মে মাসে প্রকাশিত দি ইকোনমিস্টের গবেষণামূলক এক প্রতিবেদনে উদীয়মান সফল অর্থনীতির দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম উল্লেখ করা হয়েছে। আর বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যেও ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে, ২০২০-এ বাংলাদেশের অর্থনীতি দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম। গতকাল রবিবারের সর্বশেষ বৈশ্বিক করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে বলা হয়েছে, আক্রান্তের তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার ১.২৬ শতাংশ। একই প্রতিবেদনে প্রতিবেশী ভারতের মৃত্যুহার দেখানো হয়েছে ৩.০৮, পাকিস্তানে ২.০৩ এবং যুক্তরাজ্যে ১৪.০৩ শতাংশ। পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুর হার প্রায় ১৫ শতাংশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক এই অর্জন এবং করোনা মোকাবেলায় সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বিশ্বব্যাপী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা চলছে।
বিশ্বখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিনের ২২ এপ্রিল সংখ্যায় করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করা হয়েছে। তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৬ কোটির বেশি মানুষের বসবাস বাংলাদেশে। সেখানে দুর্যোগ কোনো নতুন ঘটনা নয়। আর এই করোনা মোকাবেলার ক্ষেত্রে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি (শেখ হাসিনা)। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম প্রধানমন্ত্রীর ত্বরিত সিদ্ধান্তের প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছে, বিষয়টি বেশ ‘প্রশংসনীয়’।
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ব্রিটেনের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভঙ্গুর চিত্র নিয়ে সেখানকার গণমাধ্যম নিয়মিত সমালোচনা করছে। প্রবল প্রতাপশালী যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিলসহ অনেক দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা এ ভাইরাস মোকাবেলায় সমালোচিত হচ্ছেন। ঠিক সেই সময় জনবহুল বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে এককভাবে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রশংসিত হচ্ছেন শেখ হাসিনা।
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যোগ্য নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও ইতিবাচকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এসব গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা নিয়মিত দাপ্তরিক কাজের পাশাপাশি নিজেই দুর্গত মানুষকে খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের বিষয়টি সরাসরি মনিটর করছেন। ৬৪ জেলার ত্রাণ কার্যক্রমের সমন্বয় সাধনের জন্য দায়িত্ব দিয়েছেন ৬৪ জন সচিবকে। সভা করছেন, ভিডিও কনফারেন্সে নিচ্ছেন মাঠ পর্যায়ের খোঁজ, দিচ্ছেন নানা নির্দেশনা। থেমে নেই তাঁর কোনো কাজ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে এই কঠিন সময়েও জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ চলছে। সেখানে নিয়ম করে সংসদ সদস্যরা আসছেন।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে শেখ হাসিনার নির্দেশে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। সাধারণ ছুটি কয়েক দফা বাড়িয়ে ৩০ মে করা হয়। এরপর স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরকারি অফিসের সব কার্যক্রম চলছে। ফলে প্রাকৃতিক এই দুর্যোগেও বাংলাদেশের জীবনযাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক। একই সঙ্গে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। এ অবস্থায় দেশে দেশে মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবেলায় জনবহুল বাংলাদেশকে মডেল হিসেবে ধরা হচ্ছে। সেসব দেশে আলোচনা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৌশল নিয়ে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় জানিয়েছে, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুরু থেকেই সুনির্দিষ্ট কৌশল গ্রহণ করেন এবং সে অনুযায়ী দিকনির্দেশনা দিতে থাকেন। তিনি কারো জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই সব কিছুর নির্দেশনা দিয়ে আসছেন। যখন যেখানে যে প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, তার সমাধানে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই দুর্যোগ মোকাবেলা করতে গিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ একাধিক কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁদের কাজের ব্যর্থতার জন্য।
সূত্র জানায়, করোনা মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চারটি কর্মপন্থা ও কৌশল অবলম্বন করেন। এগুলো হলো—(ক) সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করা : কর্মসৃজনকে প্রাধান্য দেওয়া ও বিলাসী ব্যয় নিরুৎসাহিত করা এবং কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যয় পিছিয়ে দেওয়া; (খ) আর্থিক সহায়তার প্যাকেজ প্রণয়ন : বাজেট বরাদ্দ এবং ব্যাংকব্যবস্থার মাধ্যমে বিনা ও স্বল্প সুদে কতিপয় ঋণ সুবিধা প্রবর্তন করা যাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত হয়, কর্মসংস্থান ঠিক থাকে এবং উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়; (গ) সামাজিক সুরক্ষার আওতা সম্প্রসারণ : হতদরিদ্র, কর্মহীন হয়ে পড়া নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত জনগণকে সুরক্ষা দিতে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি করা এবং (ঘ) বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করা : অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দ্রুত পুনরুজ্জীবিত করা, একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি যাতে না হয় সেদিকে লক্ষ রাখা।
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় দুর্যোগপূর্ণ এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যাপক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে করোনা মোকাবেলায় পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিশেষ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা। জরুরি চাহিদা মেটানোর জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। খুবই অল্প সময়ে দুই হাজার ডাক্তার ও ছয় হাজার নার্স নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আরো দুই হাজার ডাক্তারের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে, যাদের শিগগিরই নিয়োগ দেওয়া হবে। হেল?থ টেকনোলজিস্ট, কার্ডিওগ্রাফার এবং ল্যাব অ্যাটেনডেন্টের তিন হাজার নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এ ছাড়া করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবায় সরাসরি নিয়োজিত ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সম্পূর্ণ সরকারি খরচে হোটেলে থাকা, খাওয়া ও যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি, টেস্ট কিট ও সরঞ্জামাদি ক্রয় এবং করোনা চিকিৎসার সুবিধা আরো বাড়ানোর লক্ষ্যে দ্রুততম সময়ে দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। আরো একটি প্রকল্প বর্তমানে চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এগুলো বাস্তবায়নের ফলে আমাদের করোনা মোকাবেলার সামর্থ্য আরো বাড়বে।
এদিকে গতকাল রবিবার ২৮ জুন পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা ছিল এক কোটি এক লক্ষ দুই হাজার জন। করোনায় মারা গেছে পাঁচ লাখ এক হাজার ৬৪৪ জন। বিশ্বে আক্রান্তের তুলনায় গড় মৃত্যুর হার ৫.০১ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশে এক লাখ ৩৭ হাজার ৭৮৭ জন আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে এক হাজার ৭৩৮ জন।
জরুরি পরিস্থিতিতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব প্যাকেজের সুবিধা ভোগ করতে শুরু করেছে দেশের মানুষ। এর বাইরে দেশের দুই লাখ ৪৪ হাজার ৪৩টি মসজিদকে ১২২ কোটি দুই লাখ ১৫ হাজার টাকা অনুদান প্রদান, পবিত্র রমজান উপলক্ষে কওমি মাদরাসাগুলোকে প্রায় ১৭ কোটি টাকা অনুদান, চার হাজার ৫৬৯টি ইউনিয়ন পরিষদে নিয়োজিত প্রায় ৪৬ হাজার গ্রাম পুলিশকে (দফাদার ও মহল্লাদার) ছয় কোটি টাকা বিশেষ অনুদান প্রদান, নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য ৪৬ কোটি টাকা প্রদান, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ বরাদ্দ, হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়া দরিদ্র-অসহায় মানুষের মাঝে খাদ্য বিতরণ, দেশব্যাপী মোট চার লাখ টন চাল ও এক লাখ টন গম বরাদ্দ, এ পর্যন্ত এক কোটি ৫৯ লাখ পরিবারের মাঝে বিনা মূল্যে চাল বিতরণ; নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে খোলাবাজারে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫৬ হাজার টন চাল বিক্রি করা হয়েছে। এ বাবদ ২৫১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসজনিত কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া দেশের অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে সারা দেশে নির্বাচিত ৫০ লাখ উপকারভোগীর প্রত্যেককে দুই হাজার ৫০০ টাকা করে অনুদান ট্রেজারি থেকে সরাসরি তাদের ব্যাংক বা মোবাইল অ্যাকাউন্টে দেওয়া হয়েছে।
করোনাভাইরাসের মধ্যে বিপুল বেগে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’ সৃষ্ট দুর্যোগ পরিস্থিতিও শক্ত হাতে মোকাবেলা করেছেন শেখ হাসিনা। গত ৩ জুন ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে ‘ফাইটিং সাইক্লোনস অ্যান্ড করোনাভাইরাস : হাউ উই এভাকুয়েটেড ডিউরিং আ প্যানডেমিক’ শিরোনামে এক নিবন্ধে প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, “বাংলাদেশ সুপার-সাইক্লোন ‘আম্ফান’ এবং কভিড-১৯-এর মতো দুটি বিপদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। আমরা অন্যদেরকে একই রকম বিপদ মোকাবেলায় পাঠ দিতে পারি।”