস্য ছাড়াও যেসব প্রতিষ্ঠান পোশাক রপ্তানি করে, তাদেরকেও কেন্দ্রীয় তহবিলের আওতায় আনার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিষয়টি পর্যালোচনা করার জন্য ইতোমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছি।
তৈরি পোশাক শিল্পের উন্নয়নে তার সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথাও প্রধানমন্ত্রী তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে একটা কথা বলতে হবে যে, রপ্তানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিদেশের অবস্থাটাও চিন্তা করতে হবে। অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলোতে, যেখানে আমরা রপ্তানি করি, তারাও অর্থনৈতিকভাবে খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই বলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো রপ্তানি আমাদের কিছু কমেছে।
এজন্য রপ্তানির নতুন বাজার সৃষ্টির তাগিদ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, কোন দেশে কী ধরণের চাহিদা; সে দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের সমস্ত নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে।
দেশে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর বাজারেও তৈরি পোশাকের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের নিজের দেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমার নিজের দেশের বাজার আরও সম্প্রসারণ হচ্ছে। যত মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতা আসবে, তত মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে আর আমার নিজের দেশে বাজার সৃষ্টি হবে। এটাও আমাদের জন্য ভালো। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো.. সেখানেও আমাদের বিশাল বাজার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
চলতি অর্থ বছরে বাজেট প্রস্তাবনায় এ শিল্পের জন্য অগ্রিম আয়কর এক শতাংশ ঘোষণা করেও পরবর্তীতে তা কমিয়ে পূর্বের দশমিক সাত শুন্য শতাংশে বহাল রাখার কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, দেশের মানুষের জন্য তো আমাদের কাজ করতে হবে। আমরা যদি আয়কর বা ট্যাক্স তুলতে না পারি, তাহলে আমরা উন্নয়নটা করব কোথা থেকে? আমরা বিদেশের কাছে হাত পেতে বা ভিক্ষা করে চলতে চাই না। আমাদের নিজেদের অর্থের সংস্থান করতে হবে।
তৈরি পোশাক শিল্পে পরিবেশবান্ধব কারখানার ক্ষেত্রে আয়করের হার ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ এবং অন্যদের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশের পরিবর্তে ১২ শতাংশ নির্ধারণ করার কথাও স্মরণ করিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য শ্রমিকদের কল্যাণ। এক্ষেত্রে মালিক, শ্রমিক ও সরকার মিলে আলোচনার মাধ্যমে শ্রমিকদের সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারে, সে ধরনের একটা ব্যবস্থা আমরা করে দিয়েছি।
শ্রমিকদের কল্যাণে নেয়া পদক্ষেপগুলো যেন শ্রমিকদের কাজে লাগে তা নিশ্চিত করতে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএকে ডেটাবেইজের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে অনুরোধও করেন প্রধানমন্ত্রী।