লাল মরিচের রঙে পঞ্চগড়ের কৃষকদের মুখে হাসি ফুটেছে। মরিচ আবাদে লাল সোনায় খ্যাত হয়ে উঠেছে এ জেলা। চা শিল্পের পর পঞ্চগড় মরিচ উৎপাদনেও সমৃদ্ধ হচ্ছে দিন দিন। চলতি বছরে লাল মরিচ থেকে ৭৫০ কোটি টাকার আয় হবে বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস।
পঞ্চগড়ে চলতি মৌসুমে মরিচের বাম্পার ফলনে যেদিকেই চোখ যায়, সেদিকে দেখা মেলে মরিচ আর মরিচ। চাষিরা খেত থেকে পাকা মরিচ তুলছেন। পলিথিন বিছিয়ে মরিচ শুকাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। মরিচে লালে লাল হয়ে উঠেছে পুরো জেলা। চলতি মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় মরিচের বাম্পার ফলন হয়েছে। অল্প খরচে অধিক লাভের আশায় কৃষক ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ছেন মরিচ চাষের দিকে। এতে করে গ্রামীণ চাষিদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটচ্ছে।
জেলার তেঁতুলিয়ার বিভিন্ন এলাকা, সদর ও আটোয়ারীর উপজেলার গড়িনাবাড়ি, আটোয়ারীর তোড়িয়া ও মির্জাপুরসহ বেশ কিছু এলাকাগুলোতে দেখা যায়, গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে চাষিরা খেত থেকে তুলছেন টকটকে লাল মরিচ। বাড়ির উঠান, রাস্তার ধার, পুকুরপাড়, ফাঁকা মাঠ ও বাড়ির ছাদসহ বিভিন্ন জায়গায় সেসব মরিচ শুকাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। লাল মরিচের রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে চারপাশ।
চাষিরা জানান, আবহাওয়া অনুকূলে এবার মরিচ আবাদে বাম্পার ফলন হয়েছে। তারা কেউ এক বিঘা, কেউ দুই বিঘা আবার কেউ তারও বেশি জমিতে মরিচ আবাদ করে বাজারে বেশ ভালো দাম পাচ্ছেন।
তেঁতুলিয়া উপজেলার মরিচ চাষি রুহুল আমিন ও সদর উপজেলার আফসার আলী জানান, এক বিঘা জমিতে মরিচের চাষ করেছি। বিঘায় ১০ থেকে ১৫ মণ শুকনো মরিচ পাওয়া যাবে। কাঁচা মরিচও বিক্রি করেছি। প্রতি মণ শুকনো মরিচ বিক্রি করছি সাড়ে ১২ হাজার টাকায়। বিঘায় ৪০ হাজার টাকা খরচ হলেও বেশ লাভবান হবে বলে জানান এ দুই চাষি।
আটোয়ারী উপজেলার তোড়িয়া সুখাতি গ্রামের কলিম উদ্দিন ও আলোয়াখোয়া গ্রামের ভবেন চন্দ্র বর্মণ সাংবাদিকদের জানান, এক একর জমিতে মরিচ আবাদ করতে প্রায় সাড়ে ৯১ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৩৪ মণ শুকনো মরিচ প্রতি মণ মরিচ ১২ হাজার টাকা ধরে চার লক্ষাধিক বিক্রি করেছেন। একই উপজেলার রাধানগর গ্রামের কৃষক আতিক হাসান উজ্জ্বল জানান, আমি এক বিঘা জমিতে মরিচ চাষ করেছি। মরিচ আবাদ করে শুধু কৃষক লাভবান হচ্ছে না। যারা মরিচ তোলার সাথে জড়িত, তারাও আর্থিকভাবে উপকৃত হচ্ছেন। প্রতিদিন তারা ৫শ থেকে ৭শ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারছেন। একই কথা বলেন বোদা উপজেলার বেংহারি বনগ্রাম ইউনিয়নের ওসমান গণিসহ বেশ কয়েকজন মরিচ চাষি।
স্থানীয় বাজার ঘুরে দেখা যায়, শুকনো মরিচ বাজারজাত ও বিভিন্ন বহুজাতিক কারখানায় সরবরাহ করার কাজে সরগরম হয়ে উঠেছে জেলার পাইকারি বাজারগুলো। ব্যবসায়ীরা জানান, পঞ্চগড়ের মরিচের আকার, বর্ণ ও স্বাদের কারণে চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এসব মরিচ স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হচ্ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। বাজারগুলোতে ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে। শুকনো মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা কেজি দরে। প্রতিদিনই এ এলাকার কাঁচা মরিচ ও শুকনো মরিচ কিনতে ছুটে আসছেন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা। জেলার শালবাহান, জগদল বাজার, ফুটকি বাড়ি বাজার, ঝলোই বাজার, ময়দান দিঘী বাজার ও টুনির হাটসহ বিভিন্ন হাট বাজার থেকে মরিচ কিনে নিয়ে যান তারা।
এদিকে কৃষকের ক্ষেতে মরিচ তুলে আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন গ্রামীণ নারীরা। সংসারের কাজ সেরে এ সময়টাতে চাষিদের ক্ষেত থেকে মরিচ তুলতে ব্যস্ত থাকছেন তারা। এতে তারা সংসারে বাড়তি আয় করতে পারছেন বলে জানান নারী শ্রমিকরা। তারা জানান, প্রতি কেজি মরিচ তুলে তারা পান ৭-৯ টাকা। দিনে তারা মরিচ তুলে ৫শ থেকে সাতশ টাকা পাচ্ছেন। আবার কেউ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারছেন।
নারী শ্রমিক আসমা খাতুন ও রনজিনা বেগম জানান, এ সময়টাতে মরিচ তুলে আমরা বেশ আয় করতে পারি। বছরে ১৫ থেকে ২৫ হাজার পর্যন্ত মরিচ তুলে আয় করতে পারি। এ টাকা দিয়ে ছেলে-মেয়েদের পড়া ও হাত খরচ দিতে পারি। আর সংসারও চলে যায়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মো.শাহ আলম মিয়া বলেন, চলতি মৌসুমে পঞ্চগড়ে মরিচের খুব ভালো আবাদ হয়েছে। দামও ভালো পাচ্ছে চাষিরা। জেলায় ৮ হাজার ২৫ হেক্টর জমিতে মরিচ চাষ হয়েছে। আর ২২ হাজার ৭১০ টন মরিচ উৎপাদন করে ৭৫০ কোটি টাকা আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। দেশীয় জাতসহ জিরা, মল্লিকা, বাঁশ গাইয়া, বিন্দু, হটমাস্টারসহ বিভিন্ন হাইব্রিড জাতের মরিচ ব্যাপক চাষ হয়েছে। বিশেষ করে কাঁচা মরিচ হিসেবে যা বিক্রি হয় তার চেয়েও বেশি শুকিয়ে বিক্রি করা হয়। অনেকেই আবার মরিচ শুকিয়ে সংরক্ষণ করেন, পরে ভালো দামের আশায়। এই মরিচ বর্ষাকাল পর্যন্ত তুলতে পারবেন কৃষকরা।